নিদান হকায় জীবন মশায়ের নাম ছিল—আজও আছে।
নাড়ি দেখে বহুজনের মৃত্যু তিনি পূর্বাহ্নেই ঘোষণা করেছেন তার চিকিৎসক জীবনে। একের পর এক রোগীর কথা পলকে পলকে মনে উঠে মিলিয়ে যায়। এই মনে পড়াটার গতি অতি অস্বাভাবিক রকমের দ্রুত। থেমে গেল এক জায়গায়। সুরেন মিশ্রের ছোট ছেলে শশাঙ্কের মৃত্যু ঘোষণার কথায়। মনে পড়ল শশাঙ্কের ষোড়শী বধূর সেই বিচিত্র দৃষ্টি; তার সেই মর্মান্তিক কথাগুলি।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন তিনি।
কত মৃত্যু, কত কান্না, কত নীরব মর্মান্তিক শোক তিনি দেখেছেন। রোগীর জীবনান্ত ঘটেছে–তিনি ভারী পায়ে স্থির পদক্ষেপে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা তিনি করেছেন, কিন্তু জেনেই যে, চেষ্টা ব্যর্থ হবে। মনকে প্রস্তুত রেখে করেছেন; এমন রোগীর বাড়ি থেকে চলে আসতেন—ভাবতে ভাবতেই পথ চলতেন। তখন পথে অতি অন্তরঙ্গ-জনও চোখে পড়ত না। রোগের কথা, চিকিৎসার কথা ভাবতেন; কখনও কখনও মৃত্যুর কথাও ভাবতেন। মশায়ের ভাবমগ্ন চিত্ত তখন বিশ্বলোক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাতার পর পাতা উলটে যেত। তাই বাইরের দৃষ্টিপথে মানুষ পড়েও পড়ত না। বহু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে দূরের গ্রামে, রোগীর মৃত্যুর পর বাধ্য হয়েই সেখানে প্রতীক্ষা করতে হত; শোকবিহ্বল পরিবারটির মধ্যে বসে থাকতেন অঞ্চল হয়ে, গুমটে ভরা বায়ুপ্রবাহহীন গ্রীষ্ম-অপরাহ্নের স্থির বনস্পতির মত। লোকে এইসব দেখে ডাক্তারদের বলে থাকে-ওরা পাথর। খুব মিথ্যে বলে না তারা। পাথর খানিকটা বটে ডাক্তারেরা। মৃত্যু এবং শোেক দেখে চঞ্চল হবার মত মনের বেদনাবোধও নষ্ট হয়ে যায়। মনে ঘটা পড়ে; সাড় হারিয়ে যায়। শশাঙ্কের মৃত্যু-রোগে মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ঘোষণা করতে গিয়ে আঘাত তিনি পেয়েছেন কিন্তু চিকিৎসকের কর্মে কর্তব্যে ত্রুটি তিনি করেন নি। তাঁর নিজের পুত্র–।
আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বিষণ্ণ হাসি হাসলেন। নিজের পুত্রের হাত দেখেও তিনি তার মৃত্যু ঘোষণা করেছিলেন। তিন মাস আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। একথা তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন। ছেলে ছিল ডাক্তার, তাকেও ইঙ্গিতে বুঝিয়েছিলেন। আজ ভাবেন–কেন বলেছিলেন এ কথা?
চিকিৎসাবিদ্যায় পারঙ্গমতার দম্ভে।
তাই যদি না হবে, সত্যকে ঘোষণা করে মনের কোণে আজও এমন বেদনা অনুশোচনা সঞ্চিত হয়ে রয়েছে কেন? ওই স্মৃতি মনের মধ্যে জেগে উঠলেই একটি ছি-ছি-কার সশব্দে মৰ্মস্থল থেকে বেরিয়ে আসে কেন? পরমানন্দ মাধবকে মনে পড়ে না কেন? উদাস দৃষ্টি তুলে মশায় তাকিয়ে থাকেন আকাশের নীলের দিকে। অথচ জানাতে হয়, বলতে হয়। তার বিধি আছে। চিকিৎসকের কর্তব্য সেটা। তার ক্ষেত্র আছে।
০১. উনিশশো পঞ্চাশ সাল–বাংলা তেরশো ছাপ্পান্ন
উনিশশো পঞ্চাশ সাল–বাংলা তেরশো ছাপ্পান্ন সালের এক শ্রাবণ-অপরাহ্নে জীবন মশায় এমনি করেই তাকিয়ে ছিলেন আকাশের দিকে। পথের উপর থেকে কেউ যেন তাকে ডাকলে।
–প্ৰণাম গো, ডাক্তার জ্যেঠা।
–কে? মতি! কোথায় যাবি রে?
মতি কর্মকার কয়লার ধুলোমাখা আটহাতি কাপড়খানা পরেই কোথায় হনহন করে চলেছে। গোষ্ঠ কর্মকারের ছেলে মতি। গোষ্ঠ ডাক্তারকে বড় ভক্তি করত। ডাক্তারও তাকে ভালবাসতেন। গোষ্ঠ অনেকগুলি ওষুধ জানত। সন্ন্যাসীদত্ত ওষুধ। রঘুবর ভারতী ছিলেন বড়দরের যোগী। এসব ওষুধ তার কাছ থেকে পেয়েছিল সে। ডাক্তারকে গোষ্ঠ ওষুধগুলি দিতে চেয়েছিল। ডাক্তার নেন। নি। তবে অনেক রোগীকে তিনি পাঠিয়ে দিতেন গোষ্ঠের কাছে। বিশেষ করে দুদিন অন্তর জ্বরের জন্য। বড় পাজি জ্বর ওটা। পালাজ্বর অর্থাৎ একদিন অন্তর জ্বর—তবু ওষুধ মানে। কিন্তু ওই দুদিন অন্তর জ্বর ও ওষুধ মানে না। মানাতে অন্তত দীর্ঘদিন লাগে। কুইনিন ইনজেকশনও মানতে চায় না। অথচ ওই রঘুবর ভারতীর ওষুধে একদিনেই বন্ধ হয়ে যাবে। আগে গোষ্ঠ দিত, এখন মতিই দেয়, জ্বরের নির্দিষ্ট দিনে একটা হলুদমাখা ন্যাকড়ায় একটা জলজ গাছের পাতা কচলে রস বার করে বেঁধে শুকতে দেয়। তাতেই জ্বর বন্ধ হয়। হবেই বন্ধ। বিচিত্র দ্ৰব্যগুণ রহস্য! অতি বিচিত্র। এই রোগী পাঠানো নিয়েই গোষ্ঠের সঙ্গে ডাক্তারের তরঙ্গতা হয়েছিল। এদেশের সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা চিকিৎসা-প্রণালী প্রচলিত ছিল বিস্ময়কর ফলপ্রদ চিকিৎসায় একবার তার ইচ্ছা হয়েছিল এই চিকিৎসা-প্রণালী জান পর, কিন্তু—হুঁ। কিন্তু তাঁর গুরুর নিষেধ ছিল। তিনি বলেছিলেন ডাক্তারি যখন শিখেছ, তখন ওদিকে যেয়ো না। যার গুণ বিজ্ঞানসম্মতভাবে জান না, তাকে প্রয়োগ কোরো না।
মতি কর্মকার বললে—একবার আপনার কাছেই এলাম জ্যেঠা।
বাঁচলেন মশায়। একজন কথা বলবার লোকের জন্য তিনি অধীর হয়ে উঠেছিলেন। এবার তক্তপোশে ভাল করে বসলেন তিনি, পুরনো তাকিয়াটাকে টেনে নিয়ে বললেন–আয় আয়। বোস। কী খবর বল?
—একবার আমার বাড়িতে যেতে হবে।
–কেন?
–মাকে একবার দেখতে হবে।
–কী হল মায়ের?
–আজ্ঞে, মাসখানেক হবে, পুকুরঘাটে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল, তাপরেতে খুবই বেদনা হয়, নিয়ে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। তখন দেখে বেঁধেছেদে ছেড়ে দিয়েছিল, বলেছিল,–দিনকতক ওঠাহাঁটা কোরো না, সেরে যাবে। তাই গিয়েও ছিল। কিন্তু আবার আজ দিন আষ্টেক হল বেদনাটা চাগিয়ে উঠেছে; দিনরাত কনকন করছে। আবার নিয়ে গেলাম হাসপাতাল বললে, এক্স-রে করতে হবে, সে না হলে কিছু বলতে পারবে না। তা—সে তো অনেক খরচ–অনেক ঝাট! তাই বলি, যাই জ্যেঠার কাছে।