মরি বোমি ঠিক উপস্থিত থাকত। হাসিমুখে বলত—আসুন বাবা।
—মা উঠেছেন?
–মা আপনার সেই ভোরে উঠে বসে আছেন। জপ সারা হয়ে গেল।
সাদা থান-কাপড়-পরা শীর্ণ ক্লান্তদৃষ্টি গৌরাঙ্গী মেয়েটি প্রসন্ন হেসে মাথায় একটু কাপড় টেনে দিয়ে অভ্যর্থনা করে বলত-কেন কষ্ট করে এলেন বাবা? ওষুধ পাঠিয়ে দিলেই হত। আমি ভাল আছি বাবা।
ভাল তো থাকবেই মা। রোগ তোমার জট পাকিয়েছে কিন্তু কঠিন তো নয়। তার ওপর তোমার সহ্যগুণ, সেই জোরে শরীরের চেয়ে মন বেশি ভাল আছে। হাতটা যে দেখতে হবে। সেইজন্যে এলাম।
লজ্জিত হত মেয়েটি। মধ্যে মধ্যে বলত—আমাকে বাঁচাবার জন্যে এত কষ্ট কেন করছেন, আমি লজ্জা পাই। আমার জীবন যাবার নয়। আমি গেলে কষ্টভোগ করবে কে?
মশায় উত্তর দিয়েছিলেন—সুখ-দুঃখের সংসার মা। যত সুখ, তত দুঃখ। এই সইতেই জন মা।
হেসে সে বলেছিল—তাই বটে বাবা, যত তেতো তত মিষ্টি। না পারা যায় গিলতে, না পারা যায় ওগরাতে।
–ঠিক বলেছ মা। আমাকে দেখ। তবু মা সংসারে মৃত্যুকামনা করতে নেই। আবার মরণকে ভয় করে পিছন ফিরে সংসার আঁকড়ে ধরে কাঁদতেও নেই। দুটোই পাপ।
—সেই পাপের ভয়েই তো বাবা। নইলে—
মশায় একদিন বলেছিলেনপাপ তোমার নেই মা। কিন্তু অন্যায় কিছু আছে। রাগ কোরো না আমার ওপর।
চমকে উঠেছিল মেয়েটি–কী অন্যায় বাবা?
–মা, আত্মা—যাকে নিয়ে মানুষের এত, তিনি হলেন দেহাশ্রয়ী। দেহ নইলে তিনি নিরাশ্রয় নিরালম্বতার আর কিছু থাকে না। সেই দেহকে একটু যত্ন কর তুমি। যে মন্দিরে দেবতা থাকেন, সে মন্দিরের অযত্ন হলে দেবতা থাকবেন কী করে? দেহকে পীড়া দিয়ে তাকে অকালে চলে যেতে বাধ্য করলে—সেও যে এক ধরনের আত্মহত্যা হয়। শরীরের একটু যত্ন নিতে হবে।
শশাঙ্কের স্ত্রী সে কথা পালন করেছে।
কোনো কোনো দিন সকালে যেতে না পারলে, বৃদ্ধ মশায় দুপুরের রোদ মাথায় করেই গিয়েছেন।
শশাঙ্কের স্ত্রী সেরে উঠেছে। ভাইপোর ঘরে আবার ফিরে গিয়েছে। ফিরিয়ে নিয়ে যাবার আগে ভাইপোটি পিসিকে শহরে নিয়ে গিয়ে এক্স-রে করিয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে তবে নিয়েছে। এক্স-রেতে জীবন মশায়ের কথাই সত্য হয়েছে। আজও মধ্যে মধ্যে মরি বোষ্টমি ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে ভিক্ষার পথে এসে জয় গোবিন্দ বলে তাঁর কাছে দাঁড়ায়। ঝুলির ভিতর থেকে বের করে দেয় কিছু মিষ্টান্ন। অভয়া মা, কালীমায়ের প্রসাদ পাঠিয়েছেন বাবা।
আরও সত্য হয়েছে জীবন মশায়ের কথা। দাঁতু ঘোষাল মরেছে। হাসপাতাল থেকে ভূতের ভয়ের জন্য দাঁতু জোর করে চলে এসেছিল। জুটেছিল শশীর সঙ্গে। কদিন পরেই বিপিনের শ্ৰাদ্ধ হল সমারোহের সঙ্গে। সেই শ্রাদ্ধে দাঁতু খেয়ে এল, সে খাওয়া বিস্ময়কর।
তারপরই সে পড়ল।
শেষ চিকিৎসা তার জীবনমশায়ই করেছেন। সে অন্য কাউকে ডাকেও নি। মশায়কেই ডেকেছিল। শশীই এসেছিল ডাকতে।
মশায়ের দুটি হাত ধরে কেঁদেছিল।
মশায় বলেছিলেন–আমি কী করব তু? কেই বা কী করবে? হাসপাতাল থেকে তুই শ্ৰাদ্ধের খাওয়ার লোভে পালিয়ে এলি?
দাঁতু অস্বীকার করে বলেছিল-–গুরুর দিব্যি, না। ঈশ্বরের দিব্যি করে বলছি। ভূতের ভয়ে। হাসপাতালের ডাক্তারের বাড়িতে পর্যন্ত–
—দাঁতু! তিরস্কারের সুরে মশায় বলে উঠেছিলেন–দাঁতু!
—দাঁতু চুপ হয়ে গিয়েছিল এক মুহূর্তে। মশায় বলেছিলেন—সে তুই। ডাক্তারের রান্নাঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে তুই ভূত সেজে মাংস চেয়েছিলি। আমি জানি। দোষ তোর নয়, এ লোভ তোর রিপু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুই ছাড়তে পারবি নে। তোর ইতিহাস আমি জানি, তাই এত জোর করে বলেছিলাম–দাঁতু এতেই তোকে যেতে হবে। হাসপাতালের ডাক্তার জানে না তোর ইতিহাস, হয়ত আমার মত বিশ্বাস করে না, তাই বলেছিল তোকে বাঁচাবে।
দাঁতু ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছিল।
মশায় বলেছিলেন—ভয় কী? মরবে তত সবাই একদিন। আমিও মরব। মানুষ জন্মায় সে কী হবে, তার কত সুখ কত দুঃখ এ কেউ বলতে পারে না, সবই তার অনিশ্চিত, নিশ্চিত কেবল একটি কথা—সে মরবে একদিন। আর বয়স তো কম হল না। সাহস কর, ভগবানের নাম নে। মরণকে যত ভয় করবি তত কাঁদতে হবে। ভয় করিস নে, দেখবি মরণই তোর সত্যিকারের সুখ। এ ভাঙা জরা দেহ-এ দিয়ে করবি কী? পালটে ফেল। পালটে ফেল।
দাঁতু অনেকক্ষণ কেঁদে তারপর বলেছিল—এবার আমাকে বাঁচাও, আর লোভের খাওয়া খাব না আমি। দেখো।
মশায় হেসেছিলেন, বলেছিলেন চেষ্টা আমি করব। তবে বলাই ভাল রে দাঁতু! দেহে আর তোর কিছু নাই। নাড়িতে বলছে
—ছি-ছি-ছি! ছি-ছি-ছি!
মশায়ের কথার মাঝখানেই দাঁতু চিৎকার করে উঠেছিল–মৃত্যুর সময়েও মশায় উপস্থিত ছিলেন। প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জ্ঞান ছিল দাঁতুর, শুধুই কেঁদেছিল, চোখ দিয়ে অনর্গল ধারে জল পড়েছিল। মশায় একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন কী হচ্ছে তোর?
ঘাড় নেড়ে দাঁতু ক্ষীণ কণ্ঠে বলেছিল—জানি না। ভয় লাগছে।
সেই বহুকালের—সেই আদিকালের সেই পুরনো কথা। মহাভয়, মহাভয়! মহা অন্ধকার! মহাশূন্য! নিশ্বাস নেবার বায়ু নেই। দাঁড়াবার স্থান নাই! কিছু নাই! কেউ নাই—আমি নাই।
ক্ষণেকের জন্য মশায়কেও যেন তার ছোঁয়াচ লেগেছিল। গভীর স্বরে তিনি ডেকে উঠেছিলেন–পরমানন্দ মাধব হে! সেতাবও ছিল মশায়ের সঙ্গে। দাঁতু তারও পাঠশালার সহপাঠী। দেখতে গিয়েছিল। সেতাব মশায়ের হাতখানা চেপে ধরেছিল।
সেই অবধি জীবনের সময় ভাল চলেছে। উপার্জনও বেড়েছে। সেতাবের ধারণা, এই সীতা মেয়েটি এইসব দেখেশুনেই এমন করে আঁকড়ে ধরেছে মশায়কে, আলোকলতার মত। আকাশপথে এসে বুড়ো শালের মাথায় পড়ে তাকে ছেয়ে ফেলেছে, তার রস শোষণ করছে। এই কারণেই সেতাব সন্তুষ্ট নয়। সে বলে। আজও বললে—তবুও বলব জীবন, বাড়াবাড়ি লোকের চোখে ঠেকছে। কোথাকার কোন বংশের কী ধরনের মেয়ে, তার ঠিক নাই। আর তোর হল মশায়ের বংশ!