হঠাৎ হাসপাতালের ডাক্তার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললেন, কিন্তু মতির মাকে আজ আপনি যে কথাগুলি বললেন– সে আমার বড় ভাল লাগল। ঠিক কথা মশায়, জীবনে যখন সময় আসে তখন মুক্তি নিতে হয়। আমার শাশুড়ির দিদিমা আছেন। তিন কুলের সব গিয়েছে, কেবল তিনি আছেন। আমি গেলেই তিনি বলেন, তুমি তো ডাক্তার! আমার কান আর চোখ দুটো সারিয়ে দাও তো। এই মতির মা! আপনি ওকে যা বলেছিলেন—অপারেশন না হলে তাই হত। মরত বুড়ি। কিন্তু আপনি ওকে গঙ্গাতীরে যেতে বলায় ওর সে কী কান্না তখন। আমার পায়ে ধরে বলে আমাকে বাঁচান। এ রোগে আমি মরতে পারব না। এ অপঘাত মৃত্যু। এতে মরে আমি শান্তি পাব না। আমার গতি হবে না।
—ওটা ছলনা ডাক্তারবাবু। মানুষ যেখানে অতি মায়ায় অতি মোহে বদ্ধ হয়, মৃত্যুভয়ে কাতর হয়, তখন নানা ছুতোয় বলে—আমি এই জন্যে বাঁচতে চাই, বাঁচাও আমাকে। মৃত্যুভয়
যে মানুষের একটা বড় লজ্জা! তাই ঢাকে।
–ঠিক বলেছেন, এমনি কথাই আমাকে বলেছিল মতির মা। বলেছিল—আর সাধ আমার একটি আছে। বড় নাতির বউ দেখতে সাধ আছে।
মশায় একটু হাসলেন-মতির মা আবারও অসুখ করলে নতুন সাধের কথা বলে বাঁচবে। কিন্তু ছেলেটির যাওয়া বড় মর্মান্তিক। বড় সবল স্বাস্থ্য ছিল ছেলেটার। একজন বলশালী লোক হত। স্কুলে পড়ত; বাপের কামারশালে বাপকে সাহায্য করত; হাতুড়ি পিটত। ওকে দেখলেই মনে পড়ত মঙ্গলকাব্যের বালক কালকেতুকে।
অকালমৃত্যুর চেয়ে মর্মান্তিক আর কিছু নাই। একে রোধ করাই এ সংসারে সবচেয়ে বড় কল্যাণ। সবচেয়ে সুখের। মৃত্যু এইখানে মৃত্যু, বৃদ্ধ বয়সে সে অমৃত!
হাসপাতালের ডাক্তার বললেন– আজকের কথা চিরদিন মনে থাকবে আমার। আমি বড় বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম।
–না–না-না। আপনি কেন বিব্রত হবেন? আপনি তো চেষ্টার ত্রুটি করেন নি। আপনি কী করবেন?
হাসপাতালের সামনে এসে পড়েছিলেন তারা। ডাক্তারের চাকর ভিতর থেকে ছুটে এসে ফটকটি খুলে দিল। ডাক্তারের স্ত্রী বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বোধ করি সবিস্ময়ে দেখছে। দূরে হাসপাতালের কাছাকাছি ছোট কোয়ার্টারটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সীতা। সেও দেখছে।
ডাক্তার আহ্বান জানালেন–আসুন। একটু বসবেন না? অনেকবারই এসেছেন হাসপাতালে, এখনও আসেন; ককে দেখে যান। আমি কখনও ডাকি নি, একটু বসবেন না আজ আমার বাসায়?
মশায় হাত জোড় করে বললেন– আজ নয় ডাক্তারবাবু। আসব অন্যদিন।
প্রদ্যোত একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বললে—আপনার কাছে হয়ত আমার ত্রুটি হয়ে থাকবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সে আমি ইচ্ছে করে করি নি। আপনার চিকিৎসাপদ্ধতি আর আমার পদ্ধতিতে অনেক প্রভেদ। আমার মত ছেড়ে আপনার মতে আমি বিশ্বাস করতে পারি নি। তাতে আমাকে বিব্রত হতে হয়। আমার চিকিৎসা করা চলে না। তবে হামতির মায়ের নিদান হকার কথা শুনে আর ওর সেই কান্না দেখে আমার রাগ হয়েছিল। আজ অবশ্য দেখলাম—মতির মা মরলেই ওর পক্ষে ভাল হত। কিন্তু আমরা তো ঠিক ওই চোখে দেখি না।
হেসে মশায় বললেন––জানি। আমরা সেকালে ওই চোখেই দেখতাম। বিশেষ করে পরিণত বয়সের রোগী হলে, আর রোগ কঠিন হলে রোগের যন্ত্রণা উপশমের চেষ্টাই করতাম, মৃত্যুর সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে বাঁচাবার চেষ্টা করতাম না। বলে দিতাম, ইঙ্গিতেও বলতাম, স্পষ্ট করে বলতাম, আর কেন? অনেক দেখলে, অনেক ভোগ করলে, এইবার মাটির সংসার থেকে চোখ ফিরিয়ে উপরের দিকে তাকাও। সাধারণ মানুষ আকাশের নীলের মধ্যে তো ধরবার কিছু পায় না, তাই বলতাম তীর্থস্থলে যাও, সেখানকার দেবতার মন্দিরের চূড়ার দিকে তাকিয়ে বসে। থাক। তবে অবশ্য যে প্রবীণ, যে বৃদ্ধ বয়সেও বহুজনের আশ্রয়, বহুকর্মের কর্মী, তাকে বাঁচাতে কি আর মরণের সঙ্গে লড়ি নি? লড়েছি।
প্রদ্যোত ডাক্তার বললে–অন্যদিন হলে তর্ক করতাম। আজ করব না। আমার নিজেরই দিদিশাশুড়ির কথা বললাম। আমরাই বলি, বুড়ি গেলেই খালাস পায়। সেও পায়—হয়ত আমরাও পাই।
মশায় বললেন–তা হয় বৈকি। ওটা আবার সংসারের আর একদিক। সুস্থ জীবন–রঙে রসে ভরপুর জীবন জীর্ণ বস্তুকে সহ্য করবে কেমন করে?
প্রদ্যোত বললে—কয়েকটা কেসেই আমি আপনাকে হাত দেখতে দিই নি। আমার ভয় হত, আপনি কী পাবেন–কী বলে দেবেন। আপনার হাত দেখাকে আমার সময় সময় ভয় লাগে। বিশেষ করে অহি সরকারের নাতির অসুখে।
—ও আপনি অদ্ভুত বাঁচিয়েছিলেন। অদ্ভূত চিকিৎসা করেছেন। আমি প্রথম নাড়িতে মৃত্যুর যেন পায়ের সাড়া পেয়েছিলাম। আমি বার বার হাত দেখেছিলাম কেন জানেন? মৃত্যুকে পিছন হঠে চলে যেতে দেখলাম।
অবাক হয়ে প্রদ্যোত তাকিয়ে রইল মশায়ের মুখের দিকে। কথাটা সে জানে না নয়—কিন্তু সে কথাকে এইভাবে সে প্রকাশ করত না, এমন করে সে অনুভব করে না।
–আজ চলি তা হলে।
–আর একটা কথা। রানা পাঠকের কথা।
—রানা বাঁচবে না ডাক্তারবাবু। রানা সে কথা জানে। সে এক অদ্ভুত মানুষ। সে তো ভয়। করে না মরতে। আপনাদের এখানকার অদ্ভুত চিকিৎসায় বাঁচতে পারত। কিন্তু সে বলে কী জানেন—ভাল হলেও সে-আমি আর হব না। অক্ষমের শামিল হয়ে বাঁচতে হবে, লোকে ভয়ে পাশে বসবে না। ছেলেপিলে ভয় করবে। সে বাঁচা বাঁচতে এত কষ্ট, এত খরচ করব কেন? তার। চেয়ে যা-হয় আপনি করুন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন–আর তো রানা আমাকেও দেখায় না। ওষুধপত্র সব ছেড়ে দিয়েছে সে। এখন দেবস্থানের ওষুধ খাচ্ছে।