প্রদ্যোত ডাক্তার শক্ত লোক; তা হলে সে যন্ত্রপাতি নিয়েই ফিরেছে।
সীতা আরও বলেছিল—তবে ডাক্তারবাবু মনমরা একটু হয়েছেন বটে। আপনাকে উনি মুখে যাই বলে থাকুন মনে মনে আপনার ওপর বেশি চটেছেন।
তাই কি? সে কথা মশায়ের ঠিক মনে হয় না। সীতার কথার কঠিন প্রতিবাদ করতে পারেন নি কিন্তু মৃদু প্রতিবাদ করেছেন। বলেছেন নানা। তুমি ভাই, ভুল করেছ।
সীতা ঘাড় নেড়ে প্রতিবাদ করেছে—উঁহুঁ। ভদ্রলোককে আপনি ঠিক জানেন না দাদু। একটি কথা ভুলে যান না উনি। আর অত্যন্ত হামবড়া লোক! এখানকার কোনো ডাক্তারকেই ভাল বলেন না উনি। আপনাকে আমি দাদু বলি, আপনার বাড়ি আসি বলে আমার উপরেও মনে মনে চটা।
দুঃখ পেয়েছিলেন শুনে।
একটি অতি সাধারণ মেয়ে—তার জীবনের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ, শুধু কৃতজ্ঞ এইটুকু মাত্র। এর জন্যে রাগ? সামান্য মানুষ! তার কৃতজ্ঞতা তার প্রশংসা—তার কতটুকু মূল্য? তবে বিচিত্র! কতকাল আগে ওর নিতান্ত শৈশবে মেয়েটিকে বাঁচিয়েছিলেন। সে কথা তিনি নিজেই ভুলে গিয়েছিলেন। মনে করিয়ে দিয়েছিল ওই মেয়েটিই।
উনিশশো তিরিশ সাল। এখানকার সবরেজিস্ট্রি আপিসে এসেছিল এক হেডক্লার্ক। রামলোচন সরকার। একমাত্র বিধবা মেয়ে, স্ত্রী আর বিধবা মেয়ের কোলে একটি শিশু মেয়ে নিয়ে এসে মশায়দের গ্রামেই বাসা নিয়েছিল। এখানে ছিল মাত্র মাস আষ্টেক। ওর মা সরকারের বিধবা মেয়েটির খুব অসুখ নিয়েই এসেছিল। বাঁচবে বলে কেউ আশা করে নি, মশায়ই চিকিৎসা করে বাঁচিয়েছিলেন। এ মেয়েটি তখন কঙ্কালসার শিশু। একত্রিশ সালের আশ্বিনে যে মারাত্মক ম্যালেরিয়ায় শিশুমড়ক হয়েছিল সেই ম্যালেরিয়ায় এ মেয়েটিও যায়যায় হয়, তাকেও তিনিই নাকি বাঁচিয়েছিলেন। সেদিন বাড়িতে এসে পরিচয় দিয়ে ও যখন এসব কথা বললে, তখনও তিনি চিনতে পারেন নিচিনেছিলেন আতর-বউ। বললেন–সেই হাড়জিরজিরে মেয়েটা তুই? এমন হয়েছিস? আমি যে তোকে কত কোলে করে তেল মাখিয়ে রোদে ভেজেছি। তখন তাঁর ধীরে ধীরে মনে পড়েছিল। অত্যন্ত মধুর মনে হয়েছিল। অকস্মাৎ যেন রৌদ্রদগ্ধ আকাশ থেকে একবিন্দু মধু ছিটিয়ে দিয়েছিলেন বিধাতা। পৃথিবীতে এ দুর্লভ কিন্তু মূল্য তো এর কিছু নাই! মধ্যে মধ্যে মনে হয় চিকিৎসক-জীবনে নিদান হকার পাওনা বিধাতা মিটিয়েছেন শশাঙ্কের বউয়ের অভিশাপে, আর মানুষ বাঁচানোর পাওনা মিটিয়েছেন এই সীতা মেয়েটির কৃতজ্ঞতায়। মেয়েটার জ্ঞানও ছিল না তখন, মায়ের কাছে শুনে মনে রেখেছে।
—মশায় নাকি?
আলোকোজ্জ্বল চৌমাথাটায় আত্মগোপন করে যাওয়া যায় না। চারুবাবু ডাক্তার দেখতে পেয়েছেন। দাঁড়াতে হল। মশায় ফিরে দাঁড়িয়ে বললে—হ্যাঁ। বসে আছেন? তারপর প্রদ্যোতবাবু, কবে ফিরলেন? নমস্কার!
প্রতি-নমস্কার করে প্রদ্যোত বললে–আজ চার দিন হয়ে গেল।
—চার দিন? তা হবে। আজ কয়েক দিনই সীতা আসে নি। দেখা হয় নি।
–একবার আসুন গো এখানে। আপনার জন্যেই আমরা বসে আছি। ডাকলেন চারুবাবু।
–আমার জন্যে?
শঙ্কিত হলেন মশায়। আবার কোন অভিযোগ? কী হল? কী করেছেন তিনি? মনের মধ্যে অনেক সন্ধান করলেন। কই কারুর নিদান তো তিনি হাঁকেন নি! তবে কি রানার কথা? এঁরা কি বলবেন যে তিনি আশা দেন নি বলেই হতাশাতে রানা দেবস্থলে চিকিৎসার নামে অচিকিৎসায় মারা গেল? অথবা বলবেন—দেবস্থলে যেতে তিনিই তাকে উৎসাহিত করেছিলেন?
চারুবাবু বললেন– প্রদ্যোতবাবুর স্ত্রীর জ্বর। একবার দেখতে হবে।
–প্রদ্যোতবাবুর স্ত্রীর জ্বর, আমাকে দেখতে হবে?
–হ্যাঁ। কলকাতা থেকেই জ্বর নিয়ে এসেছেন। জ্বরটা যেন কেমন লাগছে–। এন্টেরিক তো বটেই। টাইফয়েডের লক্ষণ রয়েছে। আর চার দিন না গেলে তো রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়বে না। আপনি একবার নাড়িটা দেখুন। টাইফয়েড হলে খুব ভীরু লেন্ট টাইপ; চার দিন আজ, ফার্স্ট উইক এরই মধ্যে জ্বর তিন ছাড়াচ্ছে। প্রদ্যোতবাবু আমাকে ডেকেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে বলতে আমি পারব না। আপনি পারেন। নাড়ি দেখে আপনি পারেন—সে আমি উঁচু গলা করে বলি। ওঁকেও বলেছি। প্রদ্যোতকে দেখিয়ে দিলেন চারুবাবু।
এতক্ষণে প্রদ্যোত কথা বললে–ডায়াগনসিস আপনার অদ্ভুত। আপনি শুধু বলে দেবেন। টাইফয়েড কি না।
একটু হেসে মুখ তুলে ওদের দিকে তাকালেন, এতক্ষণ মাটির দিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। মুখ তুলে প্রদ্যোতের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন– চলুন।
লাবণ্যবতী দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটি নেতিয়ে পড়েছে। মুখখানি জ্বরোত্তাপে ঈষৎ রক্তাভ এবং ভারী হয়ে উঠেছে। ভ্রমরের মত কোঁকড়ানো রুক্ষ চুল বালিশের নিচে খোলা রয়েছে, কপালের উপর কতকগুলি উড়ছে। কপালে জলের পটি রয়েছে। চোখ বুজে শুয়ে আছে। স্বাস্থ্যবতী মেয়ে। ঘরে একটি বিচিত্ৰ গন্ধ উঠছে। ধূপকাঠি, ওডিকোলন, ফিনাইল, ওষুধ—এইসবের একটা মিশ্রিত গন্ধ। মাথার শিয়রে বসে রয়েছে নার্স। সীতা! হ্যাঁ, সীতাই বসে রয়েছে।
বাবা তাঁর নাড়ি-পরীক্ষা বিদ্যার গুরু। তাকে স্মরণ করে তিনি মেয়েটির হাতখানি তুলে নিলেন। সেখানি রেখে আর একখানি। সেখানিও পরীক্ষা করে রেখে দিলেন। জ্বর অনেকটা–সাড়ে তিনের বেশি মনে হচ্ছে। চারের কাছে।
সীতা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতীক্ষা করছে কী বলবেন। প্রদ্যোত ডাক্তার স্ত্রীর মাথার কাছে ঝুঁকে মৃদুস্বরে সস্নেহে ডাকলেন—মঞ্জু!
ভুরু দুটি ঈষৎ উপরের দিকে তুলে চোখ বুজে মেয়েটি সাড়া দিলে–উঁ।