মশায় ভাবতে ভাবতেই বাড়ি ফিরলেন। রানাকে যদি বাঁচাতে পারতেন।
রানাকে সারাতে পারত প্রদ্যোতরা। হ্যাঁ, পারত। তাদের চিকিত্সও ছিল কিন্তু সে চিকিৎসার তাঁর আয়োজন নাই। আর এতখানি শক্তিও ছিল না; না–ছিল না।
এ চিকিৎসাশাস্ত্র বিপুল গতিবেগে এগিয়ে চলেছে। অণুবীক্ষণ যন্ত্র খুলে দিয়েছে দিব্যদৃষ্টি। বীজাণুর পর বীজাণু আবিষ্কৃত হচ্ছে। রোগোৎপত্তির ধারণার আমূল পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আজ সবই প্রায় আগন্তুক ব্যাধির পর্যায়ভুক্ত হয়ে গেল। সবের মূলেই বীজাণু। বীজাণু, জীবাণু, কৃমিজাতীয় সূক্ষ্মকীট–তারপর আছে ভাইরাস। খাদ্যে জলে বাতাসে তাদের সঞ্চরণ। মানুষের দেহে তাদের প্রবল বিস্তার। তাদের শাস্ত্রে পড়েছিলেন দক্ষযক্ষে রুদ্রমূর্তি শিবের ক্রোধ নিঃশেষে হয়েছিল জ্বরের সৃষ্টি; নানান আকার, নানা প্রকার; আচার্যেরা তাদের প্রকৃতি নির্ণয় করে নামকরণ করেছিলেন। চন্দ্র দেবতার উপর দক্ষ প্রজাপতির অভিশাপ থেকে যক্ষ্মার উৎপত্তি হয়েছিল। অতি রমণ দোষই যক্ষ্মার আক্রমণের বড় কারণ বলে ধরতেন। আজ খাদ্যাভাব যক্ষ্মার প্রধান কারণ। প্রতিটি জ্বরের কারণ আজ ওরা অণুবীক্ষণে প্রত্যক্ষ করছে। কত নূতন জ্বর! এই তো কালাজ্বর ধরা পড়ল তাঁর আমলেই।
কালাজ্বরের ওষুধ ব্রহ্মচারী সাহেবের ইনজেকশন। প্রন্টুসিল, সালফাগ্রুপ, তারপর পেনিসিলিন, টেরামাইসিন, ওষুধের পর নতুন ওষুধ। শুনছিলেন সেদিন হরেনের কাছে। পেনিসিলিন চোখে দেখেছেন। বাকিগুলি দেখেন নি। আরও কত ওষুধ বেরিয়েছে—তিনি হয়ত শোনেন নি। আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মি দিয়ে চিকিৎসা।
রক্ত, পুঁজ, থুতু, মলমূত্র, চামড়া পরীক্ষা।
ব্লাডপ্রেসার পরীক্ষা।
এক্স-রে পরীক্ষা। যক্ষ্মায় আক্রান্ত শ্বাসযন্ত্র চোখে দেখা যায়। তেমনি ওষুধ।
টি-বিতে স্ট্রেপ্টোমাইসিন শক্তিশালী ওষুধ। স্ট্রেপ্টোমাইসিন ছাড়াও পি-এ-এস বলে একটা ওষুধ বেরিয়েছে বলে শুনেছেন। দুটোর একসঙ্গে ব্যবহারে নাকি আশ্চর্য ফল পাওয়া যায়। এ ছাড়া-অস্ত্র-চিকিৎসার কথা শুনেছেন।
অকস্মাৎ একটা পুরনো কথা মনে পড়ে গেল।
গুরু রঙলালের কাছে কলেরার প্রেসক্রিপশন আনতে গিয়ে মৃত্যুভয়ত্রস্ত মানুষদের প্রসঙ্গে বলেছিলেন মৃত্যু যেন দু হাত বাড়িয়ে উন্মাদিনীর মত ভয়ঙ্করী মূর্তিতে তাড়া করে ছুটেছে; মানুষ পালাচ্ছে; আগুন-লাগা বনের পশুর মত দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটেছে।
রঙলাল ডাক্তার বলেছিলেন—শুধু পালানোটাই চোখে পড়ছে তোমার; মানুষ তার সঙ্গে অবিরাম লড়াই করছে দেখছ না? পিছু হঠেই আসছে সে চিরকাল কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে তাসে নি। নূতন নূতন অস্ত্রকে উদ্ভাবন করছে, আবিষ্কার করছে। সে চেষ্টার তো বিরাম নাই তার। মৃত্যুকে রোধ করা যাবে না, মৃত্যু থাকবেই। কিন্তু রোগ নিবারণ সে করবে। পরিণত বয়সে যোগীর মত মানুষ দেহত্যাগ করবে। চিকিৎসকের কাছে এসেই বলবে—আর না; ছুটি চাই। ঘুমুতে চাই। পুট মি টু স্লিপ প্লিজ!
জীবন সেদিন মনে মনে বলেছিল–হ্যাঁ। নিদ্ৰা নয়, মহানিদ্রা।
৩৬. বৈশাখের শেষ সপ্তাহে
অপ্রত্যাশিত না হলেও সংবাদটা এল যেন হঠাৎ। আরও মাসখানেক পর। বৈশাখের শেষ সপ্তাহে।
রানা পাঠক মরেছে।
সংবাদটা নিয়ে এল কিশোর। কিশোর গিয়েছিল সেখানে। রানাই তাকে সংবাদ পাঠিয়েছিল। নবগ্রামের জেলেরা গিয়েছিল নদীতে মাছ ধরতে, তাদেরই একজনকে বলেছিল-কিশোরবাবুকে একবার আসবার জন্য বলিস। আমি বোধহয় আর দু-এক দিন আছি, বুঝলি!
শেষ কিছুদিন রানা গ্রাম ছেড়ে নদীর ঘাটে একখানা কুঁড়ে তৈরি করে সেইখানেই থাকত। নদীর ঘাট, নদীর জলকর তার ইজারা নেওয়া ছিল। নদীর ঘাটটি তার অত্যন্ত প্রিয় স্থানও ছিল। ওই নদীর ঘাটেই সে জীবনের শ্ৰেষ্ঠ আনন্দ উল্লাস ভোগ করেছে। নদীতে ঝাঁপ খেয়ে পড়ে সাঁতার কেটেছে, রাত্রে খেয়াঘাটের চালায় অথবা নৌকায় বসে মদ্যপান করেছে, নারী নিয়ে উল্লাস করেছে, খাওয়াদাওয়া অনেক কিছু করেছে। আবার বসে মোটা গলায় প্রাণ খুলে কালীনাম করেছে। ইদানীং সে সন্ন্যাসী হয়েছিল। ওখানে সন্ন্যাসীর মতই বাস করত। গেরুয়া কাপড় পরত, দাড়ি-গোঁফ রেখেছিল, খুব আচারেই থাকত। দেবস্থানের ওষুধই ব্যবহার করত। কিন্তু রানার গোঁড়ামি, রানার বিশ্বাস অদ্ভুত। ওকে টলানো যায় না। মৃত্যুশয্যাতেও স্বীকার করে নাই। বলেছে–এই আমার অদৃষ্ট তার দেবতা কী করবে?
কিশোরকেই বলেছে। কিশোর যখন পৌঁছেছিল, তখন তার শেষ অবস্থা। ঘণ্টা কয়েক বেঁচেছিল। কিশোর ডাক্তার-বৈদ্য ডাকতে চেয়েছিল—তারই উত্তরে ওই কথা বলে বলেছিল, ডাক্তার-বদ্যির জন্য তোমাকে ডাকি নাই কিশোরবাবু। শোন, তোমাকে যার জন্যে ডেকেছি। মনে হচ্ছে, আজই হয়ত মরব। বড়জোর কাল। এখন রাত্রে একজন লোক চাই, কাছে থাকবে। জল চাইলে জল দেবে আর এই শেয়াল এলে তাড়াবে। বুঝেছ, নদীর ধারের মড়াখেকো শেয়াল তো, বেটারা ভারি হিংস্র। আজ দিন দু-তিন থেকে ওরা আশেপাশে ঘুরছে রাত্রে। তাতে লাঠি ঠুকে, ধমক দিয়ে কালও তাড়িয়েছি। আজ আর পারব না। তা ছাড়া
বলতে গিয়ে থেমে রানা একটু হেসেছিল। হেসে বলেছিল—মরণের আগে সব আসে তো। ভয় রানা পাবে না। তা পাবে না। ক্ষমতা থাকলে বলতাম আয়রে বাবা, লড়ি এক হাত। তা ক্ষমতা নাই। একজন লোক থাকলে ভাল হয়। এই এক নম্বর। দু নম্বর হল—মরে গেলে দেহটার একটা ব্যবস্থা চাই। গায়ের লোক ভয়ে যক্ষ্মারোগীর দেহ ছোবে না। তার একটা ব্যবস্থা কোরো। তিন নম্বর হল, ছেলে-মেয়ে। মামরা ছেলে-বাবাও যাবে। তুমি এখানকার ভাল লোক, ক্ষমতাও রাখ, পার তো ওদের দেখো একটু। আর চার নম্বর হল—মশায় আমার কাছে চিকিৎসার দরুন কিছু পাবে। তা মশায়কে বোলো-ওটা আমাকে মাফ দিতে। ব্যস।