হুজুর-ভদ্দ পঞ্চজন রয়েছেন যখন
সুবিচার হবে নিশ্চয় তখন—
জানি জানি—
বাবুরা খুব বাহবা দিলেন—বহুৎ আচ্ছা! বাহব! বাহবা! নেতাই বলছে ভাল!
সাধারণ শ্রোতারাও বলিল—ভাল। ভাল। ভাল হে।
নিতাই ধাঁ করিয়া লাফ মারিয়া ঘুরিয়া ঢুলীটাকে ধমক দিয়া বলিল—অ্যা-ই কাটছে। সঙ্গে সঙ্গে সে তাল দেখাইয়া হাতে তালি দিয়া বাজনার বোল বলিতে আরম্ভ করিল—ধিকড় তা-তা-ধেনতা—তা-তা-ধেনতা—গুড়-গুড় তা-তা-থিয়া—ধিকড়;–হাঁ–! বলিয়া সে তাহার নূতন স্বরচিত ধুয়াটায় ফিরিয়া আসিল—
ক-য়ে কালী কপালিনী—খ-য়ে খপ্লরধারিণী,
গ-য়ে গোমাতা সুরভি—গণেশজননী—
কণ্ঠে দাও মা বাণী।
একপাশে কতকগুলি অর্ধশিক্ষিত ছোকরা বসিয়া ছিল—তাহারা হি-হি করিয়া হাসিয়া উঠিল।
একজন বলিল—গ-য়ে গরু, ছ-য়ে ছাগল, ভ-য়ে ভেড়া। বহুৎ আচ্ছা!
হাস্যধ্বনির রোল উঠিয়া গেল।
নিতাই সঙ্গে সঙ্গে খাড় দাঁড়াইল, তারপর হাস্যধ্বনি অল্প শাস্ত হইতেই বলিল—বলি দোয়ারগণ!
মহাদেবের দোয়ার রাগ করিয়া বসিয়া ছিল, অপর কোনো দোয়ারও ছিল না। কেহই সাড়া দিল না। নিতাইও উত্তরের প্রত্যাশ না করিয়াই বলিল–দোয়ারগণ! গোমাত শুনে সবাই হাসছে! বলছে, গ-য়ে গরু, ছ-য়ে ছাগল, ভ-য়ে ভেড়া!
ঢুলীট এবার বলিল—হ্যাঁ!
—আচ্ছ —বলিয়া সে ছড়ার স্বরে আরম্ভ করিল—
গো-মাতা শুনিয়া সবে হাস্য করে।
দীন নিতাইচরণ বলছে জোড়করে—
বলিয়া হাত দুইটি জোড় করিয়া একবার চারিদিক ঘুরিয়া লইল। বন্ধু রাজা পরম উৎসাহে বলিয়া উঠিল—বহুৎ আচ্ছ ওস্তাদ।
কিন্তু নিতাই তখন চোখে স্পষ্ট করিয়া কিছু দেখিতেছিল না, রাজাকেও সে লক্ষ্য করিল না,
সে আপন মনে ছড়াতেই বলিয়া গেল—
শুনুন মহাশয় দীনের নিবেদন।
গো কিম্বা গরু তুচ্ছ নয় কথন।।
গাভী ভগবতী, ষাঁড় শিবের বাহন।
মুরভির শাপে মজে কত রাজন॥
রব উঠিল—ভাল! ভাল! ঢুলীটা ঢোলে কাঠি দিল—ভূডুম!
নিতাই বলিল—
শাস্ত্রের সার কথা আরও বলে যাই।
গো-ধন তুল্য ধন ভূ-ভারতে নাই।।
তেঁই গোলকপতি—বিষ্ণু বনমালী।
ব্রজধামে করলেন গরুর রাখালী॥
নিতাইয়ের এই উপস্থিত জবাবে সকলে অবাক হইয়া গেল। ছন্দে বাঁধিয়া এমন ত্বরিত এবং যুক্তিসম্পন্ন জবাব দেওয়া তো সহজ কথা নয়। বন্ধু রাজা পর্যন্ত হতবাক; রাজার বউয়ের হাসি থামিয়া গিয়াছে; ঠাকুরঝির অবগুণ্ঠন খসিয়া পড়িয়াছে—দেহের বেশবাসও অসম্বৃত।
নিতাইয়ের তখনো শেষ হয় নাই, সে বলিল—
তা ছাড়া মশাই—আছে আরও মানে—
গো মানে পৃথিবী শুধান পণ্ডিত জনে ॥
এবার বাবুরাও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়া উঠিলেন। আসরের লোকের হরিধ্বনি দিয়া উঠিল।
নিতাই বিজয়গর্বে ঢুলীটাকে বলিল–বাজাও।
এতক্ষণে সকলে নড়িয়া চড়িয়া বসিল, রাজা একবার ফিরিয়া স্ত্রী ও ঠাকুরঝির দিকে চাহিয়া হাসিল—অর্থাৎ, দেখ! স্ত্রী বিস্ময়ে মুগ্ধ হাসি হাসিয়া বলিল—তা বটে বাপু।
তরুণী ঠাকুরঝিটির কিন্তু তখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটে নাই। সে বিপুল বিস্ময়ে শিথিল-চৈতন্তের মত নিতাইয়ের দিকে চাহিয়া ছিল। রাজা তাহার অসম্বৃতবাস বিম্মিত ভঙ্গি দেখিয়া বিরক্ত হইয়া উঠিল, রূঢ়স্বরে বলিল—অ্যাই! ও ঠাকুরঝি! মাথায় কাপড় দে।
রাজার স্ত্রী একটারর ঠেলা দিয়া বলিল—মরণ, সাড় নাই মেয়ের!
ঠাকুরঝি এবার জিভ কাটিয়া কাপড় টানিয়া মাথায় দিয়া বলিল—আচ্ছা গাইছে বাপু ওস্তাদ।
ওদিকে বাবুদের মহলেও বিস্ময়ের সীমা ছিল না। সেই কলিকাতা-প্রবাসী চাকুরে বাবুটি পর্যন্ত স্বীকার করিলেন—yes । এ রীতিমত একটা বিস্ময়। Son of Dom—অ্যাঁ–He is a poet !’
দুর্দান্ত ভূতনাথ ক্রুদ্ধ হইলে রুদ্র, তুষ্ট হইলে আশুতোষ—মানসিক অবস্থার এই দুই দূরতম প্রান্তে অতি সহজেই সে গঞ্জিকাপ্রসাদে বোমমার্গে নিমেষমধ্যেই যাওয়া-আসা করিয়া থাকে, সে একেবারে মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিল। সে বলিল—ধুকুড়ির ভেতর খাস চাল রে বাবা! রত্ন রে—একটা রত্ন-মানিকের বেটা মানিক! বলিহারি রে!
মোহন্ত হাসিয়া বলিলেন—আমার পাগলী বেটর খেয়াল বাবা; নিতাইকে বড় করতে মা আমার নোটনকে তাড়িয়েছেন।
ইহার পরই আরম্ভ হইল মহাদেবের পালা। মহাদেব পাকা প্রাচীন কবিয়াল। ব্যাপারটা দেখিয়া শুনিয়া ক্রুদ্ধ ভ্ৰকুটি করিয়া গান ধরিল—ব্যঙ্গে, রঙ্গে, গালি-গালাজে নিতাইকে শূলবিদ্ধ করিয়া তিলে তিলে বধ করিতে আরম্ভ করিল। তাহার সরস, অশ্লীলতা-ঘেষা গালি-গালাজে সমস্ত আসরট হাস্যরোলে মুখর হইয়া উঠিল। নিতাই আসরে বসিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছিল, এবং মনে মনে গালি-গালাজের জবাব খুঁজিতেছিল।
কিন্তু ক্ষুণ্ণ হ’ল রাজা। সে মিলিটারী মেজাজের লোক, বন্ধুকে গালি-গালাজগুলা তাহার, অসহ্য হইয়া উঠিল। সে আসর হইতে উঠিয়া খানিকটা মেলার মধ্যে ঘুরিবার জন্য চলিয়া গেল। রাজার স্ত্রী প্রচুর হাসিতেছিল। ঠাকুরঝি মেয়েটি কিন্তু অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছে, সেও এবার বিরক্ত ভরে বলিল—হাসিস না দিদি! এমনি ক’রে গাল দেয় মানুষকে!
মহাদেব ছড়া বলিতেছিল—
সুবুদ্ধি ডোমের পোয়ের কুবুদ্ধি ধরিল।
ডোম কাটারি ফেলে দিয়ে কবি করতে আইল।।
ও-বেটার বাবা ছিল সিঁদেল চোর, কর্তা-বাবা ঠ্যাঙাড়ে।
মাতামহ ডাকাত বেটার-দ্বীপাস্তরে মরে ॥
সেই বংশের ছেলে বেটা কবি করবি তুই।
ডোমের ছাওয়াল রত্নাকর, চিংড়ির পোনা রুই।