প্রদ্যোত ডাক্তার ডাকলে—মঞ্জু! মঞ্জু! হাঁ কর। ট্যাবলেট।
সীতা জল তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে মুখে জল ঢেলে দিলে। চারুবাবু ক্যাপসুলটা মুখে ফেলে দিলেন।
সন্ধ্যায় আবার গেলেন জীবনমশায়। নাড়ি ধরে দেখলেন জ্বর বেড়েছে। আজ বোধহয় সাড়ে চার–মাথার শিয়রে বসে আছে আজ অন্য নার্স। সীতাকে বোধহয় ছুটি দিয়েছে।
পরদিন সকালেও জ্বর কমল না। আগের দিনের থেকে বেশি।
রোগীর আচ্ছন্নতাও বেশি। পেটের ফাঁপ বেশি।
তৃতীয় দিন। আজ জ্বর উপশম হওয়ার কথা। ছাড়ার কথা। কিন্তু কোথায়? মশায় গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কই, ভেষজের ক্রিয়া কই?
হাসপাতালের ডাক্তার–চারুবাবু, হরেন সকলেই চিন্তিত হয়ে উঠলেন—তাই তো! তবে কি?
জীবনমশায় দৃঢ়স্বরে বললেন–রোগ টাইফয়েড। নাড়িতে রোগ অত্যন্ত প্রবল। এইটুকু আমি বলতে পারি।
প্রৌঢ় চারুবাবু অল্পেতেই ভড়কান, এবং অল্পেই উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। তিনি দমে গেছেন।–তাই তো। সংসারে মুনিরও মতিভ্ৰম হয় যে!
জীবনমশায় দৃঢ়ভাবে ঘাড় নাড়লেন–না। ভ্ৰম তার হয় নি।
প্রদ্যোত ডাক্তারের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল। বললে—আবার ক্লোরোমাইসেটিন দিন চারুবাবু। নিজের হাতে খুললে শিশি। তুলে দিলে তাঁর হাতে।
সন্ধ্যায় জীবনমশায় দেখলেন প্রদ্যোত ডাক্তার বারান্দায় দু হাতে দুটো রগ ধরে বসে আছে। রোগিণীর মাথার শিয়রে বসে সীতা। সীতাই বললে–রক্তদাস্ত হয়েছে। জ্বর সমান।
জীবনমশায় আজ নিজেই ঘরে ঢুকে রোগীর পাশে বসে হাত তুলে নিলেন। বেরিয়ে এসে প্রদ্যোতের কাঁধের উপর হাত রাখলেন।
প্রদ্যোত মুখ তুললে–মশায়?
–হ্যাঁ। আপনি মুষড়ে পড়বেন না। রক্তদাস্ত হোক। এ রোগে ও তো হয়। এবং হয়েও বাঁচে। রোগীর নাড়ি আমি ভাল দেখলাম। ত্ৰিদোষপ্রকোপের মাত্রা কমেছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন—আমার ভুল হয় নি।
ডাক্তার স্থির দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। জীবনমশায় বললেন– আমি আপনাকে মিথ্যা প্ৰবোধ দিই নি। দীর্ঘক্ষণ বসে রইলেন তিনি।
স্টেশন থেকে একখানা গরুর গাড়ি এসে ঢুকল। দুটি মহিলা নামলেন। দুজনেই বিধবা, একজন অতিবৃদ্ধা। ডাক্তার এগিয়ে গেল।–মা!
—মঞ্জু কেমন আছে বাবা?
—অসুখেই আছে। কিন্তু—ওঁকে আনলেন কেন? ডাক্তার বিরক্ত হয়েছেন। বৃদ্ধাকে লক্ষ্য করে কথাটা বললেন।
—কোথায় ফেলে দেব বাবা? ও তো আমায় ছাড়বে না।
–কিন্তু কোথায় ওঁকে রাখি? কী করি?
–একপাশে থাকবে পড়ে। এখন আর উপদ্রব করে না। কেমন হয়ে গেছে কিছুদিন থেকে। চুপ করেই থাকে। নইলে আনতাম না।
—আসুন।
জীবন মশায়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন–বসুন ডাক্তারবাবু, যাবেন না। আমি আসছি। ইনিই আমার শাশুড়ির সেই দিদিমা। এই রোগের ঝঞ্ঝাটের উপর উনি হবেন বড় ঝঞ্ঝাট।
বসে রইলেন জীবন ডাক্তার।
বৈশাখের আকাশ। গতকাল দুপুরের দিকে সামান্য একটু ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। আকাশে আজ ধূলিমালিন্য নাই। নক্ষত্রমালা আজ ঝলমল করছে। সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন জীবনমশায়। এমন অবস্থায় মন যেন ফাঁকা হয়ে যায়। কোনো কিছুতে দৃষ্টি আবদ্ধ করে না। রাখলে মন ছুটতে শুরু করবে। কী করলে কী হবে? হাজার প্রশ্ন জাগবে। কোথায় কী হল? কোন ত্রুটি? জীবন হাঁপিয়ে উঠবে। ছুটতে পারে না তবু ছুটবে—ছুটতে হবে।
আকাশের ঝলমলানির মধ্যে মন হারিয়ে যাবার সুযোগ পেয়ে বেঁচেছে।
–মাঃ! মাঃ!
–এই যে মা! মঞ্জু! আমি এসেছি মা।
–মাঃ!
–কী বলছিস? কোথায় যন্ত্রণা? কী হচ্ছে? মঞ্জু?
–আঁঃ! মাঃ!
–কী বলছিস?
–বাবাঃ! আঁ!
জীবনমশায় হাসলেন।
মা! মা বলছেন—এই যে আমি। তবু রোগী ডাকছে—হয়ত বা পাশ ফিরে শুয়ে ডাকছে–মা মা! সুদীর্ঘ চিকিৎসকের জীবনে এ কত দেখে এলেন। হায় রে মানুষ! সে মা কি তুমি? সে মা—আরোগ্যরূপিণী যিনি—তিনি। তাঁর সর্বাঙ্গে অমৃতোর স্পর্শে স্নিগ্ধ হবে রোগীর দেহের রোগজর্জরতা; উত্তাপ কমে আসবে; অশান্ত অধীরতা শান্ত হয়ে আসবে; আচ্ছন্নতার ঘোর কাটিয়ে জাগবে চৈতন্য; জীবকোষে-কোষে জীবনবহ্নির দাবদাহের প্রজ্বলন সংবৃত হয়ে স্নিগ্ধ হয়ে জ্বলবে প্রদীপের মত। সকলযন্ত্রণাহরা সর্বসন্তাপহরা আরোগ্যরূপিণী তিনিই মা; কে তিনি জানেন না। কিন্তু তিনি অমৃতরূপিণী অভয়া; মৃত্যু তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে নমস্কার করে চলে যায়। মুহূর্তের জন্য চঞ্চল হলেন মশায়। মনে হল মৃত্যু এসে যেন দাঁড়িয়েছে ঘরের মধ্যে। কোনো কোণে সে অন্ধকারের সঙ্গে মিশে রয়েছে। রোগিণী বোধ করি তারই আভাস অনুভব করে ডাকছে, সেই অমৃতরূপিণীকে। সতর্ক হয়ে তিনি রোগিণীর দিকে চেয়ে রইলেন।
৩৭. পরের দিন সকালে
জীবনমশায় আরোগ্য-নিকেতনের দাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাসপাতালের ডাক্তারের বাড়ি যাবেন। হঠাৎ প্রদ্যোত ডাক্তার নিজেই সাইকেল চড়ে এসে রোয়াকে পা দিয়েই সাইকেলটার গতিরোধ করলেন; নামলেন না। হাঁপাচ্ছেন।
—মশায়, আজ জ্বর নাইন্টিনাইনে নেমেছে।
–নেমেছে?
–হ্যাঁ। নাইন্টিনাইন পয়েন্ট দুই। ভোরবেলা থেকেই মঞ্জু কথা বলছে—সহজ কথা। বলছে ভাল আছি।
–ভগবানের দয়া আর আপনার অদ্ভুত সাহস, আর দৃঢ়তা!
তরুণ ডাক্তারটি কোনো প্রতিবাদ করলেন না এ প্রশংসার। নিঃসঙ্কোচে হাসিমুখে গ্রহণ করলেন, শুধু বললেন– আপনার নাড়িজ্ঞানের সাহায্য না পেলে এতটা সাহস পেতাম না মশায়। আচ্ছা, আমি যাই। মনের খুশিতে ছুটে এসেছি।
ঘুরল সাইকেল; ডাক্তার দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল। সকালের বাতাসে তার রুক্ষ চুলগুলি উড়ছে।