সেই সুত্রেই গোঁসাইজীর চাকরিতে জবাব দিয়া নিতাই আসিয়া উঠিল স্টেশনে। সমস্ত শুনিয়া রাজা বলিল—ঠিক কিয়া ওস্তাদ। বহুৎ ঠিক কিয়া ভাই।
—আমাকে কিন্তু তোমার এইখানে একটু জায়গা দিতে হবে।
—আলবৎ দেগা। জরুর দেগা।
—এইখানে থাকব, অীর ইন্টিশানে মোট বইব। তাতেই আমার একটা পেট চ’লে যাবে।
রেলওয়ে কনস্ট্রাকশনের সময় এই স্টেশনটি এ লাইনের একটি প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল। সে সময় প্রয়োজনে অনেক ঘরবাড়ী তৈয়ারী হইয়াছিল, সেগুলি এখন পড়িয়াই আছে। তাহারই একটাতে রাজা ওস্তাদের বাসস্থান নির্দিষ্ট করিয়া দিল। নিতাই এখন স্টেশনে কুলিগিরি করে, ভদ্রলোকজনের মোট তুলিয়া দেয়, নামাইয় লয়, গ্রামান্যরেও মোট বহিয়া লইয়া যায়, উপার্জন তাহার ভালই হয়। স্টেশনে মাল নামাইতে-চড়াইতে মজুরি দুই পয়সা, এই গ্রামের মধ্যে যাইতে হইলে চার পয়সা, গ্রামান্যরে হইলে রেট দূরত্ব অনুযায়ী। অন্ত কুলিদের অপেক্ষ নিতাইয়ের উপার্জন বেশী। কারণ তাহার সহায় স্বয়ং রাজ।
স্টেশন-স্টলটি তাহদের একটি আডডা; স্টলের ভেণ্ডার ‘বেনে মামা’ রহস্ত করিয়া নিতাইকে বলে—রাজ-বয়স্য।
মামার দোকানে সজীব-বিজ্ঞাপন বাতব্যাধিতে আড়ষ্ট, অতি-প্ৰগলভ বিপ্রপদ বলে—বয়স্ত কি রে বেট, বয়স্য কি? সভাকবি, রাজার সভাকবি।
নিতাই বিপ্ৰপদর পদধূলি লইয়া ‘সুপ’ শব্দ করিয়া মুখে দেয়, সভাকবি কথাটিতে ভারি খুশী হইয়া উঠে। বিপ্রপদকে বড় ভাল লাগে তাহার। এত যন্ত্রণাদায়ক অমুখের মধ্যেও এমন আনন্দময় লোক দেখা যায় না। বাতব্যাধিগ্রস্ত বিপ্ৰপদ সকালে উঠিয়াই কোনমতে খোড়াইতে খোড়াইতে স্টেশনে আসিয়া মামার দোকানে আডডা লয়, বেঞ্চিতে বসিয়া অনর্গল বকে, লোকজনকে চা খাইতে উৎসাহিত করিয়া মধ্যে মধ্যে হাঁকিয়া উঠে—চ গ্রো-ম! চা গ্রেী-ম! দেহ তাহার যত আড়ষ্ট, জিহা তত সক্রিয়। উৎকট রসিক ব্যক্তি, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ মেজাজের মানুষ। মামার দোকানে সকালবেলায় আসিয়া বিপ্রপদ চ বিড়ি খাইয়া খাইয়া বেলা বারোটায় বাড়ী ফিরে খাইবার জন্য। খাইর, খানিকটা ঘুমাইয়া লইয়া বেলা তিনটার আবার খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে স্টেশনে আসিয়া বসে। যায় রাত্রি সাড়ে দশটার ট্রেন পার করিয়া তবে। বিপ্ৰপদর সঙ্গে নিতাইয়ের জমে ভাল। নিতাই পদধূলি লইলে, বিপ্রপদ স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোকে আশীৰ্বাদ করে–
ভব কপি, মহাকপি দগ্ধানন সলাঙ্গুল—
হাত জোড় করিয়া নিতাই বলে—প্রভু, কপি মানে আমি জানি।
বিপ্রপদ হাসিয়া ভুল স্বীকার করিয়া বলে—ও। কপি নয়, কপি, নয়, কবি, কবি। আমারই ভুল। আচ্ছা, কবি তো তুই বটিস, কই বল দেখি—‘শকুনি খেললে পাশা, রাজ্য পেলে দুৰ্যোধন, বাজী রাখলে যুধিষ্ঠির কিন্তু ভীমের বেটা ঘটোৎকচ মরল কোন পাপে?’
নিতাই সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কবিগান আরম্ভ করিয়া দেয়। বা হাত গালে চাপিয়া মুখের সম্মুখে ডান হাত আড়াল দিয়া ঈষৎ ঝুঁকিয়া সুর ধরিয়া আরম্ভ করে—আ হা রে—ঘটোৎকচ মরল কোন্ পাপে?
রাজা ভাবে, ঢোলকট পাড়িয়া আনিবে নাকি? কিন্তু সে আর হইয় উঠে না। ইতিমধ্যে বারোটার ট্রেনের ঘণ্টা পড়ে।
দূরান্তরের যাত্রী অধিকাংশই পায় নিতাই। স্টেশনের জমাদার রাজার মুপারিশে যাত্রীরা নিতাইকেই লইয়া থাকে। নিতাইয়ের ব্যবহারও তাহারা পছন্দ করে।
মজুরির দরদপ্তর করিতে নিতাই সবিনয়ে বলে—প্রভু, গগনপানে দিষ্টি করেন একবার। গ্রীষ্মকাল হইলে বলে—দিনমণির কিরণটা একবার বিবেচনা করেন। বর্ষায় বলে—কিষ্ণবন্ন মেঘের একবার আড়ম্বরটা দেখেন কর্তা। শীতে বলে—শৈত্যের কথাটা একবার ভাবেন বাৰু।
মামার দোকানে বসিয়া বিপ্রপদ নিতাইকে সমর্থন করে,—বলে—আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনাদের তো সব শাল-দোশাল আছে। ওর যে কোন শালাই নাই। ওর কষ্ট্রের কথা বিবেচনা করুন একবার।
দ্বিপ্রহরে বাহিরে যাইতে হইলে নিতাই রাজাকে বলিয়া যায়—রাজন, ঠাকুরঝি এলে দুধটা নিয়ে রেখে।
এখানে থাকিলে বারোটার ট্রেনটি চলিয়া গেলেই নিতাই একটু আগাইয়া গিয়া পয়েন্টের কাছে লাইনের ধারে যে কৃষ্ণচুড়ার গাছটি আছে তাহাঁর ছায়ায় গিয়া দাঁড়ায়। দ্বিপ্রহরে তখন রোদ পড়িয়া লোহার লাইনের উপরের ঘষা অংশটা সুদীর্ঘ রেখায় ঝকমক করে। নিতাই নিবিষ্ট মনে, যেখানে লাইনটা বাক ঘুরিয়াছে সেইখানে দৃষ্টি আবদ্ধ করিয়া দাঁড়ায়। সহসা সেখানে শুভ্র একটি চলন্ত রেখার মত রেখা দেখা যায়, রেখাটির মাথায় একটি স্বর্ণবর্ণ বিন্দু। স্বর্ণবর্ণ-বিন্দুশীর্ষ শুভ্ৰ চলন্ত রেখাটি আগাইয়া আসিতে আসিতে ক্রমশ পরিণত হয় একটি মানুষে। ক্ষারে কাচ তাঁতের মোটা সূতার খাটো কাপড়খানি আঁটসাঁট করিয়া পরা সে একটি কালো দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে; এবং তাহার মাথায় একটি তক-তকে মাজা সোনার বর্ণের পিতলের ঘটী। ঘটীটি সে ধরে না—একহাতে মাপের গেলাস, অন্য হাতটি দোলে, সে দ্রুতপদে অবলীলাক্রমে চলিয়া আসে। মেয়েটি চলে দ্রুত ভঙ্গিতে, কথাও বলে দ্রুত ভঙ্গিতে। মেয়েটি সেই ঠাকুরঝি।
নিতাই নেশা করে না; কিন্তু দুধ তার প্রিয়বস্তু। চায়েও আসক্তি তাহার ক্রমশ বাড়িতেছে। ঠাকুরঝির কাছে সে নিত্য একপোয়া করিয়া দুধ যোগান লইয়া থাকে। দুধ আসিলেই চায়ের জল চড়াইয়া দেয়। মামার দোকানে চা খাইলে দাম দিতে হয় দু পয়সা কাপ। বিপ্রপদর মত বিনা পয়সার চা খাইবার অধিকার তাহার নাই। তা ছাড়া জমে না। কেমন ছোট ছোট মনে হয়।
স্টেশনে নিত্য নানা স্থানের লোকজনের আনাগোনা। আশপাশের খবর স্টেশনে বলিয়াই পাওয়া যায়। খবরের মধ্যে কবিগানের খবর থাকিলে নিতাই উল্লসিত হইয়া উঠে। সেদিন সন্ধ্যাতেই লালপেড়ে পরিষ্কার ধুতি ও হাতকাটা জামাটি পরিয়া, মাথায় পাগড়ি বাঁধিয়া সাজে এবং গুন-গুন করিয়া কবিগান গাহিতে গাহিতে রাজাকে আসিয়া তাগাদ দেয়। মিলিটারী রাজা সাড়ে আটটার ট্রেন পার করিয়াই বলে—ফাইভ মিনিট ওস্তাদ!
পাঁচ মিনিটও তাহার লাগে না, তিন মিনিটের মধ্যেই রেলওয়ে কোম্পানির দেওয়া নীল কোর্তাটা চড়াইয়া স্টেশনের একমুখে বাতি ও লাঠি হাতে বাহির হইয়া পড়ে। ভোর হইবার পূর্বেই আরার ফিরিয়া আসে। শুধু কবিগানই নয়, যাত্রাগান, মেল—এ সবই নিতাইয়ের ভাল লাগে। আহ, আলোকোজ্জ্বল উৎসবমুখর রাত্রির মধ্যেই যদি সমস্ত জীবনটা তাহার কাটিয়া যায়, তবে বড় ভাল হয়।
মনের এই বাসনাটুকু সে দুই কলি গানে বাঁধিয়া রাখিয়াছে। নির্জন প্রান্তর পাইলেই গাহিয়া সে নিজেকেই শুনায়; আর শুনায় কোন রসময় ভাইকে। সে রসময় ভাই তাহার রাজন।