“ওমা দিগম্বরী নাচ গো।”
সঙ্গে সঙ্গে বেহারার কাঁধে চড়িয়া ক্ষ্যাপী মা নাচে।
“হাড়ের মালা গলায় ভোলা নাচে থিয়া থিয়া।”
ভোলানাথ নাচে, তাহার সঙ্গে গাজনের ভক্তেরা নাচে। হাজারে হাজারে কাতারে কাতারে লোক আশেপাশে যাহার দাঁড়াইয়া থাকে—তাহারাও মনে মনে নাচে। আবার সর্বনাশী এলোকেশীর মত মা চণ্ডী আসিয়া তাহার সামনে দাঁড়াইলেন। তাঁহার সঙ্গে সবাই। সবাইকে মনে পড়িল।
প্রথমেই মনে পড়িল ঝুমুর দলটিকে—নির্মলা বোনকে মনে পড়িল—ললিতাকে মনে হইল, মাসী আসিয়া ‘বাবা’ বলিয়া তাহার চোথের সামনে দাঁড়াইল। বেহালাদার, দোহার, বাজনদার, রাজন, বণিক মাতুল, বিপ্ৰপদ ঠাকুর, সকলে দূরে যেন ভিড় জমাইয়া দাঁড়াইয়া আছে। ঠাকুরঝিকে মনে পড়িল, কৃষ্ণচূড়ার গাছতলায় পথের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ওই যে! —গ্রামের ধারের নদী ও নদীর ধারে চরভূমিতে তরির চাষ, বিস্তীর্ণ মাঠ, বৈশাখে মাঠের ধূলা, কালবৈশাখীর ঝড়, কালো মেঘ, ঘনঘোর অন্ধকার, সেই চোখ ধাঁধানে বিদ্যুৎ—সেই কড়্ কড়্ শব্দে মেঘের ডাক —ঝর্ ঝর্ বৃষ্টি—সব মনে হইল। পূর্ণিমায় ধর্মরাজ-পূজার উৎসব। ঢাক শিঙা কাঁসির বাজনার সঙ্গে ফুলের মালা গলায় ভক্তদলের নাচ। গভীর রাত্রে বাগান হইতে ভক্তদলের ফল সংগ্রহ; কত কথা মনে পড়িল;–বাবুদের পুরানো বাগানে গাছের কোটরে অজগরের মত গোখরার বাস; গোখুরাগুলা ডালে ডালে বেড়ায়, দোল খায়; কিন্তু ভক্তের যখন ‘জয় ধৰ্মরঞ্জো’ বলিয়া রোল দিয়া গাছে চড়ে, তখন সেগুলা সন্তর্পণে কোথায় গিয়া লুকাইয় পড়ে। বাগানের সেই পুরানো বটগাছতলায় অরণ্যষষ্ঠীর দিন মেয়েদের সমারোহ মনে পড়িল। আল-পথ ধরিয়া বিচিত্র বর্ণের কাপড়চোপড় পর সারিবন্দী মেয়েদের যাওয়ার ছবি নিতাইয়ের চোখের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিল। আল-পথের দু’ধারে লকলকে ঘন-সবুজ বীজধানের ক্ষেত; মাঝখান দিয়া পথ। আষাঢ় আসিতেছে। আকাশে হয়তো ইহারই মধ্যে মেঘ দেখা দিয়াছে, শামলা রঙের জলভরা মেঘ। ভাবিতে ভাবিতে নিতাইয়ের ‘বার-মেসে’ গানের কথা মনে হইল।
বৈশাখে সুর্যের ছটা—
যত সূর্য-ছটা, কাটফাটা, তত ঘটী কালবৈশাখী মেঘে—
লক্ষ্মী মাপেন বীজ-ধান্ত চাষ-ক্ষেতের লেগে।,
পুণ্য ধরম মাসে–
পুণ্য—ধরম মাসে—ধরম আসে- পূর্ণিমাতে (সবে) পূজে ধৰ্মরাজায়—
আমার পরাণ কাঁদে, হায় রে বিধি কাঠের মতন বক্ষ ফেটে যায়।
তারপরে জ্যৈষ্ঠ আসে—
জ্যৈষ্ঠ এলে, বৃক্ষতলে, মেয়ের দলে অরণ্যষষ্ঠী পূজে।
জামাই আসে, কন্যা হাসে—সাজেন নানা সাজে।
দশহরায় চতুভূজা—
দশহরায় চতুভূজ গঙ্গা পূজা, এবার সোজা মাঠ ভাসিবে বস্তায়—’
আমার পরাণ কাঁদে, হায় রে বিধি— চোখের জলে বক্ষ ভেসে যায়।
এমনি করিয়া আষাঢ়ের রথযাত্রা–বর্ষার বাদল–অম্বুবাচীর লড়াই, শ্রাবণের রিমিঝিমি বর্ষণ মাথায় করিয়া ধানভরা ক্ষেত পার হইয়া সেই বাবাজীর আখড়ায় ঝুলন-উৎসব দেখার স্মৃতি হইতে চৈত্রের গাজন পর্যন্ত মনে করিয়া করিয়া সে এক নূতন বারমেসে গান মনের আবেগে রচনা করিয়া ফেলিল—
বছর শেষে-চৈত্র মাসে—
বছর শেষে চৈত্র মাসে, দিব্য হেসে বসেন এসে অন্নপূর্ণা পূজোর টাটে।
ভাণ্ডার পরিপূর্ণ, মাঠ শূন্য, তিল পুষ্প ফুটছে শুধু মাঠে—
তেল নাহি হ্যায় শিবের মাথায়, ভরল জটায়–অঙ্গেতে ছাই গাজনে ভূত নাচায়।
আমার পরাণ কাঁদে— হায় রে বিধি—পক্ষ মেলে উড়ে যেতে চায় ॥
অধীর হইয়া সে প্রভাতের প্রতীক্ষা করিয়া রহিল। বারবার এখানকার নূতন-মাকে মনে মনে উদ্দেশ করিয়া বলিল—তুমি আমাকে ছলনা করেছ মা! সেখানকার মা তুমি, আমাকে ফেরাবার জন্য আগে থেকে এখানে এসে বসে আছ? তোমার আজ্ঞা আমি মাথায় নিলাম। শিরোধার্য করলাম।
* * *
মাসখানেক কোনরকমে কাশীতে কাটাইয়া নিতাই আবার একদিন ট্রেনে চড়িয়া বসিল। কোন রকমেই সে ঐখানে থাকিতে পারিল না।
এই এক মাস সে ভাল করিয়া ঘুমায় নাই। তাহার সঙ্গে উৎকণ্ঠার, উদ্বেগের তাহার অবসান হইয়াছে। ঘুম যেন তাহাকে চাপিয়া ধরিয়াছে। মোগলসরাই জংশনে কোনরূপে উঠিয়া ট্রেন পালটাইয়া নূতন গাড়ীতে উঠিয়া সে বাঁচিয়া গেল। ছাদের সঙ্গে ঝুলানো বেঞ্চগুলার একটা খালি ছিল, সেই বেঞ্চে উঠিয়াই সে শুইয়া পড়িল। আঃ-নিশ্চিন্ত! সোনার দেশে আপন মায়ের কোলে ফিরিয়া চলিয়াছে সে।
পরদিন সকালে যখন তাহার ঘুম ভাঙিল তখন মনে হইল অতি পরিচিত জন কেহ তাহাকে ডাকিতেছে। পরিচিত কেহ ভারি মিষ্টমুরে যেন তাহাকে ডাকিল—
–কে, কে? নিতাই ধড়, মড়, করিয়া উঠিয়া বসিল।
না, চেনা কেহ নয়, তাহাকে নয়। নীচের বেঞ্চে একজন লোক গোটা বেঞ্চটা জুড়িয়া শুইয়া আছে, তাহাকেই কতকগুলি নবাগত যাত্রী ডাকিতেছে—ওঠ—ওঠ।
নিতাই হাঁপ ছাড়িয়া বঁচিল। আঃ, গাড়ীটা চেনামূখে যেন ভরিয়া গিয়াছে। সব চেনা, সব চেনা! নিতাই তাড়াতাড়ি উপর হইতে নীচে নামিয়া—সবিনয়ে আগন্তুক যাত্রীদলের একজনকে বলিল—মালগুলো ওপরে তুলে দি?
—দাও তো দাদা, দাও তো।
—বেঁচে থাক বাবা; বড় ভাল ছেলে তুমি। এক বৃদ্ধ তাহাকে আশীৰ্বাদ করিল।
মালগুলা তুলিয়া দিয়া নিতাই জানালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখিল। ইন্টিশানের বাহিরের দিকে চাহিয়া তাহার চোখ জুড়াইয়া গেল। সব চেনা—সব চেনা! আঃ–তবে তো দেশে আসিয়া পড়িয়াছে! জানালার বাহিরে বাংলা দেশ। সব চেনা। রাণীগঞ্জ পার হইল। এইবার বর্ধমান। বাহিরে আকাশে ঘন মেঘ করিয়াছে।
বর্ধমানে গাড়ী বদল করিয়া—ঘণ্টা দুয়েক মাত্র, তাহার পরই সে গ্রামে গিয়া পড়িবে। মা চণ্ডী, বুড়ে শিব!
মা চণ্ডী বুড়োশিবের দরবারে বসিয়াই সে ভগবানকে গান শুনাইবে। তীর্থে তীর্থে মেলায় মেলায়—তারকেশ্বরে—কালীঘাটে গিয়া গান শুনাইয়া আসিবে। দেশের জেলায় জেলায় ঘুরিয়া দেশের লোককে গান শুনাইয়া ফিরিবে। সে নিশ্চয় করিয়া জানে যে তাহাদের গান শুনাইয়া পরিতৃপ্ত করিতে পারিবে। সে এবার নিজেই কবির দল করিবে, এখন তাহার নাম হইয়াছে, বায়নার অভাব হইবে না। কবিয়াল নিতাইচরণের নামে দেশের লোকও ভাঙিয়া আসিবে। মেলা-খেলায় গালাগাল খেউড় নইলে চলে না। তাহার মধ্যেও কৌতুক আছে, তবু সে ভালবাসার গানকেই বড় করিবে। বসন্তকে হারাইয়া সে বুঝিতে পারিয়াছে সমস্ত পৃথিবী জুড়িয়া ওই একই খেদ। জীবন এত ছোট কেনে? ভালবাসিয়া সাধ কেন মেটে না, ছোট এতটুকু জীবনের পরিসরে ভালবাসিয়া কেন কুলায় না? ভালবাসার গান। খেদের গান। এই খেদ মোর মনে –সেই থেদের গান –বসন্তের নাম করিয়া গান ৷
কোকিল কি বসন্তকে ভুলিতে পারে?
এক্সপ্রেস ট্রেনটা থামিয়া গেল। একটা বড় স্টেশনে আসিয়া পড়িয়াছে। বর্ধমান! বর্ধমান!