* * *
নোটন ভাগিয়াছে শুনিয়া অপর পাল্লাদার কবি মহাদেব আসরে বসিয়া মনে মনে আপসোস করিতেছিল। আজও পর্যন্ত নোটনের সহিত পাল্লায় কখনও সে পরাজয় স্বীকার করে নাই, কিন্তু আজ সে সর্বন্ত:করণে নীরবে পরাজয় স্বীকার করিল—সঙ্গে সঙ্গে নোটনকে বেইমান বালয় গালও দিল। তাহাকে বলিলে কি সেও যাইত না!
আসরের জনতা ক্রমশঃ ধৈর্য হারাইয়া ফেলিতেছিল, সংবাদটা তখনও তাহাদের কাছে পরিষ্কার হয় নাই। অধীর শ্রোতার দল কলরবে একেবারে হাট বাধাইয়া তুলিয়াছে। অন্যদিকে একপাশে মেলার কর্তৃপক্ষ এবং গ্রাম্য জমিদারগণ নোটন-প্রসঙ্গ আলোচনা করিতেছিলেন। মোহন্ত চিন্তিতভাবে দাড়িতে হাত বুলাইতেছেন। মধ্যে মধ্যে বলিতেছেন—তারা, তারা!
নোটন ভাগিয়াছে, কবিগান হইবে না,—এই কথাটি একবার উচ্চারিত হইলে হয়, সঙ্গে সঙ্গে এই দর্শকদল বাঁধভাঙা জলাশয়ের জলের মত চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িবে। জলশূন্ত পুষ্করিণীর ভিজা পাকের মত জনশূন্ত মেলাটায় থাকিবে শুধু পায়ের দাগ আর ধূলা।
ওদিকে আর একদল গ্রাম্য জমিদার একেবারে খড়ের আগুনের মত জলিয়া উঠিয়াছে। এখনি পাইক লাঠিয়াল ভেজিয়া গলায় গামছা বাধিয়া লোটনকে ধরিয়া আনিয়া জুতা মারিয়া পিঠের চামড়া তুলিয়া দিবার ব্যবস্থা হইতে ক্ষতিপূরণের মামলা করিয়া হতভাগ্যের ভিটামাটি উচ্ছন্ন দিবার ব্যবস্থা পর্যন্ত—নানা উত্তেজিত কল্পনায় তৃণদাহী বহির মতই তাহারা লেলিহান হইয়া জলিতেছে।, এই জমিদারদের অন্যতম, গঞ্জিকাসেবী ভূতনাথ—নামে ভূতনাথ হইলেও দক্ষযজ্ঞনাশী বিরূপক্ষের মতই সে দুর্মদ ও দুর্দান্ত—সে হঠাৎ মালকোঁচ সাঁটিয়া লাফাইরা উঠিল। বলিল-দুটো লোক। বলিয়া দুইটা আঙুল তুলিয়া ধরিল। কিছুক্ষণ থামিয়া থাকিয়া বলিল—দোঠো আদমী হামার সাথ দেও, হাম আভি যায়গা। দশ কোশ রাস্ত। আরে দশ কোশ তো ফুলকীমে চলা যায়গা। বলিয়া সে যেন ফুলকী চালে চলিবার জন্য দুলিতে আরম্ভ করিল।
ঠিক এই সময়েই কে একজন কথাটা জানিয়া ফেলিয়া আসরের প্রান্ত হইতে হাঁকিয়া উঠিল—উঠে আয় রে রাখহরি, উঠে আয়।
—কেন রে? উঠে গেলে আর জায়গা থাকবে না।
—জায়গা নিয়ে ধুয়ে খাবি? উঠে আয়—বাড়ী যাই—ভাত খাই গিয়ে ওরে নোটন দাশ ভাগলবা, পালিয়েছে। কবি হবে না।
—ন। মিছে কথা।
—মাইরি বলছি। সত্যি।
রাখহরি রসিক ব্যক্তি, সে সঙ্গে সঙ্গে বলিয়া উঠিল—বল হরি—! সমগ্র জনতা নিম্নাভিমুখী আলোড়িত জলরাশির কল্লোলের মতই কৌতুকে উচ্ছ্বসিত হইয়। ধ্বনি দিয়া উঠিল—হরি বে—ল! অর্থাৎ মেলাটির শবযাত্র ঘোষণা করিয়া দিল। সঙ্গে সঙ্গে তৃণ-দাহী বহ্নি যেন ঘরে লাগিয়া গেল। জমিদারবর্গ জনতার উপরেই ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল।
—কে? কৈ? কে রে বেটা?
—ধর তো বেটাকে, ধর তো। হারামজাদা বজ্জাত, ধর তো বেটকে!
ভূতনাথ ব্যাঘ্রবিক্রমে ঘুরিয়া রাখহরির বদলে যে লোকটিকে সম্মুখে পাইল, তাহারই চুলের মুঠায় ধরিয়া হুঙ্কার দিয়া উঠিল—চোপ রও শালা।
অন্ত কয়েকজনে তাহকে ক্ষন্ত করিল—হাঁ-হাঁ-হাঁ! কর কি ভূতনাথ, ছাড়, ছাড়। ও রাখহরি নয়।
ভূতনাথ তাহাকে ছাড়িয়া দিল, কিন্তু বীরবিক্রমে শাসন করিয়া দিল–খবর—দা—র! একজন বিবেচক ব্যক্তি বলিল—মেলা-খেলায় ও-রকম করে মানুষ। রঙ তামাসা নিয়েই তো মেলা হে। ভোলা ময়রা, কবিয়াল-জাড়া গারে কবি গাইতে গিয়ে জমিদারের মুখের সামনেই বলেছিল—“কি ক’রে তুই বললি জগ, জাড়া গোলক বৃন্দাবন, যেখানে বামুন রাজা চাষী প্রজা—চারিদিকেতে বাঁশের বন! কোথায় বা তোর শ্যামকুণ্ডু কোথায় বা তোর রাধাকুণ্ডু–সামনে আছে মুলোকুণ্ডু করগে মুলো দরশন।” তাতে তো বাবুর রাগ করে নাই, খুশীই হয়েছিল।
ভূতনাথ এত বোঝে না, সে বক্তাকে এক কথায় নাকচ করিয়া দিল—যা-যা-যাঃ। কিসে আর কিসে—ধানে আর তুষে।
—আরে তুষ হ’লেও তো ধানের খোসা বটে। চটলে চলবে কেন? দু’তিন মাইল থেকে সব তামাক টিকে নিয়ে এসেছে কবিগান শুনতে। এখন শুনছে—’কবিয়াল ভাগলব’; তা ঠাট্টা ক’রে একটু হরিধ্বনি দেবে না? রেগে না।
মোহন্ত এখন মোহান্ত হইয়াছেন বটে, কিন্তু এককালে তিনি একজন পাকা পাটোয়ার অর্থাৎ জমিদার-সেরেস্তার কুটবুদ্ধি নায়েব ছিলেন। গাজা তিনি চিরকালই থান। তিনি এতক্ষণ ধরিয়া নীরবে কবিগানের কথাই চিন্ত করিতেছিলেন। তিনি হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন—আচ্ছ, আচ্ছ, কবিগানই হবে। চিন্তা কি তার জন্তে? চিন্তামণি যে পাগলী বেটার দরবারে বাধা, উীর চিনির ভাবনা। বলিয়া হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। হইয়াছে, চিনির সন্ধান মিলিয়াছে। কবিগান চিনি কি না—সে প্রশ্ন তখন কাহারও মনে উঠিবার কথাও নয় সময়ও নয়। সুতরাং সে প্রশ্ন না করিয়া সকলে উৎসুক দৃষ্টিতে মোহন্তের মুখের দিকে চাহিল। .
মোহন্ত বলিলেন—ডাক মহাদেবকে আর তার প্রধান দোয়ারকে। অতঃপর ঘাড় নাডিতে নাড়িতে বলিলেন—তাই হোক—গুরু-শিষেই যুদ্ধ হোক। রামরাবণেব যুদ্ধের চেয়ে দ্রোণ-অজুনের যুদ্ধ কিছু কম নয়। রামায়ণ সপ্তকাণ্ড, মহাভারত হ’ল অষ্টাদশ পর্ব।
শোর-গোল উঠিল—মহাদেব! মহাদেব! ওহে কবিয়াল। ওস্তাদজী হে, শোন শোন।
কবি – ০২
দায়ে পডিয়া মহাদেব প্রস্তাবটায় সম্মতি না দিয়া পারিল না।
মোহন্ত সুদুর্লভ আশীৰ্বাদ করিয়া তাহাকে কল্পতরুর তলায় বসাইয়া দিলেন এবং চারিদিকে প্ৰমত্ত জনতা। অত:পর সম্মত না হইয়া উপায় কি! কিন্তু আর একজন চুলি ও দোয়ারের প্রয়োজন। ঠিক এই সময়েই নিতাইচরণের আবির্ভাব। সে জোড়হাতে পরম বিনয়সহকারে শুদ্ধ ভাষায় নিবেদন করিল-প্রভু, অধীনের নিবেদন আছে—আপনাদের সি-চরণে।
অন্ত কেহ কিছু বলিবার পূর্বেই মহাদেব কবিয়ালই বলিয়া উঠিল—এই যে, এই যে আমাদের নেতাইচরণ রয়েছে; তবে আর ভাবনা কি? নেতাই বেশ পারবে দোয়ারকি করতে। কি রে, পারবি না?
নিতাইয়ের গুণাগুণ কবিয়ালরা জানিত, কবিগান যেখানেই হউক, সে গিয়া ওই দোয়ারদের দলে মিশিয়া বসিয়া পড়িত, কখনও কাঁসি বাজাইত—আর দোয়ারের কাজে তো প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত বেগার দিয়া যাইত।
বাবুদলের মধ্যে একজন কলিকাতার চাকরি করেন, ময়লা কাপড়-জামার গাদার মধ্যে তিনি ধোপন্থরস্ত পাটকর বস্ত্রের মতই শোভমান ছিলেন। চালটিও তাহার বেশ ভারিন্ধী, তিনি খুব উচুদরের ধারাভারী পৃষ্ঠপোষকের মত করুণামিশ্রিত বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন—বল কি, অ্যাঁ? নেতাইচরণের আমাদের এত গুণ! A poet! বাহবা, বাহবা রে নিতাই! তা লেগে যা রে বেটা, লেগে যা। আর দেরি নয়—আরম্ভ ক’রে দাও তা হ’লে। তিনি হাতঘড়িটা দেখিবার চেষ্টা করির বলিলেন—এখনই তো তোমার— ক’টা রাজল?
কে একজন ফস করিয়া দেশলাইয়ের একটা কাঠি জালিরা আগাইয়া ধরিল।
ভদ্রলোক বিরক্ত হইয়া হাতটা সরাইয়া লইয়া বলিলেন—আঃ! দরকার নেই আলোর। রেডিয়ম দেওয়া আছে, অন্ধকারে দেখা যাবে।
ভূতনাথ এত সব রেডিয়ম-ফেডিয়মের ধার ধারে না, সে হি-হি করিয়া হাসিয়া নিতাইকেই বলিল—লে রে বেটা, লে; তাই কাক কেটেই আজ অমাবস্যে হোক। কাক—কাকই সই! তোর গানই শুনি!
নিতাই মনে মনে আহত হইলেও মুখে কিছু বলিল না। ওদিকে তখন আসরে ঢোলে কাঠি পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, কুড় তাক কুড় তাক কুড়ুম-কুড়ম।
নিতাই দোয়ারকি করিতে লাগিয়া গেল। আপন দোয়ারের সহিত কবিওয়ালার কবিগানের পাল্লা। সুতরাং পাল্লা বা প্রতিযোগিতাট হইতেছিল আপোসমূলক—অত্যন্ত ঠাণ্ড রকমের। তীব্রতা অথবা উষ্ণতা মোটেই সঞ্চারিত হইতেছিল না। শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠিল দুই ধরণের। যাহারা উহাদের মধ্যে তীক্ষ্ণবুদ্ধি, তাহার বলিল—দূর দূর। ভিজে ভাতের মত গান। এই শোনে! সাঁট ক’রে পাল্লা হচ্ছে! চল বাড়ী যাই। দুই চার জন আবার উঠিয়াও গেল। –
অপর দল বলিল—মহাদেবের দোয়ারও বেশ ভাল কবিয়াল মাইরি! বেশ কবিয়াল, ভাল কবিয়াল! টকাটক জবাব দিচ্ছে।
নিতাইচরণের প্রশংসাও হইতেছিল। প্রশংসা পাইবার মত নিতাইচরণের মূলধন আছে। তাহার গলাথানি বড় ভাল। তাহার উপর ফোড়নও দিতেছে চমৎকার। মহাদেবের দোয়ারকে পিছনে ফেলিয়া নিজে স্বাধীনভাবে দুই-চার কলি গাহিবার জন্য সে প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছে।
বাবুর ইহাতে তাহাকে উৎসাহ দিলেন—বলিহারি বেটা, বলিহারি! বলিহারি!
নিতাইয়ের স্বজন ও বন্ধুজনে বলিল—আচ্ছ, আচ্ছা!
এক কোণে মেয়েদের জটলা। এ মেয়েরা সবাই ব্রাত্য সমাজের। তাহদেরও বিস্ময়ের সীমা নাই, নিতাইয়ের পরম বন্ধু স্টেশনের পয়েণ্টসম্যান রাজালাল বায়েনের বউ হাসিয়া প্রায় গড়াইয়া পড়িতেছে—ও মা গো! নেতাইয়ের প্যাটে প্যাটে এত! ও মা গো!
তাহার পাশেই বসিয়া রাজার বউয়ের বোন, ষোল-সতের বছরের মেয়েটি, পাশের গ্রামের বউ—সে বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গিয়াছে, সে মধ্যে মধ্যে বিরক্ত হইয়া বলিতেছে—না ভাই, খালি হাসছিস তু! শোন কেনে!
রাজ বন্ধু-গৌরবে অদূরে বসিয়া ক্রমাগত তুলিতেছিল, সে হাসিয়া বলিল- দেখতা হ্যায় ঠাকুরঝি? ওস্তাদ কেয়সা গান টাটা হ্যায়, দেখতা?
রাজা এই শ্যালিকাটিকে বলে—ঠাকুরঝি! নিতাইও তাহাকে বলে—ঠাকুরঝি। শ্বশুরবাড়ী অর্থাৎ পাশের গ্রাম হইতে সে নিত্য দুধ বেচিতে আসে। নিতাই নিজেও তাহার কাছে এক পোয় করিয়া দুধের ‘রোজ’ লইয়া থাকে! এই কারণেই মেয়েটির বিস্ময় এত বেশী। যে লোককে মানুষ চেনে, তাহার মধ্য হইতে অকস্মাৎ এক অপরিচিত জনকে আত্মপ্রকাশ করিতে দেখিলে বিস্ময়ে মানুষ এমনই হতবাক হইয়া যায়।
নিতাইয়ের কিন্তু তখন এদিকে চাহিয়া দেখিবার অবসর ছিল না। সে তখন প্রচণ্ড উৎসাহে উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছে, উৎসাহের প্রাবল্যে সে গল্পের উটের মত নাসিকা-প্রবেশের পথে মাথা গলাইয়া দিল এবং নিজেই সে স্বাধীনভাবে গান আরম্ভ করিল। আ-করিয়া রাগিণী টানিয়া মহাদেবের দোয়ারের রচিত ধুটাকে পর্যন্ত পাটাইয়া দিয়া সেই সুরে ছলে নিজেই নূতন ধুয়া ধরিয়া দিল। এবং নিজের সুন্দর কণ্ঠের প্রসাদে তাহাকে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করিয়াও ফেলিল।
মহাদেবের দোয়ার, সে-ই প্রকৃত একপক্ষের পাল্লাদার ওস্তাদ। সে আপত্তি তুলিয়া বলিয়া উঠিল—অ্যাই! ও কি? ও কি গাইছ তুমি? অ্যাই—নেতাই! অ্যাই!
নিতাই সে কথা গ্রাহই করিল না। বা হাতখানিতে কান ঢাকিয়া ডান হাতখানি খুখু নিবারণের জন্য মুখের সম্মুখে ধরিয়া গান গাহিয়াই চলিল। সম্মুখের দিকে অল্প একটু ঝুকিয়া তালে তালে মৃদু নাচিতে নাচিতে সে তখন গাহিতেছিল—