সেদিন মনের অবস্থা ছিল বিচিত্র।
মঞ্জরীকে দেখে বেরিয়ে যখন এসেছিলেন তখন তার বৃদ্ধ দেহের শিরায় উপশিরায় রক্তস্রোত দ্রুতবেগে বইছিল।
মন তখন এক বিচিত্র উপলব্ধির আস্বাদ অনুভব করেছে। সে এক আশ্চর্য উল্লাস!
তার ওপর হাসপাতালের ফটকে প্রদ্যোত তাকে বলেছিল—এই আপনাদের নিদান হকা? এ যে শিখতে ইচ্ছে করছে।
বাড়ি ফিরবার পথে মনে হয়েছিল—সেই অন্ধকারের মধ্যে তিনি আরণ্য গজের মত বেরিয়ে পড়েন মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে। জনহীন দিকহারা প্রান্তর খ খ করছে, অথবা গভীর নিবিড় মহা অরণ্য থমথম করছে; অসংখ্যকোটি ঝিল্লীর ঐকতান ধ্বনিত হচ্ছে; মৃত্যুর মহাশূন্যতার মধ্য দিয়ে জীবনপ্রবাহ চলেছে জন্ম থেকে জন্মান্তরে; সেইখানে উল্লাসধ্বনি করে সেই মহাগহ্বরে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন নবজন্মের আশায়। নিজের নাড়ি ধরে পথ হেঁটেছিলেন, কিন্তু আনন্দের আবেশে অনুভূতিযোগ স্থির হয় নি। বাড়িতে গিয়ে মরি বোষ্ট্রমিকে দেখে তারই সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন অভয়ার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে।
আতর-বউ বারণ করেছিলেন, কিন্তু শোনেন নি। শুধু তাই নয়, আতর-বউয়ের কথায় দুরন্ত ক্ৰোধে তিনি যে চিঙ্কার করেছিলেন সে চিৎকার আজও মশায়ের নিজের কানের পাশে বাজছে। জীবনে এমন চিৎকার তিনি কখনও কোনোদিন করেন নি।
আতর-বউই প্রথম ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন–এই বয়সে, এই রাত্রে নিমন্ত্রণ খেতে চলেছ! এমন অভর পেট তোমার; বনবিহারীকে খেয়ে ভরে নি?
মুহূর্তে প্রচণ্ড চিৎকারে রাত্রির আকাশ চমকে উঠেছিল—তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন–
আতর ব-উ–
মরি বোষ্টুমি চমকে উঠেছিল, সঙ্গের লোকটার হাত থেকে লণ্ঠনটা পড়ে দপ করে নিতে গিয়েছিল।
অভয়া অন্ধকারের মধ্যে দাওয়ার উপর তার প্রতীক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। সারাটা দিন নিরস্তু উপবাসিনী, কুশাগ্রে জল পর্যন্ত খায় নি। কালও অর্ধ উপবাস। নিজের ঘরের গাছের ফল আর মধু খেয়ে থাকবে। আগামী জন্মে পাবে অবৈধব্য ফল। যতদিন সে জীবিত থাকবে ততদিন মৃত্যু ওর স্বামীর সান্নিধ্যে আসতে পারবে না। সাক্ষাৎ মৃত্যুবই ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও মৃত্যুকে ফিরে যেতে হবে অভয়ার এ জন্মের এই ব্ৰতচারণের পুণ্যফলের প্রভাবে। সাবিত্রী করেছিলেন এই ব্ৰত। সত্যবানের প্রাণ গ্রহণ করে মৃত্যুর অধিপতি চলেছিলেন মৃত্যুপুরীর মুখে। অপার্থিব পথ অপার্থিব রহস্যলোক সেখানে। পার্থিব দৃষ্টি সেখানে অন্ধ। কিন্তু এই ব্ৰতপালনের পুণ্যে সাবিত্রী মৃত্যুপতিকে অনুসরণ করেছিলেন; এই পুণ্যবলে মৃত্যুপতিকে পরাভূত করে ফিরিয়ে এনেছিলেন স্বামীর জীবন। সাবিত্রীর কাহিনী সত্য কি না, এই ব্ৰত করে আজও এমন ভাগ্য হয়েছে কারও কি হয় নি, এ বিচার কেউ করে না; আবহমান কাল গভীর বিশ্বাসে এই ব্ৰত করে এসেছে। এদেশের মেয়েরা। অভয়ার উপবাসশীর্ণ মুখে সে বিশ্বাসের গাঢ়তম ছাপ দেখেছিলেন। তাঁকে দেখে অভয়ার মুখে শুক্লা প্রতিপদের ক্ষীণ চন্দ্ৰলেখার মত একটি বিশীর্ণ হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল। সে দেখে মশায়ের মন থেকে ক্রোধের অস্বস্তির রেশ নিঃশেষে মুছে গিয়েছিল, আশ্বিনের পূর্ণিমার নির্মেঘ আকাশের মত সারা মনটা ঝলমল করে উঠেছিল। মনে মনে বলেছিলেন চিকিৎসক হিসেবে আমি জানি, মৃত্যু পাপের বিচার করে না, পুণ্যের করে না; সে আসে ক্ষয়ের পথে, ক্ষয় যেখানে প্রবল সেখানে সে অপরাজেয়, সে ধ্রুব! তবু আজ আমি বার বার আশীর্বাদ করছি, এ সত্য হোক, পরজন্মে তোমার স্বামীর জীবনে ক্ষয় প্রবল হলেও যেন তোমার পুণ্যবলের কাছে মৃত্যু হার মানে।
তাঁর সামনে খাবারের থালা নামিয়ে দিয়ে অভয়া বলেছিল—আমার এ অনেক দিনের সাধ। প্রতিবার সাবিত্রীব্রতের সময় মনে হয়েছে ব্রাহ্মণভোজন করিয়ে পূর্ণ হল না। আপনি খেলে তবে পূর্ণ হয়।
হেসে তিনি বলেছিলেন–পূর্ণ হোক মা এবার।
—আপনাকে কী দেব বলুনঃ আপনি তো রাত্রে শুনেছি দুধ আর ফল বা খই, এ ছাড়া খান না। তাই দি? দুধ, আম, কলা, এইসব আর মিষ্টি।
—তুমি যা দেবে মা, তাই খাব। তাই অমৃত।
–একখানা লুচি? একটু ঝোল? একটু তরকারি?
–যা তুমি নিজে হাতে রান্না করেছ তাই দাও।
সত্যই অমৃতের মত মনে হয়েছিল। দীর্ঘদিন এমন প্রসন্ন রুচির সঙ্গে খান নি তিনি। খেয়ে উঠে মনে হয়েছিল খাওয়ার পরিমাণ যেন বেশি হয়ে গেল।
শেষত্রে এইটুকু ছিদ্রপথে তার দূত এসে বুকের উপর চেপে বসল। বুকের মধ্যে মনে হল পাষাণভার চেপেছে; হৃৎপিণ্ড পরিত্রাহি আক্ষেপে মাথা কুটতে লাগল; মস্তিষ্কের স্নায়ু শিরা আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল, অনুভূতি একটা বিরাট শূন্যতার মধ্যে হারিয়ে গেল, শুধু জৈবিক অনুভবশক্তিটুকু নিজেকে প্রবুদ্ধ করে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল, যন্ত্ৰণাকাতর চিৎকার! একটা গোঙানি।
আতর-বউ ঘুমান নি। মনের আক্ষেপে সারাটা রাত্রিই তিনি চোখের জল ফেলেছেন। নিঃশব্দে। মুহূর্তে তিনি উঠে আলোটা জোর করে দিয়ে তাঁর শিয়রে এসে বসেছিলেন। চিকিৎসকের পুত্রবধূ, চিকিৎসকের গৃহিণী, ছেলেও চিকিৎসক হয়েছিল, আতর-বউ বুকের উপর আছাড় খেয়ে পড়েন নি, বিহ্বল হয়ে কান্নাকাটি করেন নি; মাথায় মুখে চোখে জল দিয়ে বাতাস করে শুশ্রুষা করেছিলেন। অর্থহীন বিস্ফারিত দৃষ্টিতে মশায় তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
আতর-বউ ইন্দ্রকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন কিশোর এবং বিনয়ের কাছে, সেতাবকেও সংবাদ পাঠিয়েছিলেন। কিশোর এবং বিনয়ই সংবাদ দিয়েছিল হরেনকে এবং প্রদ্যোতকে। তারা যখন এসেছিল তখন মশায় খানিকটা সুস্থ হয়েছেন।