হেসে মশায় বললেন–মশায়ের বংশের অবস্থাটাও ওই মেয়েটির মতই সেতাব। কী তফাত আছে বল? আর—হুঁ। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু হঠাৎ থেমে গেলেন।
কথা বন্ধ করে মশায় যেন উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন—কে কাঁদছে নয়? সেতাব?
—কাঁদছে? হ্যাঁ। কার অসুখ ছিল? হ্যাঁ, কাঁদছেই তো!
মশায় উঠলেন। বললেন–ছক তোল সেতাব, একবার দেখি। বৃদ্ধ সেতাব এসব বিষয়ে নিরাসক্তির কোঠায় পৌঁছেছে। সে আর একবার বললে—কার কী হল? বলেই কোটা তুলে নিলে।
—বোধহয় মতি কর্মকারের বাড়িতে কারও কিছু হয়েছে। ওর মায়ের সেই ব্যাপার থেকে ওরাই শুধু আমাকে ডাকে না। কথায় কথায় হাসপাতালে ছোটে দেখি।
অন্য কারও বাড়িতে অসুখ থাকলে অবশ্যই তিনি জানতেন।
মশায়ের তার জন্য ক্ষোভ নাই। মতির উপর রাগ করেন না। তিনি জানেন তার চেয়ে কেউ ভাল জানে না যে, তারা যে তাকে ডাকে না, আসে না সেটা অবিশ্বাসের জন্য নয়। ডাকে না লজ্জায়। মতির মা তার নিদান ব্যর্থ করে বেঁচেছে সেই লজ্জায় তাকে ডাকতে পারে না। মতি পর্যন্ত তার সামনে আসে না। আড়াল দিয়ে হাঁটে। কিন্তু হল কী?
মশায় তাড়াতাড়ি জুতো পরে বেরিয়ে পড়লেন। খানিকটা গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। মতির মা-ই কি তবে গেল? না–।
কান্না মতির বাড়িতেই বটে। কিন্তু সকলের কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে উঠেছে মতির মায়ের কণ্ঠস্বর।-ওরে বাবা রে! আমার এ কী সৰ্বনাশ হল রে! তোমাকে আমি ছাড়ব না রে। তুমি আমার নাতিকে বাঁচিয়ে দিয়ে যাও। নইলে কেন তুমি আমাকে বাঁচালে রে?
মশায় দ্রুত হেঁটে মতির বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
এই মুহূর্তেই হাসপাতালের ডাক্তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। মশায়ের সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হয়ে গেল। পিছনে পিছনে বাড়ি থেকে পাগলিনীর মত বেরিয়ে এল মতির মা। খুঁড়িয়ে চলেও ছুটে এসে সে হাসপাতালের ডাক্তারের সামনে দাঁড়াল। নানা-না। তুমি বাঁচিয়ে দিয়ে যাও। বাঁচিয়ে দিয়ে যাও। পায়ের উপর আছড়ে পড়ল সে, হাসপাতালের ডাক্তার। দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। বললেন– ছাড় ছাড়, পথ ছাড়।
চিৎকার করে উঠল মতির মা—তবে আমাকেও মেরে দিয়ে যাও। বিষ দাও। মরণের ওষুধ দাও।
জীবনমশায় গম্ভীর স্বরে বললেন– মতির মা!
মতির মা তার মুখের দিকে চেয়ে নতুন করে বিলাপ শুরু করবার চেষ্টা করলে। কিন্তু জীবনমশায় সেই গম্ভীর কণ্ঠেই বললেন–ওঠ, চুপ কর। সবেরই একটা সীমা আছে। কিন্তু হল কী? কার অসুখ করেছিল?
চিৎকার করেই মতির মা কী বলতে গেল। মশায় বললেন–এমন করে নয় মতির মা–এমন করে নয়। ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধরে বল।
এবার হাসপাতালের ডাক্তার বললেন– মতির বড় ছেলেটি মারা গেল।
—আঃ, ছিঃ ছিঃ ছি! মশায় বলে উঠলেন। বার-তের বছরের যে পাথরে গড়া ছেলের মত শক্ত ছিল! কী হয়েছিল?
—বোধহয় ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। মাত্র দুদিন জ্বর। হঠাৎ হার্টফেল করল। ডাক্তার বলছিলেন, কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে আবার মতির মা চিৎকার করে আর্তনাদ করে উঠল—ওরে আমার সচল-বচল ছেলে রে, অসুরের কড়ি সেই ছেলে আমার।
বুক চাপড়াতে লাগল মাথা ঠুকতে লাগল।-ওরে তুমি আমাকে কেন বাঁচালে রে? কেন বাঁচালে রে?
হাসপাতালের ডাক্তার বিব্রত হয়ে উঠলেন। ওদিকে তার সাইকেল পাংচার হয়ে গেছে। চারপাশে লোক জমেছে। মৃদু গুঞ্জনে তারা বলছে—কী রকম? রোগে তাকাতেই পারে নাইনা কি?
জীবনমশায় ডাকলেন মতি!
মতি দুই হাতে মাথা ধরে বসে ছিল। এবার সে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল—ডাক্তার জেঠা, আপনাকে দেখালে হয়ত আমার
জীবনমশায় বাধা দিয়ে বললেন– না। আমাকে দেখালেই বাঁচত কে বললে? সংসারে ডাক্তার-বৈদ্যতে রোগ সারাতে পারে, মৃত্যুরোগ সারাতে পারে না বাবা।
মতির মা আবার চিৎকার করে উঠল। আমি কী করব গো? আমাকে বলে দাও।
কী করবে? সহ্য করবে। সংসারে যখন বহু সংসার হয় তখন মুক্তি নিতে হয়—নয় সইতে হয়। সংসারে মৃত্যু অবিরাম। বিরাম নাই। মৃত্যুর কাছে বালক বৃদ্ধ নাই। কী করবে? সইতে হবে।
—আমাকে বাঁচালে কেন গো? আমাকে বাঁচালে কেন?
–এই শোক তোমার কপালে ছিল বলে। তা ছাড়া তুমি বাঁচতে চেয়েছিলে মতির মা।
কে একজন বলে উঠল—এ তো চিরকালের নিয়ম গো। সংসারে প্রবীণ মানুষ মৃত্যুশয্যা পেতে যদি উঠে বসে, তবে সে শয্যেতে আর কাউকে শুতে হবে। মাসুল দিতে হবে।
নীরবে জীবনমশায় অগ্রসর হলেন, তাঁর সঙ্গে হাসপাতালের ডাক্তার। হঠাৎ তিনি বললেন–এখানে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া তো এখন নাই, আমি সন্দেহ করি নি। আমাকে বলেও নি। আজ বললে–কয়েকদিন আগে মামার বাড়ি গিয়েছিল। সেখান থেকেই এনেছে।
জীবন ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–রোগীর রোগ-বর্ণনায় ভুল, চিকিৎসকের ভ্রান্তি, ওষুধ অপ্রাপ্তি, এসব মৃত্যু-রোগের উপসর্গ না হোক–হেতু। নইলে চিকিৎসাবিজ্ঞান-আমাদের বলে আয়ুর্বেদ পঞ্চম বেদ। বিজ্ঞান বেদ এ তো মিথ্যা নয়। মিথ্যা এমনি করেই হয়। মৃত্যু আসে। অবশ্য একালের রোগপরীক্ষার উন্নতি আরও হবে। তখনকার কথা বলতে পারি না। তবে এইটুকু বলতে পারি, ভ্ৰান্তি মানুষের হবেই।
একটু চুপ করে থেকে প্রদ্যোত বললে—নাড়ি দেখে আপনি বুঝতে পারতেন ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া?
—এ ক্ষেত্রে হয়ত পারতাম না। পারলেও বাঁচাতে পারতাম না।
–ওটা ঠিক কথা নয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ অচিকিৎসায় অকালে মরছে।
–হ্যাঁ তা মরছে।
এরপর দুজনেই নীরবে পথ হাঁটতে লাগলেন। মশায় ভাবছিলেন ডাক্তারের কথাই। মরে, অকালে অচিকিৎসায় অনেক লোক মরে। এ স্বীকার আজ করতেই হবে।