বিনয়ের দোকানে বসে শুনলেন মশায়। শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। দু ফোঁটা জল তাঁর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে; দীর্ঘ দাড়ির মধ্যে পড়ে হারিয়ে গেল শিবের জটার গঙ্গার মত। অনেকক্ষণ পর তিনি ডেকে উঠলেন গোবিন্দ গোবিন্দ।
ডাক শুনেই মশায় বুঝতে পারলেন-মরি বোষ্টুমি এসেছে। কিন্তু এই অবেলায়? মরি সাধারণত আসে সকালে; ভিক্ষেয় বের হয়ে তার বাড়িতে আরোগ্য-নিকেতনে এসে অভয়ার পাঠানো প্রসাদী মিষ্টান্ন তাকে দিয়ে ভিক্ষায় বেরিয়ে যায়। অবেলায় এই সন্ধ্যায় বিনয়ের দোকানে সে কোথা থেকে এল? অভয়ার কি আবার অসুখ করেছে? রানার শেষকৃত্য করে ক্লান্ত কিশোর ওপাশের চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে গিয়েছে। মশায় নির্জন অবসরে নিজের নাড়ি ধরে বসে ছিলেন। ওটা একটা অভ্যাসেই দাঁড়িয়ে গিয়েছে। মরির কণ্ঠস্বর শুনে তিনি হাত ছেড়ে দিয়ে ডাকলেন-মরি!
–প্ৰণাম বাবা!
–তুই এই অসময়ে?
মরি হেসে বললে—আজ ফিরবার পথে বাবা। ঝুলি থেকে পাঁচটি আম বের করে নামিয়ে দিলে।
হেসে বললে–মায়ের গাছের আম প্রথম পেকেছে। মা-কালীর জন্যে সব্বাগ্যে কটি তুলে রেখে পাঁচটি আপনার তরে দিয়ে বললে—দিয়ে এসো মরি। তা আজ আবার আমাদের গুপীনাথপুর আখড়াতে অষ্টপ্রহরের ধুলোট ছিল। বৈষ্ণবসেবার রান্নাবান্নার কাজ করে হাত ধন্যি করতে গিয়েছিলাম। ফল জিনিস তো দিবসের মধ্যে নষ্ট হবে না; বরং মজে মিষ্ট হবে, খাবার উপযুক্ত হবে।
বোষ্টুমি মরিদের কথাবার্তার এই ধরনটি আজ বিরল হয়ে এসেছে; কথার ও কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা মাধুর্য চিরকালই দুর্লভ; মরির মধ্যে দুই-ই আছে; মশায় ভারি তৃপ্তি পান।
মরি বললে–সেখান থেকেই ফিরছি। সায়ংকালে আজকাল আপনি এইখানে অধিষ্ঠান করেন আমি জানি তো! তাই এইখানে দিয়ে গেলাম।
আঁটির গাছের দেশী আম। কিন্তু শ্রদ্ধার ও কৃতজ্ঞতার মিষ্টতায় ও মাধুর্যে অমৃতফল। মুহূর্তপূর্বের বৈরাগ্য-গৈরিক উদাসীন পৃথিবী যেন এক মুহূর্তে গাঢ় মমতার সবুজে কোমল হয়ে উঠল।
মরি বললে–আর-একটি কথা বলেছেন মা।
–কী কথা?
–এই জ্যৈষ্ঠি মাসে মায়ের সাবিত্রী চতুকদশীর ব্রেতো। সেদিন আপনাকে নেমন্তন্ন করেছে।
মনে পড়ে গেল, শশাঙ্কের মৃত্যু ধ্রুব জেনে তিনি অভয়াকে নিমন্ত্রণ করে পরিপাটি করে আমিষ খাওয়াতে চেয়েছিলেন। মনে পড়ল, গলির মুখে প্রদীপ হাতে ধরে দাঁড়ানো অভয়ার সেই ছবি; আলোর ছটা পড়েছে সিঁথির সিঁদুরের উপর, চোখের তারা দুটির মধ্যে ভাসছে তার প্রতিবিম্ব। শিউরে উঠলেন মশায়! চোখ বুজলেন তিনি। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন– সাবিত্রী চতুর্দশীর ব্ৰতের খাওয়ান রাত্রে। এই বুড়ো বয়সে রাত্রে তো যেতে পারব না মরি!
মরি বললে—সেকথা আমি বলেছিলাম বাবামশায়। তা অভয়া মা বললে–তা তো বুঝি। মরি, কিন্তু আমার ভারি ইচ্ছে হয়। তুই বলে একবার দেখিস। আর একটি কথা বলেছে!
–বল।
–কিছু মাছের জন্যে বলেছে। এবারে ওদের পুকুরে মাছ একেবারে নাই।
মশায় খুশি হয়ে উঠলেন–মাছ! মাছ চেয়েছে অভয়া? তা দেব। পাঠিয়ে দেব।
—আম কটি কিন্তু খাবেন বাবা।
–নিশ্চয় খাব।
পৃথিবীকে মধুর করে দিয়ে চলে গেল মরি।
আবার তিনি ডাকলেন মরিকে—মরি! ওরে মরি!
–বাবা! ফিরল মরি।
–বলিস আমি যাব। সাবিত্রীব্রতে যাব। চলে যাব, ইন্দিরকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাব। পৃথিবীতে আজ সব সঙ্কোচ ঘুচে গিয়েছে, সব তিক্ততা মুছে গিয়েছে। তিনি যাবেন।
***
মনের মধ্যে গান গুনগুন করছিল। নামগান। রাত বেশ হয়েছে। নবগ্রামের লেনদেনের বাজারের আলোগুলোও ঝিমিয়ে পড়েছে। লণ্ঠনের কাছে কালি পড়েছে, পলতেতে মামড়ি জমেছে। শিখাগুলো কোনোেটা দুভাগ হয়ে জ্বলছে, কোনোটার একটা কোণ ঘেঁয়াটে শিখা তুলে লম্বা হয়ে উঠেছে। ডেলাইট পেট্রোম্যাক্সগুলোরও সেই দশা, ম্যান্টেল লালচে হয়েছে, খানিকটা বা কালো, কোনোেটা বা মধ্যে মধ্যে দপদপ করছে। অধিকাংশ ক্যাশবাক্সে চাবি পড়েছে; বাক্সের উপর খেরোবাধা খাতাগুলো থাকবন্দি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ জল ছিটিয়ে ধুনো দিচ্ছে, তালাচাবি হাতে লোক দাঁড়িয়ে আছে, দোকান বন্ধ করবে। ঋজু দত্তের বড় দোকান–ওখানে এখনও থাকবন্দি সিকি-আধুলি সাজানো রয়েছে, নোটর থাক গুনতি হচ্ছে। দোকানটার পাশে একটা ভোলা জায়গায় খানকয়েক গরুর গাড়ি অ্যাঁট লাগিয়েছে, গাড়ির তলায় খড় বিছিয়ে বিছানা পেতেছে। চৌমাথার মোড়ে চায়ের দোকানটায় এখনও জনচারেক আড্ডা জমাতে বসে আছে। ওপাশে সাধুখাদের নূতন একতলা বাড়িটার বারান্দায় চারুবাবু আর প্রদ্যোত বসে রয়েছে। এইটেই ডাক্তারদের কো-অপারেটিভ মেডিক্যাল স্টোর্স। এদের হ্যাজাক-আলো নতুন, এখনও সমান তেজে জ্বলছে।
প্রদ্যোত ডাক্তার কবে ফিরল?
সেই মতির ছেলের মৃত্যুর পর প্রদ্যোত হঠাৎ ছুটি নিয়ে সস্ত্রীক কলকাতা চলে গিয়েছিল। লোকে গুজব করেছিল—প্রদ্যোত ডাক্তার মতির ছেলের মৃত্যুর ওই ব্যাপারটায় মনে মনে খুব ঘা খেয়েছে। সেই লজ্জায় এখান থেকে ট্রান্সফারের জন্য চেষ্টা করতে ছুটি নিয়ে কলকাতা চলে গেল।
সীতা বলেছিল–না। উনি কলকাতায় গেলেন এখানকার ক্লিনিকের জন্যে। বিপিনবাবু পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেলেন, ওই টাকাটা গভর্নমেন্টের হাতে দিয়ে, আরও কিছু স্যাংশন করিয়ে যাতে তাড়াতাড়ি হয় তারই চেষ্টা করতে গিয়েছেন। কলকাতার অ্যাসেম্বলির কোনো মেম্বারকে ধরে চিফ মিনিস্টার ডাঃ রায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। বলে গেছেন—অন্তত যে টাকাটা হাতে পেয়েছেন তা দিয়ে যতটুকু হয়—সেসব কিনে তিনি ফিরবেন।