মেয়েটি হেঁট হয়ে টুপ করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে। মশায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
—আমাকে প্রণাম করছ? আমি কায়স্থ। তুমি ব্ৰাহ্মণ কি বৈদ্য নও তো?
–না। আর হলেই বা কী? আপনি মশায়।
আর মশায়! শেষ হয়ে গিয়েছে মহাশয়ত্ব। কিন্তু আশ্চর্য, পৃথিবীতে এমন কৃতজ্ঞতাও আছে? কবে কোন কালে ওকে ওঁর স্মৃতির কালের সীমার বাইরে কোন অসুখ থেকে বাঁচিয়েছিলেন তার জন্য ওর এত কৃতজ্ঞতা!
–আজ আমি যাই দাদু।
সচেতন হয়ে উঠলেন মশায়, বললেন–তোমার পরিচয় তো ঠিক পেলাম না। কিন্তু তোমার নাম?
–সীতা।
–সীতা?
লঘু পদক্ষেপে চলে গেল মেয়েটি।
—মহাশা! কদ্রু এসে দাঁড়াল ভাল আছি মহাশা। আওর থোড়া দাওয়াই।
৩৫. মাস তখন চৈত্র
মাস কয়েক পর–মাস তখন চৈত্র। বেশ গরম পড়েছে। অপরাহ্লাবেলায় আরোগ্য-নিকেতনের বারান্দায় সেতাবের সঙ্গে মশায় দাবায় বসেছিলেন।
মশায় ক্রমাগত হারছিলেন। বাঁ হাতে ডান হাতের কজিটি ধরে বসে চাল ভাবছিলেন। হঠাৎ বললেন– নাঃ, মাত ঠেকানো যাবে না। আমার হার।
সেতাব বললে—তোর হল কী বল দেখি?
মশায় হাসলেন।
–খেলায় মন নেই একেবারে? কী হয়েছে আজকাল? কেবল নাড়ি দেখছিস। বাঁ হাতে ডান হাতের নাড়ি ধরেই বসে থাকিস! হঠাৎ শঙ্কিত হয়ে সেতাব বললে—জীবন?
মশায় হেসে বললেন– না, কিছু না। তবে ভাল লাগে না রে আর, তাই দেখি। কিন্তু নাঃ, কিছু পাই না।
সেতাব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উদাস হয়ে বসে রইল। দাবা সাজাতে ভাল লাগল না।
বাড়ি থেকে এই মুহূর্তে বেরিয়ে এল সীতা। সেই নার্স মেয়েটি। চায়ের বাটি হাতে এসে বাটি দুটি নামিয়ে দিয়ে বললে–চললাম দাদু। আজ সন্ধে থেকেই ডিউটি।
—এসো। সস্নেহে পিঠে হাত দিয়ে মশায় বললেন–কাল কখন আসবে?
–সকালে স্নান করে ঘুমিয়ে নিয়ে তারপর আসব।
–চল, বিনয়ের ওখানে যাবার পথে একবার ককে দেখে যাব।
মেয়েটি চলে গেল।
সেতাব ঘাড় নেড়ে উৎসাহ প্রকাশ করে বললে–হাসপাতালের ডাক্তার কদ্রু বেটাকে খুব বাঁচালে।
–নিশ্চয়। কেউ ভাবে নি—এ অপারেশন করে ডাক্তার ওকে বাঁচাতে পারবে। চারু বাবু হরেন এরাও ভাবে নি। চারুবাবু তো বলেছিলেন, হাত পাকিয়ে নিচ্ছে বুড়োর উপর ছুরি চালিয়ে, নিক। কদ্রু বেটাও মলে খালাস। স্ট্রাঙ্গুলেটেড হার্নিয়া এখানে অপারেশন হয়?
–হয় সবই, চাই সাহস আর আত্মবিশ্বাস। তা প্রদ্যোত ডাক্তারের আছে।
স্ট্রাঙ্গুলেটেড হার্নিয়া হয়েছিল কর। প্রথমটায় পেটের দরদ বলে ক নিজের ঘরেই। পড়ে ছিল। কিশোর খোঁজ পেয়ে তাকে জোর করে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। অপারেশন না করলেও ক মরত। প্রদ্যোত কারুর কথা শোনে নি, সে অপারেশন করেছে; এবং কৰ্ম্ম বেঁচেছে। ধীরে ধীরে সেরে উঠছে সে। মশায় রোজ একবার করে দেখে যান ককে। প্রদ্যোতের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়, সে হেসে নমস্কার করে বলে—আপনার কদ্রু ভালই। আছে। একদিন বলেছিল—ওর হাত দেখে ওকে একটু বলে যান যে ভাল আছে। নইলে ও বিশ্বাস করে না যে ও ভাল আছে। এমন রোগী পাওয়া ভাগ্যের কথা?
সেতাব আবার ছকে খুঁটি সাজাতে আরম্ভ করে বললে–তুই কিন্তু ওই মেয়েটাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করছিস জীবন।
ওই সীতা মেয়েটির কথা বললে সেতাব। ওই মেয়েটির সঙ্গে কয় মাসেই মশায়দের সম্পর্ক নিবিড় হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ শুধু মশায়ের সঙ্গে নয়, মশায়গিন্নির সঙ্গেও।
মশায় হাসলেন–বাড়াবাড়ির ওপর কি মানুষের হাত আছে রে? দাঁতুকে দোষ দিতাম। লোভ-লোভ-লোভ। এও দেখছি মায়া, মায়া; মায়া ছাড়াবার উপায় নাই। ছাড়ব ভাবতে গেলে অন্তর ছটফট করে আরও নিবিড় পাকে জড়িয়ে পড়ে।
মশায় উদাস দৃষ্টি তুলে আকাশের নীলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সেতাব স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এতটা মাখামাখি সেতাবেরও একটু কটু ঠেকে। সেই সূত্র থেকে এ যেন শত সহস্র লক্ষ পাকে জড়িয়ে পড়ল জীবন। জীবন যদি যুবা হত, এমনকি প্রৌঢ়ও হত এবং জীবন যদি জীবনমশায় না হত তবে লোকে তার দুর্নাম রটাত। তবুও লোকে প্রশ্ন করে এত কিসের মাখামাখি বলতে পার? সেতাবকেই প্রশ্ন করে। জীবন মশায়কে রক্ষা করবার জন্যই সে বলে—এটাও বোঝ না বাপুঃ ছেলেপুলে নাতিনাতনী সব যখন ছাড়লে তখন ওটা এসে পড়ল, ওরাও জড়িয়ে ধরলে আর কি! লোকে তবুও ছাড়ে না। বলেনার্সটার্সদের জাতফাত তো সব গোলমেলে ব্যাপার। সেতাব বলে—সে বাপু আগেকার কালে ছিল—একালে নয়। জীবনের স্ত্রীও মেয়েটিকে ভালবেসেছে। আতর-বউ ভালবেসেছে সেটা তো কম নয়। নিত্যই মেয়েটি একবার করে আসে। আতর-বউকে বই পড়ে শোনায়। আতর-বউয়ের দুঃখের কাহিনী শোনে। এসব জেনেও সেতাবের মনে সন্দেহ হয় যে, মেয়েটি অত্যন্ত সুচতুরা; সে এই বৃদ্ধদম্পতির জীবনের শূন্যতার সুযোগ নিয়ে তাদের দোহন করছে। টাকা-পয়সাও নেয়, এঁরাও—অন্তত জীবনওদেয়!
শেষ বয়সে জীবনের ভাগ্যটা যেন ফিরে গেল। জীবনের নামডাক আবার অনেকটা ফিরে এসেছে। রামহরি লেটকে বাঁচিয়ে সূত্রপাত হয়েছিল, তারপর এই শশাঙ্কের বউয়ের রোগে। জীবনের চিকিৎসা দেখে লোকে অবাক হয়ে গিয়েছে। ডাক্তারেরা বলেছিল যক্ষ্মা, জীবন বলেছিলেন যক্ষ্মা নয়। অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছে। মাস দেড়েকের মধ্যেই সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয়েছে শশাঙ্কের স্ত্রী। সে কী পরিশ্রম আর সে কী নিষ্ঠা বৃদ্ধ জীবন মশায়ের নিজের হাতে ওষুধ তৈরি করেছেন। নিয়মিত একদিন অন্তর ভোরবেলা উঠে দু মাইল পথ হেঁটে গিয়ে জীর্ণ ঘরখানির সামনে দাঁড়িয়ে ডাকতেন–মা!