—মঞ্জরী।
হাসপাতালের ডাক্তার বললেন–চিনতেন তাকে?
–চিনি, খুব চিনি। আপনার আপত্তি না থাকলে ওঁকে আমি দেখব!
–বেশ তো। আজই দেখবেন।
–ক্ষতি কী! দেখি।
প্রদ্যোত বললেন–বহু রোগ ওঁর শরীরে। স্বামীই দিয়ে গেছেন অনেক বিষ। বললাম তো তার কথা। আর আপনি জানেন বলছেন।
—জানি।
—তাঁর অমিতাচারের বিষ আছে রক্তে। নিজের রসনার ললাভের ফলে—স্টমাক-ইন্টেস্টাইন হয়েছে ব্যাধিগ্রস্ত, পুষ্টির অভাবে দেহকোষ হয়েছে দুর্বল। মনের অশান্তি–তাও ক্রিয়া করেছে। চোখ গেছে। কানেও একটু খাটো। কোলাইটিস লেগেই আছে, শীতে হাঁপানি হয়, শিরঃপীড়া আছে, মধ্যে মধ্যে জ্বর হয়। আশ্চর্য শক্ত দেহ, সব সহ্য করেই বেঁচে রয়েছেন। চুরি করে খান–।
থেমে গেল ডাক্তার। মনে হল আর বলা অন্যায় হবে।
মঞ্জরী চুরি করে খায়, চুরি করে গন্ধদ্রব্য মাখে, হাতে অনুভব করে যার হোক খরখরে দেখে পরিচ্ছন্ন বুঝে কাপড় টেনে নিয়ে পরে।
সেসব তথ্য একদিন ওঁদের কথাবার্তা থেকে জেনেছেন।
মশায় প্রদ্যোত ডাক্তারকে বললেন– চলুন।
প্রদ্যোত বলল—সেদিন ওঁকে আমি মতির মায়ের গল্প বলেছি। আপনি যা বলেছিলেন–তাও বলেছি, কিন্তু কাকে বললাম–কে শুনবে? বললেন– মঞ্জুর একটি ছেলে দেখি–তারপর ভাই, তারপর। আর মরলেই তো ফুরিয়ে গেল ভাই।
***
মঞ্জরীর সামনে দাঁড়িয়ে মশায় কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন; কপালে সারি সারি রেখা জেগে উঠল, চোখে ফুটে উঠল অদ্ভুত দৃষ্টি! পকেট থেকে চশমা বের করে চোখে পরলেন তিনি। ভাল করে দেখলেন। দূর থেকে কয়েকদিনই বৃদ্ধাকে দেখেছেন তিনি, আজ চশমা চোখে কাছ থেকে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলেন। পেলেন না কোথাও তার বিন্দুমাত্র অবশেষ নাই।
–দেখি আপনার হাতখানি।
জ্বর লেগেই আছে নাড়িতে। ব্যাধিজর্জর অভ্যন্তর। উদ্বেগকাতর চিত্ত নাড়ির স্পন্দনে স্পন্দনে বলছে। দেহকোষে-কোষে, আকাশের নক্ষত্রমালার মত যে জীবনশিখাগুলি অহরহ প্ৰাণদেবতার আরতি করে জ্বলে, প্রাণকে মধুময় উত্তাপে অভিষিক্ত করে জাগ্রত করে রাখে। জীবদেহে, সেগুলি স্তিমিতদ্যুতি, অনেকগুলি নিভেই গিয়েছে। প্রাণদেবতার চারিদিকে ছায়া জেগে উঠছে, ছায়ায় হিমস্পর্শ ছড়াচ্ছে; শেষ সীমারেখায় উপনীত হতে আর অল্প পথই বাকি। নাড়ির স্পন্দনে জাগে যে জীবনসঙ্গীত—তা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে বিলম্বিত ছন্দে সমাপ্তির অবিলম্বতা ঘোষণা করছে।
হাতখানি নামিয়ে রেখে বললেন–ও হাতখানি দেখি।
সেই একই কথা—একই ছন্দ একই ধ্বনি।
–কী দেখলেন গো? চোখ-কান পাব? ভাল করতে পারবেন?
–না।
–মাথার যন্ত্রণা? শিরঃপীড়া?
–ভাল হবে না, তবে এখন অনেক ভাল ওষুধ উঠেছে খাবেন, যন্ত্রণা কমে যাবে। আমি একটা টোটকা বলে দেব–ব্যবহার করলে কমবে খানিকটা, তবে একেবারে ভাল হবে না।
–পেটের গোলমাল?
–ওই তো আপনার আসল রোগ।
–ভাল করে দেন।
–ভাল?
–হ্যাঁ। মঞ্জুর একটি খোকা দেখি।
—জন্মান্তরে তো বিশ্বাস করেন। মঞ্জুর কোলে খুকি হয়ে আপনিই ফিরে আসবেন, সে তো আরও ভাল হবে।
একটু চুপ করে থেকে বৃদ্ধা বললেন–তা হলে এবারের মত যেতে বলছেন। আর বাঁচব না? কিন্তু! কিন্তু ভারি যে ভয় লাগে গো!
–ভয় কিসের? এ তো মুক্তি।
–মুক্তি?
–হ্যাঁ। তা ছাড়া আর কী? সেখানে আপনার স্বামী, মা, বাপ, ভাই, মেয়ে, জামাই আপনার জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছেন।
বৃদ্ধার মুখ প্রদীপ্ত হয়ে উঠল। দৃষ্টিহীন চোখে সামনের দিকে চেয়ে আত্মমগ্ন হয়ে বসে রইলেন।
মশায় উঠলেন। বৃদ্ধা সচেতন হয়ে উঠলেন চেয়ার ঠেলার শব্দে। বললেন–তা হলে আমাকে যেতে হবে বলছেন? কতদিনের মধ্যে যেতে হবে?
প্রদ্যোত ডাক্তারের অস্তিত্ব ভুলে গেলেন জীবনমশায়, নিদান সম্পর্কে তার আপত্তির কথাও তার মনে হল না, তিনি আবার একবার বসে-বৃদ্ধার হাতখানি ধরে ভাল করে দেখে বললেন, তিন মাস থেকে ছ মাস। এর মধ্যেই মুক্তি পাবেন আপনি। তবে একালের ওষুধ খেলে হয়ত আরও কিছুদিন দুর্ভোগ ভোগ করতে হবে। একালের ওষুধ বড় শক্তিশালী।
–নাঃ। তা আর খাব না। আপনি আমাকে ভাল কথা মনে করে দিয়েছেন–তিনি আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছেন। যত শিগগির মুক্তি আসে ততই ভাল। এই কথাটি কেউ এমন করে আমাকে বলে নাই। ওঃ, কতকাল তারা আমার পথ চেয়ে আছে। আর আমি–।
বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর কাঁপতে লাগল। দৃষ্টিহীন চোখ দুটি নির্নিমেষ হয়ে গেল। এবার জল গড়াবে।
চোখ ফিরিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে গিয়ে তিনি চমকে গেলেন; সামনের আয়নাতে তাঁর নিজের প্রতিবিম্ব পড়েছে। শুভ্ৰ কেশ, রেখাঙ্কিত ললাট, পাণ্ডুর মুখ, এক স্থবির দাঁড়িয়ে আছে। মনে পড়ে গেল একটি কথা। তাঁর বাবার কথা বলেছিলেন জন্মমাত্রেই মৃত্যু সঙ্গ নেয়; দিনে দিনে সে বাড়ে, সেই বৃদ্ধির মধ্যেই সে তার ক্ষয়ের ক্রিয়া করে যায়, ঠেলে নিয়ে যায় তার পথে; জীবন-যুদ্ধ করে মানুষ যেদিন ক্লান্ত হয়—সেদিন আসে জরা, তারপর আসে শেষ। বলতে গেলে আজকের আমি জন্মাই সূর্যোদয়ে, মরি নিদ্রার সঙ্গে দিনান্তে রাত্রির অন্ধকারে, আবার জন্যই নূতন প্রভাতে জন্মান্তরে।
প্রদ্যোত ডাক্তার মশায়ের এই নিবিষ্ট একাগ্র দৃষ্টিতে দেখা দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। চেয়ারখানা একটু সরিয়ে দিয়ে বলল—বসুন।
মশায়ের রুদ্ধ দীর্ঘনিশ্বাসটি এতক্ষণে ঝরে পড়ল। তিনি মুখ ফিরিয়ে চেয়ারখানা দেখে নিয়ে বললেন– কী কষ্ট আপনার?