রক্তের চাপ দুশো চল্লিশ; হৃৎপিণ্ডে আক্রমণ হয়েছে।
বিকেলবেলা মশায় বলেছিলেন ওই কথা।
পাপপুণ্যের বিচার মৃত্যুর কাছে নাই। বলেছিলেন, জলমগ্নকে উদ্ধার করতে গিয়ে তার পাকে জড়িয়ে পড়লেও মৃত্যু আসে, আবার কঠিন হিংসায় কাউকে ছুরি মারতে গিয়ে ছুরি খেলেও মৃত্যু আসে। ওখানে সে নির্বিকার।
নিজের নাড়ি ধরে বলেছিলেন—সে আসছে। মনে হচ্ছে গ্রামের বাইরে তার পায়ের শব্দ উঠছে; গ্রামে ঢুকবার মুখে ধর্মরাজ স্থানের বকুলতলায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। হেসেছিলেন। একটু।
প্রদ্যোত বলেছিল, আপনাকে কিছু বলা আমার উচিত নয়, এটা ঠিক আপনার থেম্বসিস নয়, একটা স্প্যাজ্মের মত। এ তো চলে যাচ্ছে। পার হয়ে যাবে।
দিন পনেরর মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তখন বলেছিলেন গঙ্গাতীরে যাবেন।
সে যাওয়া তার হয় নি। নিজেই মত পরিবর্তন করেছিলেন। আতর-বউয়ের কথা ভেবে। বলেছিলেন, না থাক। আতর-বউ একা পড়বে। ওর দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকবে না। এখানে আপনারা আছেন—দুঃখ-কষ্টের ভাগ নিচ্ছেন। সেখানে? কে নেবে ভাগ?
আতর-বউ একটি কথাও বলেন নি। তিনি যেন পাথর হয়ে গেছেন। বনবিহারীর স্ত্রী, তার ছেলে একবার এসেছিল, দেখে চলে গেল। মশায় প্রথম আক্রমণের পর সামলে উঠেছিলেন। উঠে-হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন।
প্রদ্যোত বলেছিল, আমি বলেছিলাম, আপনি সেরে উঠবেন।
মশায় হেসেছিলেন। কোনো কথা বলেন নি।
প্রদ্যোত অনুযোগ করে বলেছিল—আমাদের কিন্তু একটা কথা বলবার আছে। আপনি নিজের নাড়ি বার বার দেখেন।
মশায় জবাব দিয়েছিলেন সে আমি অনেকদিন থেকেই দেখি ডাক্তারবাবু।
-না। ওটা দেখতে পাবেন না।
হেসে মশায় বলেছিলেন-বহু লোকের নাড়ি দেখে তার মৃত্যুদিন বলে এলাম। নিজে যখন সুস্থ ছিলাম–তখন দেখেছি—তার হদিস পাবার জন্য। আর আজ যখন সে কাছে এল—তখন তার পায়ের শব্দ যাতে শুনতে না পাই, তার জন্যে তুলো খুঁজে কান বন্ধ করে বসে থাকব। ডাক্তারবাবু?
প্রদ্যোত এ কথার জবাব দিতে পারে নি। মশায় আবার বলেছিলেন মৃত্যুর জন্যে আমার আতঙ্ক নাই ডাক্তারবাবু। সুতরাং ওতে উদ্বেগের জন্যে আমার রক্তের চাপ বাড়বে না। তবে
একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন—তবে প্রথম দিন প্রস্তুত ছিলাম না তো; একেবারে অকস্মাৎ ঘুমের মধ্যে হৃৎপিণ্ডে আক্ৰমণ হল। তখন ভয় পেয়েছিলাম, একেবারে অসহায় শিশুর মত আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিলাম। মতির মাকে তিরস্কার করেছিলাম, কিন্তু ওর দোষ নেই। মৃত্যুভয়ের তুল্য ভয় নেই, মৃত্যুরোগের যন্ত্রণার তুল্য যন্ত্রণা নেই। কিন্তু সে ভয়কে পার হয়ে আজ কি আমি উটপাখির মত বালির মধ্যে মুখ খুঁজে বসে থাকব?
***
তিন মাস পর দ্বিতীয় আক্রমণ হয়েছিল। আক্রমণের পূর্বদিন নিজেই বলেছিলেন ডাক্তারবাবু, এইবার সে বকুলতলা থেকে বিশ্রাম সেরে উঠে দাঁড়াল।
কথাটা প্রদ্যোতের মনে ছিল না। তাই বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করেছিল, আজ্ঞে?
–আবার একটা ঝাপটা আসবে ডাক্তারবাবু। রক্তের চাপ বাড়বে।
–কই না তো! প্রেসার তো সেই একই আছে!
–বাড়বে। নাড়িতে বুঝতে পারছি আমি।
তাই বেড়েছিল। পরের দিন প্রেসারের গতি ঊর্ধ্বমুখী দেখা গিয়েছিল। সন্ধেতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। আজ চার দিন আগে হয়েছে তৃতীয় আক্রমণ।
প্রদ্যোত ডাক্তার বললে—কাল থেকে প্রায় ধ্যানে বসেছেন। চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে বসে রয়েছেন। আমাকে বললেন–ঘুমের ওষুধ আমাকে দেবেন না, ঘুমের মধ্যে মরতে আমি চাই না। আমি সজ্ঞানে যেতে চাই।
মঞ্জু বললে–মায়ের দিদিমার মৃত্যুর খবরটা শুনেছেন? বলেছ?
–বলতে চেয়েছিলাম, উনি শোনেন নি। পত্ৰখানা পকেটে করেই নিয়ে গিয়েছিলাম। বললাম, আমার শাশুড়ির সেই বুড়ি দিদিমা, কাঁদীর ভূপীবাবুর স্ত্রী, তাঁর হাত দেখে যে বলেছিলেন—! উনি হাত নেড়ে বারণ করলেন। মৃদুস্বরে বললেন– ওসব থাক।
***
বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় মশায় চোখ বুজে অর্ধ-আচ্ছনের মত পড়ে ছিলেন। মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছিলেন। সে আসছে তিনি জানেন। তার পায়ের ধ্বনি যেন তিনি। শুনতে পেয়েছেন। সেই প্রথম আক্রমণের দিন থেকেই জানেন। কিন্তু তা তো নয়, শেষ মুহূর্তে সজ্ঞানে তার মুখোমুখি হতে চান। তার রূপ থাকলে তাকে তিনি দেখবেন; তার স্বর থাকলে সে কণ্ঠস্বর শুনবেন; তার গন্ধ থাকলে সে গন্ধ শেষ নিশ্বাসে গ্রহণ করবেন তার স্পর্শ থাকলে সে স্পৰ্শ তিনি অনুভব করবেন। মধ্যে মধ্যে ঘন কুয়াশায় যেন সব ঢেকে যাচ্ছে। সব যেন হারিয়ে। যাচ্ছে। অতীত, বর্তমান, স্মৃতি, আত্মপরিচয়, স্থান, কাল সব। আবার ফিরে আসছেন। চোখ চাইছেন। সে এল কি? এরা কারা? বহুদূরের অস্পষ্ট ছায়াছবির মত এরা কারা?
অতি ক্ষীণভাবে ওদের স্বর যেন কানে আসছে। কী বলছে? কী?
–কী হচ্ছে? মশায় ঘাড় নাড়লেন, জানি না। ঘাড় নাড়তে নাড়তেই ক্লান্ত চোখের পাতা দুটি আবার নেমে এল। প্রদ্যোত দেখলে প্রগাঢ় একটি শান্তির ছায়া শীৰ্ণ মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে।
মশায় কী দেখলেন–প্রদ্যোত বুঝতে পারলে না।
সেই মুহূর্তেই আতর-বউ মশায়ের মুখখানি ধরে বললেন–ধ্যান সাঙ্গ হল? মাধবের চরণাশ্রয়ে শান্তি পেলে? আমি? আমাকে? আমাকে সঙ্গে নাও!
শান্ত আত্মসমর্পণের মত তিনি স্বামীর বিছানায় লুটিয়ে পড়লেন।