পরমানন্দ মাধব! পরমানন্দ মাধব হে! পরমানন্দ–! কলিটা অসমাপ্ত রেখেই ডাক্তার একসঙ্গে হাসলেন এবং দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।
পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ সুখীদের মধ্যে এই লোকটি একজন। ওই মেয়েটিকে সে জীবন ভরে পেয়েছে। ছেলেটি আর মেয়েটিতে মিলে মানস সরোবর।
কিশোর সেদিন বলেছিল—এই পাওয়াই শ্ৰেষ্ঠ পাওয়া। এ পাওয়া যে পায় তার সব পাওয়া হয়ে যায় ডাক্তারবাবু। সৃষ্টি হয় মানস সরোবরের।
কিশোরকে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন বিয়ে করছ শুনলাম, কিন্তু কী হল?
সে বলেছিল–ভয় হল মশায়!
–বিয়ে করলে বউ পাওয়া যায় মশায়, কিন্তু যা পাওয়ার জন্যে বিয়ে করে মানুষ–তা পাওয়া যায় না। নারী আর প্রকৃতি ও দুই সত্যই এক। দুদিন পরেই বুকে পা দিয়ে দলে আপনার পথে চলে যায়। কখনও নিজের মুণ্ড কেটে নিজেই রক্তস্নান করে, কখনও নিজে স্বামীকে গ্রাস করে ধূমাবতী সাজে, কখনও আবার নিজের বাপের মুখে স্বামীনিন্দা শুনে দেহত্যাগ করে। কদাচিৎ পুরুষের প্রেমে পূর্ণ পরিতৃপ্তিতে শান্ত অঞ্চল হয়ে ধরা দেয়। যাদের ভাগ্যে এই পাওয়া ঘটে, তাদের আর কিছু প্রয়োজন নাই। প্রতিষ্ঠা প্রশংসা সাম্রাজ্য—এমনকি মুক্তিও না। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর নাই। এ কেউ পায় না। ভয়ে পা বাড়িয়ে পিছিয়ে নিলাম। কে জানে–কী ফাঁকি আছে আমাদের দুজনের মধ্যে। ফাঁক থাকলে তো রক্ষে নাই। নারী তখন নদীর মত ছুটবে আর আমি তীরের মত বাহু বাড়িয়ে সাগরের কূল পর্যন্ত ছুটেও তাকে পাব না। ও থাকে বাহুবন্ধনের মধ্যে, ধরা পড়লেই ওরা মানস সরোবর।
কথাটা সত্য। ভুল নাই। মনে মনে বার বার বললেন– জীবনমশায়। হাসপাতালের ডাক্তারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, সন্ধ্যাবেলায় আরও ভাল করে এই সত্যটি অনুভব করলেন। সন্ধ্যার দিকে রোগিণীর জ্বর ধীরে ধীরে ছেড়ে এসেছে এখন।
সীতা স্মিতমুখ ডাক্তার-গৃহিণীর মুখখানি মুছিয়ে দিয়ে বললে—যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।
-–তোমায় খুব খাটতে হয়েছে, না? শীর্ণ হাসি ফুটে উঠল ডাক্তারের বউয়ের মুখে!
ডাক্তার ছেলেমানুষের মত ছুটে গিয়ে কম্পাউন্ডারকে বলে এলেন। নার্সদের ওদিকে। গেলেন। হাসপাতালের রান্নাশালায় ঝাড়ুদার মতিয়া জমাদারকে বলে এলেনওরে জ্বর ছেড়ে গেছে। জীবন মশায়ের উপস্থিতিও ভুলে গেছেন ডাক্তার।
রোগীর ঘরে ডাক্তারের শাশুড়ি প্রবেশ করলেন-যে ভয় তুই ধরিয়েছিলি মঞ্জু! সে কী বলব!
—কে জানে! তিন-চার দিনের কথা আমার কিছুই মনে নেই।
—থাকবে কী? একেবারে বেশ। মা–মা বলে চেঁচিয়েছি, আমি ডাকলাম—এই যে আমি। তা একবার ফিরেও তাকালি না।
—তুমি কবে কখন এসেছ—আমি কিছুই জানি না।
—তোর এই অবস্থা, ওদিকে জামাইয়ের সে কী মুখ! মুখ দেখে আমার কান্না উপে গেল। মনে হল, মঞ্জুর যদি কিছু হয় তবে জামাই আমার পাগল হয়ে যাবে।
–পাগল হত না। তবে সন্ন্যাসী হত, নয়ত আত্মহত্যা করত।
জীবনমশায় বারান্দায় দাঁড়িয়েই মনশ্চক্ষে দেখলেন—রোগিণীর শীর্ণ ক্লান্ত শুষ্ক অধরে স্মিত হাস্যরেখা ফুটে উঠেছে, কৃষ্ণাচতুর্দশীর শেষরাত্রের এককলা চন্দ্ৰোদয়ের মত সে হাসির রূপ। এবং মেয়েটি এই হাসিতে কোনো লজ্জা অনুভব করছে না। সগৌরবে পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে পুষ্পবিকাশের মতই অকুণ্ঠ প্ৰকাশে হাসিমুখে বিকশিত হয়ে উঠেছে।
পরমানন্দ মাধব হে!
ডাক্তার ফিরছেন। পদক্ষেপে উল্লাস ফুটে উঠছে।
—ধরা! ধরিত্রী! শুনছিস?
ডাক্তারের শাশুড়িকে ডাকছেন তার সঙ্গের সেই মেয়েটি। এই কদিনই এই কণ্ঠস্বর তিনি শুনেছেন। ভিতরের দিকে বারান্দা থেকে এই ডাক ডাকেন। আবছা চোখে পড়েছে একটি দীর্ঘাঙ্গী প্ৰৌঢ়া বিধবা শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে চুপ করে বসে থাকেন। গালে একটি হাত, মাটির উপরে একটি হাত, বসেই থাকেন। মধ্যে মধ্যে ডাকেন—ধরা, ধরিত্রী।
এদিক থেকে সাড়া দিত না কেউ—রোগীর শিয়রে বসে সাড়াই বা দেবে কী করে? চুপ করে যেতেন ভদ্রমহিলা। মহিলাটিকে দেখে মনে হয় একদিন জীবনে তাঁর জীবন-মহিমা ছিল। কিছুক্ষণ পর আবার ডাকতেন—ধরা! ধরিত্রী! অ-ধরিত্রী! হা লা, মেয়ে তোর রয়েছে কেমন? বল্? ঘরে ঢুকতে বারণ করেছিস–ঢুকি নে। তবু খবরটা বল!
সাড়া এতেই বা কে দেবে? তিনি চুপ করতেন।
আজও সেই তিনিই ডাকছেন। সেই ডাক। আজ ধরিত্রী সাড়া দিলেন-–বল! কী চাই?
কী চাইব? হ্যাঁ লা তুই নাতনী–মেয়ের মেয়ে, মঞ্জু তোর মেয়ে, তার এখানে এসেছি–সেই তো বড় লজ্জা! এর পর আবার চাইব কী?
—তবে? কী বলছ?
—বলছি, মঞ্জু তো ভাল রয়েছে—একবার যাই না ওঘরে, ওকে দেখি! চোখে তো দেখব না, একবার মুখে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।
–একটু ওডিকলন মাখাব না? এ কণ্ঠস্বর মঞ্জুর। সে হেসে উঠল, দুর্বল কিন্তু সশব্দ হাসি।
—তা ভাই দিস যদি মাখব। কদিন এখানে এসেছি–মাথায় তেল দিই নি। নারকেল তেল দেয় নামিয়ে। ও তো ভাই মাখতে পারি নে, কী করব। রুক্ষু মাথাতেই চান করি। ওডিকলন নয়, একটু গন্ধতেল দিস।
—চুপ কর, জামাই আসছেন—দিদিমা, চুপ কর।
ডাক্তার আসছেন—মঞ্জুর মা দেখতে পেয়েছেন। তিনি সতর্ক করে দিচ্ছেন বৃদ্ধাকে।
একটু বেদনা অনুভব না করে পারলেন না জীবনমশায়।
-কই তোর জামাই, কই? একবার ডেকে দে না আমার কাছে। আমি আজ না হয় পথের ধুলোর অধম হয়েছি, ঘরে গেলে ঘর নোংরা হয়; ছুঁলে হাত ময়লা হয়। কিন্তু চিরদিন তো এমন ছিলাম না! আমারও রূপ যৌবন ছিল। আদর সম্ভ্রম ছিল। তার ওপর আমি মঞ্জুর মায়ের মা। সেদিক থেকেও তো আমার সঙ্গে কথা বলতে হয়!