–এখানকার জীবনমশায় এসেছেন তোমাকে দেখতে।
মেয়েটি চোখ খুললে, বড় বড় দুটি চোখ, এদিক থেকে ওদিক চোখ বুলিয়ে মশায়কে দেখে আবার চোখ বন্ধ করলে।
প্রদ্যোত ডাক্তার বললেন–তোমার জিভটা দেখাও তো!
মেয়েটি জিভ দেখালে।
চারুবাবু সীতাকে বললে–থার্মোমিটার দাও।
জীবনমশায় বললেন–থাক। এর আগে কত ছিল?
ডাক্তার একখানা খাতা এনে চোখের সামনে ধরলেন। একশো তিন পয়েন্ট চার।
মশায় ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন–আর কিছু বেড়েছে। আধ ডিগ্রি।
প্রদ্যোত এসে তার কাছে দাঁড়াল, মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলে-টাইফয়েড?
জীবনমশায় একটু দ্বিধা করলেন। বললেন– আজ ঠিক বলতে পারব না। কাল সকালে দেখে বলব। আজ আমার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে।
কিন্তু আমি যে ক্লোরোমাইসেটিন দেব ভাবছি। প্রথম সপ্তাহে জ্বর–বলেই ঘরের দিকে ফিরে বললেন–সীতা, কত দেখলে জ্বরঃ।
সীতা থার্মোমিটার হাতে বেরিয়ে এল, প্রদ্যোত ডাক্তারের হাতে দিয়ে নীরবেই চলে গেল। কিন্তু একটি স্মিতহাস্যে মুখখানি তার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কারণ থার্মোমিটারে কালো দাগটি একশো চারের দাগের এক সুতো পিছনে এসে থেমে রয়েছে। প্রদ্যোত ডাক্তার দেখে বললে–চারই বটে।
জীবনমশায় বললেন–আর আজ বাড়বে না। আমি কাল সকালেই আসব।
–আমি ক্লোরোমাইসেটিন আনিয়েছি। আজ দিতে পারলে–
–কাল। কাল সকালে। এ রোগে আট ঘণ্টায় কিছু যাবে আসবে না। আর–হাসলেন জীবনমশায়। রাগ করবেন না তো?
–না। বলুন।
–আপনি উতলা হয়েছেন। আপনার চিকিৎসা করা তো উচিত হবে না।
–নাঃ! আমি ঠিক আছি। আর আমি তো চিকিৎসা করছি না। চারুবাবু চিকিৎসা করছেন।
***
পরদিন সকালে জীবনমশায় নাড়ি ধরে দীর্ঘসময় প্রায় ধ্যানস্থের মত বসে রইলেন।
সকালবেলা। প্রসন্ন সূর্যালোকে ঘর ভরে উঠেছে। দরজা জানালা খোলা, ঘরখানিকে ইতিমধ্যেই জীবাণুনাশক ওষুধ-মেশানো জল দিয়ে ধুয়ে মুছে ফেলা হয়েছে। এক কোণে ধূপকাঠি জ্বলছে। বিছনা চাদর পরিচ্ছন্ন। খাটের পাশে টি-পয়ের ওপর ওষুধের শিশি, ফিডিং কাপ, কয়েকটা কমলালেবু, টেম্পারেচার চার্ট। রোগিণী এখন অপেক্ষাকৃত সুস্থ। জ্বর কমেছে। ঠোঁট দুটি শুকিয়ে রয়েছে। আচ্ছন্ন ভাবটা কম। তবু চোখ বুজেই রয়েছে। মধ্যে মধ্যে মেলছে, কিন্তু আবার নেমে পড়ছে চোখের পাতা। কপালে এখন জলের পটি নাই, কপাল মুখ রক্তাভ শুষ্ক। পরিপূর্ণ আলোর প্রসন্নতা এবং বৈশাখের প্রভাতের স্নিগ্ধতার মধ্যেও রোগিণীর যেন স্বস্তি নাই, মধ্যে মধ্যে নাক খুঁটছে।
নাড়ির গতি তিনি অনুভব করলেন, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল :
মন্দং মন্দং শিথিলং শিথিলং ব্যাকুলং ব্যাকুলং বা–
অতি মন্থর ভারাক্রান্ত পদক্ষেপ স্থলাতিতে চলছে—অসহায় আকুলতার প্রকাশ রয়েছে। তার মধ্যে। যেন যেন ব্যাকুল জীবনস্পন্দন ত্রস্ত হয়ে কোনো আশ্ৰয় খুঁজছে। সান্নিপাতিক। জ্বরের সমস্ত লক্ষণ সুপরিস্ফুট। ত্ৰিদোষের প্রকোপ তীব্ৰ। মনে হচ্ছে–। যাক সে কথা। জীবনমশায় চোখ খুলে তাকালেন হাসপাতালের ডাক্তারের দিকে। ডাক্তার তারই মুখের দিকে চেয়ে রয়েছেন। সন্তৰ্পণে জীবনমশায় হাতখানি নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন। চাকর দাঁড়িয়ে ছিল সাবান জল তোয়ালে নিয়ে। হাত ধুয়ে মশায় তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বললেন– রোগ টাইফয়েড। নিঃসন্দেহে টাইফয়েডের চিকিৎসা চলতে পারে।
হাসপাতালের ডাক্তার বললেন–সন্দেহ আমারও হয়েছিল। কিন্তু মঞ্জুই আমাকে ধোঁকা ধরিয়েছে; আমরা নিয়মিতভাবে টাইফয়েডের টিকে নিয়ে থাকি। চার মাস আগে ও একবার কলকাতা গিয়েছিল। ছিল মাসখানেক। এই সময়েই আমাদের নতুন ইনঅকুলেশনের সময়টা পার হয়েছে। আমি এখানে ইনঅকুলেশন নিয়ে কে লিখেছিলাম কলকাতায় রয়েছে, নিশ্চয় যেন টি-এ-বি-সি নেবে। ও লিখেছিল—নিলাম। আমি বিশ্বাস করেছিলাম। এখানে ফিরলে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম ভ্যাকসিন নিয়েছ? বলেছিল—নিয়েছি। এবার জ্বর হতে প্রথম দিন থেকে জিজ্ঞাসা করেছিভ্যাকসিন নিয়েছিলে তো? ও বলেছে—নিয়েছি। আজ সকালে স্বীকার করলে, নেয় নি। আমি বললাম—মশায় আমাকে বলে গেছেন টাইফয়েড। তখন বললে–না, নিই নি। যাক এবার নিশ্চিন্ত হয়ে ক্লোরোমাইসেটিন দেব। চারুবাবু, হরেনবাবু দুই জনেই আসছেন। ওঁরা আসুন—একবার জিজ্ঞেস করে নিই।
সীতা এসে ঘরে ঢুকল। সে স্নান করে সঞ্জীবিত হয়ে এসেছে যেন। সে বড় প্রসন্ন আজ বোধ করি, প্রদ্যোত ডাক্তারের এই স্বীকৃতিতে সে উল্লসিত হয়ে উঠেছে।
চারুবাবুরা এসে পৌঁছুলেন। মশায়কে দেখে বললেন–ব্যস, প্রদ্যোতবাবু, উনি বলছেন তো! তা হলে দিন ক্লোরোমাইসেটিন। নিশ্চিন্তে দিয়ে দিন।
ক্লোরোমাইসেটিন। নূতন যুগের আবিষ্কার। এ নাকি অদ্ভুত ওষুধ।
দুঃসাধ্য টাইফয়েড; সাক্ষাৎ মৃত্যু-সহচরী সান্নিপাতিক; তার গতিবেগ বর্ষার পাহাড়িয়া নদীর প্রচণ্ড বন্যার মত—যাকে ফেরানো যায় না, বাঁধা যায় না। আপন বেগে প্রবাহিত হয়ে বন্যার মতই নিজেকে নিঃশেষ করে তবে ক্ষান্ত হয়। সেই শেষ হওয়ার পর যদি জীবন থাকে। তো রোগী বাঁচে। তাও বাঁচে বন্যাপ্লাবনে মাটি-খুলে-যাওয়া, সমস্ত উর্বরাশক্তি ধুয়ে রিক্ত হয়ে যাওয়া পুদ্যোনের মত। শীর্ণ-ঊষর ভূমিখণ্ডের মত তার অবস্থা হয়।
ব্রজলালবাবুর দৌহিত্রের টাইফয়েডে ব্যাকটিরিওফাজ দেখেছিলেন। সেক্ষেত্রে কাজ করে। নাই। কিন্তু পরে ফাজ ব্যবহারে ফল দেখেছেন। ক্লোরোমাইসেটিন নাকি অমোঘ। সান্নিপাতাশ্রয়ী মৃত্যুকে নাকি তৰ্জনীহেলনে অগ্রগমনে নিষেধ করবার মত শক্তিশালিনী। বৃদ্ধ জীবনমশায় বসে রইলেন উদ্গ্রীব হয়ে, তিনি দেখবেন। শিশি তিনি দেখেছেন বিনয়ের ওখানে আছে কয়েক শিশি। তিন শিশি বোধহয়। একটা কেসে ওই তিন শিশিই যথেষ্ট। কাল থেকেই নাকি জ্বর কমবে। তৃতীয় দিনে জ্বর ছাড়বে। বিস্ময় বৈকি!