স্টেশনের পয়েণ্টসম্যান রাজা বায়েন তাহার বন্ধু। রাজালাল একটু অদ্ভুত ধরণের লোক। বিগত মহাযুদ্ধের সময় তাহার ছিল তরুণ বয়স, সে ঘটনাচক্রে কুলি হিসাবে গিয়া পড়িয়াছিল মেসোপটেমিয়ায়। ফিরিয়া আসিয়া কাজ করিতেছে এই লাইট রেলওয়েতে। প্রাণখোলা দিলদরিয়া লোক, অনর্গল ভুল হিন্দী বলে, ঘড়ির কাটার মত ডিউটি করে, বার ছয়-সাত চা খায়, প্রচুর মদ খায়, ভীষণ চীৎকার করে, স্ত্রীপুত্রকে ধরিয়া ঠেঙায়। রাজার সঙ্গে নিতাইয়ের আলাপ অনেক দিনের, অর্থাৎ রাজার এখানে আসিবার পর হইতেই আলাপ, সে প্রায় তিন বৎসর আগের ঘটনা।
নিতাই সেদিনও, অর্থাৎ প্রথম আলাপের দিনও স্টেশনে বেড়াইতে আসিয়াছিল, রাজার ছেলেট ট্রেন আসিবার ঘণ্টা বাজিতেই হাঁকিতে শুরু করিয়াছিল—হট যাও! হট যাও! লাইনের ধারসে হট যাও!
নিতাইয়ের বড় ভাল লাগিয়াছিল, সে প্রশ্ন করিয়াছিল—বাহা রে! কাদের ছেলে হে তুমি?
—আমি রাজার ছেলে।
—রাজার ছেলে? কেয়াবাৎ! তবে তো তুমি ‘যোবরাজ’!
রাজা ছিল কাছেই, সে নিতাইয়ের কথা শুনিয়া হাসিয়াই সারা। সঙ্গে সঙ্গে সে নিতাইয়ের সঙ্গে আলাপ জমাইয়া ফেলিয়াছিল। ট্রেন চলিয়া যাইতেই রাজা নিতাইকে ধরিয়া লইয়া একেবারে তাহার কোয়ার্টারে আনিয়া হাজির করিয়াছিল। স্ত্রীকে বলিল—আমার বন্ধুনোক! উমদা’আদমী! ফটকেটাকে বলে—রাজার বেটা যোবরাজ। বলিয়া সে কি তাহার হা-হা করিয়া হাসি!
নিতাই উৎসাহভরে কবিয়ালদের নকল করিয়া গালে হাত দিয়া, মুখের সম্মুখে অপর হাতটি রাখিয়া ঈষৎ ঝুকিয় রামায়ণ স্মরণ করিয়া গান ধরিয়াছিল—
রাজার বেটা যোবরাজা, ভেজার বেটা মহাতেজা
খায় সে খাস্তা খাজা গজা
বিদিত ভো-মগুলে!
রাজা লাফ দিয়া ঘরের ভিতর হইত্তে তাহার পৈতৃক ঢোল ও তাহার নিজের কাঁসি বাহির
করিয়া আনিয়। নিজে লইয়াছিল ঢোলটা—ছেলেটার হাতে দিয়াছিল কাঁসিটা। ওই কাঁসিটা রাজার বাবা রাজাকে কিনিয়া দিয়াছিল মহেশপুরের মেলায়। সেদিন .দ্বিপ্রহরেই কবিগান জমির উঠিয়াছিল রাজার ঘরে। নিতাই রাজার ছেলেকে যোবরাজ বলিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, রাজার পরিবারের দিকে ফিরিয়া গাহিয়াছিল—
রাজার ঘরের ঘরণী যিনি—তিনি মহামান্যা রাণী—
তিনি থান বড় বড় ফেনী—
সর্বলোকে বলে।
ঠিক এই সময় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল আর একজন। পনের-ষোল বছরের একটি কিশোরী। মেয়েটির রং কালো, কিন্তু দীঘল দেহভঙ্গীতে ভূঁইচাপার সবুজ সরল ডাটার মত একটি অপরূপ শ্ৰী। মেয়েটির মাথায় কাপড়ের বিড়ার উপর তকতকে মাজা একটি বড় ঘটী, হাতে একটি ছোট গেলাস; পরনে দেশী তাঁতের মোটা সূতার থাটো কাপড়। মোট সূতার খাটো কাপড়খানির আঁটোসাঁটো বেষ্টনীর মধ্যে তাহার ছিপছিপে কালো দীঘল দেহখানির স্বাভাবিক খাজগুলিকে প্রকট করিয়া যেন একটি পোড়ামাটির পুতুলের মত দেখায়। মেয়েটি রাজার শ্যালিকা, পাশের গ্রামের বধূ। সে এই বর্ধিষ্ণু গ্রামখানিতে প্রত্যহ দুধের যোগান দিতে আসে। রাজার স্টেশনে গাড়ী আসে ঘড়ির কাঁটা ধরিয়া, আর এই মেয়েটি আসে—পশ্চিমসমীপবর্তী দ্বিপ্রহরের সুর্যের অগ্ৰগামিনী ছায়ার মত। মেয়েটির সরল ভীরু দৃষ্টিতে বিস্ময় যেন কালো জলের স্বচ্ছতার মত সহজাত। সেদিন সবিস্ময়ে কিছুক্ষণ এই দৃশ্য দেখিয়া অকস্মাৎ এই সরল মেয়েটি হাসিতে আরম্ভ করিয়াছিল—অসঙ্কোচ খিলখিল হাসি।
রাজার স্ত্রী কিন্তু কঠিন মেয়ে, সে বোনকে ধমক দিয়াছিল—হাসিস না ফ্যাক ফ্যাক ক’রে। বেহায়া কোথাকার!
মুহূর্তে মেয়েটির হাসি বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু সে রাগ করে নাই বা দুঃখিত হয় নাই, স্বচ্ছন্দে শাসন মানিয়া লওয়ার মত বেতসলতাসুলভ একটি নমনীয়তা তাহার স্বভাবজাত গুণ। দেহখানিই শুধু লতার মত নয়, মনও যেন তাহার দীঘল দেহের অনুরূপ।
নিতাইও থামিয়া গিয়াছিল। ধরতার সময় পার হইয়া গেল, তবু নিতাই আর গান ধরিল না দেখিয়া রাজা বাজনা বন্ধ করিল। এবং মেয়েটিকে বলিল—দেখত কেয়৷ ঠাকুরঝি? হামারা মিতা। ওস্তাদ আদমী। হামারা নাম হায় রাজা, তো ফটকেকো নাম দিয়া যোবরাজ, তোমারা দিদিকে নাম দিয়া রাণী —বলিয়াই অট্টহাসি।
এবার অট্টহাসির ছোঁয়াচে রাণীও হাসিতে আরম্ভ করিয়াছিল। তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরঝিরঞ্চ আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল আবার সেই হাসি। হাসিতে হাসিতে মাথার অবশ্যণ্ঠন খসিয়া গেল, চোখ দিয়া টপটপ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িল, তবু তাহার সে হাসি থামিল না।
হাসি থামাইয়া রাজা বলিয়াছিল—ওস্তাদ! ই কালকুটি হামার ঠাকুরঝি হায়। ইস্কো কেয়া নাম দেগা ভাই।
নিতাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখিতেছিল, তাহার সর্বাঙ্গে কচিপাতার মত যে একটি কোমল বনাম ঐ আছে, তাহা দেখিয়া তাহাকে লইয়া রহস্ত করিতে নিতাইয়ের প্রবৃত্তি হয় মাই। সে বলিয়াছিল—ঠাকুরঝি ভাই ঠাকুরঝি, ওর আর দোসর নাম হয় না। আমার ঠাকুরঝিও ঠাকুরঝি, রাজার ঠাকুরৰিও ঠাকুরকি। ঠাকুরঝি আমাদের সবারই ঠাকুবঝি। কেমন ভাই ঠাকুরঝি!
রাজা নিতাইয়ের তর্ক-যুক্তিতে অবাক হইয়া গিয়াছিল। গভীরভাবে ঘাড় নাড়িয়া সে স্বীকার করিয়াছিল—হাঁ, হাঁ, ঠিক, ঠিক। ই বাত তো ঠিক হ্যাঁয়! ঠাকুরঝি ঠাকুরঝি!
তাহার পর খাজা পাড়িয়াছিল মদের বোতল-আও ভাই ওস্তাদ!
নিতাই জোড়হাত করিয়া বলিয়াছিল—মাফ কর ভাই রাজন। ও দব্য আমি ছুঁই না।
-তব্? তব্, তুমি কি খায়েগা ভাই?
ঠাকুরকি বলিয়াছিল—দুধ খাবা, দুধ? বলিয়া আবার সেই খিল থিল হাসি।
নিতাই হাসিয়াছিল—তা খেতে পারি। এমন দব্য কি আছে ভো-মগুলে? দেবদুল্লভ।
ঠাকুরঝি সত্যই বড় ঘটি হইতে মাপের গেলাসে পরিপূর্ণ একগ্লাস দুধ ঢালিয়া নিতাইয়ের সম্মুখে নামাইয়া দিয় তাহার অভ্যস্ত দ্রুতগমনে প্রায় পলাইয়া গিয়াছিল।
এ সব পুরোনো কথা।
রাজা এখন তাহার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, গুণমুগ্ধ ভক্ত।