বৃদ্ধা বললেন– আপনি জীবনমশায়? নবগ্রাম দেবীপুরের জীবন দত্ত? আমি মঞ্জরী। কাঁদীর বঙ্কিমের বোন, মাস্টার নবকৃষ্ণ সিংহীর মেয়ে।
একটু হেসে মশায় বললেন– হ্যাঁ। শুনেই চিনেছি আমি। অনেক কালের কথা, আবছা আবছা মনে পড়ে।
–ঠিক বলেছেন। আবছা আবছা। সব ঝাপসা। এখানে এসে শুনি জীবনমশায়, জীবনমশায়। নবগ্রাম। মনে হয় চেনা-চেনা। নাম শোনা। তারপরেতে, আপনার কথা শুনে–ওই ঝোঁক দিয়ে কথা বলা শুনে মনে হল আপনিই তিনি। তাঁরাও তো মশায় ছিলেন। বাড়িও নবগ্রাম ছিল। তা মাথার গোলমাল তো, এই মনে পড়ে, আবার গোলমাল হয়ে যায়। শেষে বলি, তিনিই হোন আর যিনিই হোন, এত বড় বৈদ্যহাতটা দেখাই না কেন—যদি ভাল হই!
মশায় নীরবে উঠে বেরিয়ে এলেন।
হাসপাতাল থেকেই বেরিয়ে এলেন তিনি। প্রদ্যোত ডাক্তার ফটকের মুখ পর্যন্ত এসেছিল, সে বললে, মশায়, এই আপনাদের নিদান হাঁকা?
জীবনমশায় শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তার দিকে, কথাটা তাঁর মাথায় ঢুকল না। প্রদ্যোত বললে—এ আপনার কাছে আমার শিখতে ইচ্ছে করছে।
মশায়ের মনের মধ্যে ঘুরছিল সেই পিঙ্গলবৰ্ণা কন্যার কথা। পিঙ্গলবর্ণা, পিঙ্গলকেশিনী, পিঙ্গলচক্ষু কন্যা–কৌষেয়বাসিনী, সর্বাঙ্গে পদ্মবীজের ভূষণ; অন্ধ বধির! অহরহই সে সঙ্গে রয়েছে, কায়ার সঙ্গে ছায়ার মত। শ্রমের সঙ্গে বিশ্রামের মত, শব্দের সঙ্গে স্তব্ধতার মত; সঙ্গীতের সঙ্গে সমাপ্তির মত; গতির সঙ্গে পতনের মত; চেতনার সঙ্গে নিদ্রার মত। মৃত্যুদূত তার কাছে পৌঁছে দেয়, অন্ধবধির কন্যা, অমৃতস্পৰ্শ বুলিয়ে দেন তার সর্বাঙ্গে। অনন্ত অলান্ত শান্তিতে জীবন জুড়িয়ে যায়। তেমনি করে জুড়িয়ে যায় যেন মঞ্জরী। মৃত্যুদূত সে যেন আসে ভূপীর রূপ ধরে।
পরমানন্দ মাধব! তোমার মাধুরীতে সৃষ্টিতে ছড়ানো মধু, মৃত্যুর মধ্যে অমৃত।
নিজের হাতখানা ধরলেন। রক্তস্রোত আজ দ্রুত চলেছে, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বেড়েছে। দেহের রোমকূপের মুখগুলি স্বেদাক্ত হয়ে উঠেছে। দীর্ঘকাল এমন উত্তেজনা তিনি অনুভব করেন নি। তিনি কী—তাঁর কী? কিন্তু তাঁর মৃত্যুদৃত কোন্ রূপে আসবে? মঞ্জরী নয়। মঞ্জরী জীবনে ভ্রান্তি। মিথ্যা। আতর-বউয়ের রূপে? তাঁর বাবা জগৎ মশায়ের রূপ ধরে? গুরু রঙলালের মূর্তিতে? অথবা নীরন্ধ্র অন্ধকারের মধ্যে মিশিয়ে সে থাকবে–তাকে দেখা যাবে না? সে বনবিহারী?
–কে? আরোগ্য-নিকেতনের সামনে এসে পড়েছিলেন তিনি। একটি আলো জ্বলছে।
–কে বসে রয়েছে! ভ্রূ কুঞ্চিত করে তিনি প্রশ্ন করলেন–কে?
–মশায় বাবা! আমি প্ৰভু, আমি মরি।
মরি বোষ্টুমি! এত রাত্রে?–কী রে মরি?
আজ যে সাবিত্রীচতুর্দশী বাবা! অভয়া মা বললেন–কৃষাণ মান্দেরকে কী করে পাঠাব মরি? ওদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে তুমি যাও।
আজ সাবিত্রীচতুর্দশী! একদিন বৈধব্যের দুঃখ কল্পনা করে তিনি বাপের মত স্নেহে অভয়াকে খাইয়েছিলেন, সে তাকে অভিসম্পাত দিয়েছিল। আজ অবৈধব্য ব্ৰত উপলক্ষে তাকে খাওয়াবে। কন্যার মত শ্রদ্ধা করেই নিমন্ত্রণ করেছে।
কুঞ্চিত করে তির্যক ভঙ্গিতে সেই অন্ধকারের মধ্যেই তিনি তাকালেন একবার। বোধ করি নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলেন। আর-একবার বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের মণিবন্ধ চেপে ধরলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দিলেন। বললেন–চল।
৩৮. শেষ
চার মাস পর।
উনিশশো একান্ন সালের সেপ্টেম্বর মাস। আশ্বিন সন্ধ্যা। প্রদ্যোত ডাক্তার বাইরের বারান্দায় কলব্যাগ, ব্লাডপ্রেসার পরিমাপের যন্ত্র নিয়ে কলে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। পাশে ছোট টুলের উপর চায়ের কাপ নামানো।
মঞ্জু ঘর থেকে বেরিয়ে এল, সেও বাইরে যাবে বোধহয়। চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে সে বললে—এ কী, খেলে না চা?
—নাঃ। ভাল লাগল না।
–ভাল হয় নি? আমি তৈরি করে আনব?
–না, ভালই লাগছে না। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে প্রদ্যোত বললে—শেষটায় ভদ্রলোকের সঙ্গে এমন জড়িয়ে গেলাম! তোমার অসুখের সময় সাহায্য সব ডাক্তারেই করেছিলেন, কিন্তু মশায়ের সাহায্যের চেয়ে ভালবাসা বড়।
একটু চুপ করে বোধ করি ভেবে বললেওটা বোধহয় প্রবীণের ধর্ম। আমরা পারি না। বয়স না হলে হয় না। কিন্তু
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললে—কিন্তু তুমি আজই এলে, এই ঘণ্টাখানেক আগে ট্রেন থেকে নেমেছ, আজ তুমি না গেলেই পারতে। শরীর তোমার এখনও ঠিক সুস্থ হয় নি।
অসুখের পর মঞ্জুকে চেঞ্জে পাঠিয়েছিলেন। আজই মঞ্জু বিকেলের ট্রেনে ফিরেছে।
মশায়ের অসুখ; প্রদ্যোত দেখতে যাচ্ছে শুনে সেও যাবে বলে তৈরি হয়েছে। মশায়ের অসুখ; আজ চার মাসই তিনি অসুস্থ। মধ্যে মধ্যে শয্যাশায়ী হয়েছেন, আজ তিন দিন অসুখ বেশি। রোগ রক্তের চাপ, ব্লাডপ্রেসার আক্রমণ হৃৎপিণ্ডে; করোমারি থ্রম্বসিস।
মঞ্জু বললে–না-না। আমার কিছু হবে না। আমার শরীর ঠিক আছে।
–ঠিক আছে? হাসলে প্রদ্যোত—মনের ইমোশনে বোঝা যায় না। প্ৰথম অসুখের খবর পেয়ে যখন মশায়কে দেখতে গেলাম, তখন মশায় যন্ত্রণার মধ্যেও হেসে বলেছিলেন—স্নেহ, দয়া, ভালবাসা কোনো কিছুরই আতিশয্য সে ক্ষমা করে না ডাক্তারবাবু। পাপ পুণ্য যার জন্যেই হোক, জীবনের উপর পীড়ন করলেই সেই ছিদ্রে তার দূত এসে আশ্রয় নেয়। আমারও নিয়েছে। কাল খুব দূরে নয় ডাক্তারবাবু।
বাঁ হাতে নিজের ডান হাতের মণিবন্ধ ধরে নাড়ি অনুভব করে হেসে বলেছিলেন—মনে হচ্ছে, ঘামের বাইরে গ্রামে ঢুকবার মুখে সে পদার্পণ করেছে। গ্রামে ঢুকেছে।