-কী? কী বলছেন? ডাক্তার শুনতে পেয়েছেন কথাগুলি। বারান্দায় উঠেই থমকে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। এ অবস্থায় মঞ্জুর মায়েরও দিদিমাকে সাবধান করার উপায় ছিল না। ডাক্তারের মন পরম প্রসন্নতায় ভরা। তিনি হেসেই উত্তর দিলেন–নিশ্চয়; কথা বলব বৈকি। আপনি গুরুজন। তবে মঞ্জুর অসুখ নিয়ে
—হ্যাঁ–হ্যাঁ ভাই। তা বটে। যে লজ্জা, যে ভয় হয়েছিল আমার। ভেবেছি—কেন এলাম? আমি সর্বস্বখাগী। স্বামী খেয়েছি, তাকে খেয়ে গেলাম মেয়ের ঘরে, সেখানে মেয়েকে খেলাম। তোমার শাশুড়িকে মানুষ করলাম—সেই জামাইয়ের ঘর, তার অন্ন খেয়ে। মেয়ের সতীন এল–তার কথা শুনে সেখানে রইলাম; তারপর ধরার বিয়ে হল। ধরার বাড়ি এলাম, ধরা বিধবা হল। আবার এখানে–এখানে কেন এলাম? তা যার জন্যে এসেছি—সে জান তো? আমার চোখ দুটি ভাল করে দাও। বড় ডাক্তার তুমি!
–আচ্ছা, আচ্ছা। কালই আমি ওষুধ দোব।
–ওষুধ নয়, অপারেশন করে দাও।
–অপারেশন কি হবে? ছানি তো না!
–উঁহুঁ, অপারেশন না করলে ভাল হবে না। অপারেশন করলেই ভাল হবে। কতজনের। ভাল হল।
–আচ্ছা, দেখব কাল ভাল করে। তা হলে আমি বাইরে যাই। আপনার কোনো কষ্টটষ্ট হচ্ছে না তো?
–হচ্ছে ভাই। মাথায় একটু ভাল তেল চাই। আর কাপড়গুলি বড় পুরনো হয়েছে।
ঘরের ভিতর থেকে ডাক্তারের লজ্জিতা শাশুড়ি বললেন–করবে কী? উপায় কী বল? কাপড়ের কন্ট্রোল-বিশ্বযুদ্ধ লোক কাপড়ের অভাবে ছেঁড়া পরে দিন কাটাচ্ছে।
–তা বটে, তা বটে ভাই। তবু মঞ্জুর দুখানা আধপুরনো শাড়ি দিস। তাই পরব।
মঞ্জু হেসে উঠল।–রঙিন ড়ুরে শাড়ি–
—তাই পরব। তবু ছেঁড়া ন্যাকড়ার মত কাপড় পরতে পারি না।
ডাক্তার বারান্দায় জীবন মশায়কে দেখে একটু লজ্জা পেলেন। তাঁর মনেই ছিল না জীবন মশায়ের অস্তিত্বের কথা। মনের উল্লাসে ভুলেই গেছেন।
–আমার দেরি হয়ে গেল মশায়।
–তা হোক।
–ও ভাই–ও মঞ্জুর বর! শুনছ!
কী বিপদ! প্রদ্যোত ডাক্তার এবার বিরক্ত হয়ে উঠল। হয়ত বা ওই মহিলাটির কথা জীবনমশায় শুনেছেন বুঝে মনে মনে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। মহিলাটির উপর তো বটেই—হয়ত জীবন মশায়ের উপরেও বিরক্ত হয়েছে। জীবন মশায়ের শোনা উচিত হয় নি, চলে যাওয়া উচিত ছিল।
জীবনমশায় বললেন–আমি আজ যাই।
—বসবেন না একটু?
–না, আবার কাল আসব।
–আচ্ছা। মঞ্জু যেদিন পথ্য পাবে সেদিন একটা খাওয়াদাওয়া করব।
–বেশ তো।
–পথ্যের দিন নির্ণয় কিন্তু আপনি করবেন। ক্লোরোমাইসেটিনে জ্বর ছাড়ে, কিন্তু আবার রিল্যান্স করার একটা ভয় আছে। আপনি যেদিন বলবেন নাড়ি নির্দোষ হয়েছে–এবার পথ্য দেওয়া যেতে পারে, তখন দেব। রক্তদাস্ত যখন হয়েছে, তখন ইনটেস্টাইনে পারফোরেশন হয়েছে নিশ্চয়। পথ্য খুব হিসেব করে দিতে হবে।
ওদিকে সরিক্ত দীনাতিদীন মহিলাটি ডেকেই চলেছেন—অ-ভাই! শুনছ! একটু অপেক্ষা করে আবার ডাকছেন—মঞ্জুর বর! আবার ডাকছেন-অ-ডাক্তার সায়েব!
মঞ্জুর মা একবার চাপা গলায় বললেন–থাম দিদিমা। কথা বলছেন জামাই মশায়ের সঙ্গে।
—মশায়ের সঙ্গে? সে কে?
–যিনি খুব ভাল নাড়ি দেখেন, এখানকার প্রবীণ বৈদ্য। চুপ করলেন মঞ্জুর মা।
–তা। বলেই স্তব্ধ হয়ে যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন বৃদ্ধা।
কয়েক মুহূর্ত পর হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠলেন এবং ডাকলেন—ধরা, কথা শেষ হল? আমি একটি কথা বলছিলাম।
এবার প্রদ্যোত ডাক্তার বোধহয় ক্ষেপে উঠবে। মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে—বলেছি তত কাল চোখ কেটে দেব। যা হয় হবে আপনার।
–না। তা বলি নি ভাই।
–তবে? কাপড়? তাও এনে দেব।
–না–না।
–তবে কী?
–ওই যে মশায় না কী যিনি নাড়ি দেখেন ভাল—
–হ্যাঁ—তিনি কী করবেন? তিনি তো অপারেশন করেন না!
–না—না। তাঁকে একবার হাত দেখাব।
–হাতে কী হল আবার? বেশ তো শক্ত রয়েছেন। এখন তো কোনো অসুখ নেই।
—অসুখ অনেক আমার, তোমরা ধরতে পার না। ওইসব পুরনো লোকে ঠিক ধরতে পারবে। তুমি ওকে বলেই দেখ না। তোমাদের কাছে তো আমি নগণ্য লোক। ওকে বল–কাদীর জমিদার অমুক বোসের স্ত্রী। অমুক বোসকে চেনে না—এমন লোক এ চাকলায় নাই। তা ছাড়া এসব তো আমাদেরই জমিদারি ছিল গো। বলে দেখ, কত খাতির করে দেখবে। তা ছাড়া আমার বাবার।
প্রদ্যোত এবার ধৈর্য হারিয়ে সত্য সত্যই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, কিন্তু কী বলবে খুঁজে পেলে না।—মশায় বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।
মঞ্জুর মা বৃদ্ধার হাত ধরে চাপ দিয়ে বললে—দিদিমা–চুপ কর। দিদিমা!
মশায় বাইরে থেকে ডাকলেন–প্রদ্যোতবাবু!
প্রদ্যোত বেরিয়ে এল, এবং সর্বাগ্রে হাতজোড় করে বললে–আপনি কিছু মনে করবেন না ওঁর কথায়। উনি সেই সেকালের জমিদারের বউ। মাথা খারাপ হয়ে গেছে–
হেসে বাধা দিয়ে মশায় বললেন—না–না-না। আপনি এমন সঙ্কুচিত হচ্ছেন কেন? উনি হাত দেখাতে চাচ্ছেন–চলুন হাত দেখি। দেখলেই তো খুশি হবেন। কাঁদীর কাদের বাড়ির বউ? কার স্ত্রী?
–ভূপেন বোস। লোকে বলত ভূপী বোস। যত অমিতাচারী তত অমিতব্যয়ী—সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন, তবু মদ ছাড়তে পারেন নি।
–হাত দেখাব, শুনেছি নাকি হাত দেখে নিদান হাঁকতে পারেন। কবে মরব, সেইটে জানব। তুমি ওঁকে বল, মঞ্জরী–মঞ্জরীর হাত দেখতে হবে। ওঁর মাস্টারের মেয়ে মঞ্জরী আমি। কাঁদীর অমুক বোসের স্ত্রী মঞ্জরী। উনি চিনবেন।
জ্যৈষ্ঠ রাত্রির রুক্ষ নির্মেঘ নক্ষত্র-ঝলমল আকাশ অকস্মাৎ কোমল নীলাভ দীপ্তিতে ভরে গিয়ে একটা উল্কা খসে গেল বুঝি। জীবনমশায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।