—কটু কথা বলেছ নাকি?
—তা দু-চারটে শক্ত কথা বলেছি। কটু নয় এমন কিছু বলেছি দু-চারটে। কত বড় শক্ত রোগ আরাম করেছেন তার কথা। সেই কাহারের রক্তবমি-করা যক্ষ্মা ভাল করার কথা বলেছি।
–না-না। সে কাহারের রোগটা যক্ষ্মা ছিল না বাবা। রক্তপিত্ত হয়েছিল তার।
–তা চক্রধারী তো বলেছিল যক্ষ্মা। চারুবাবুও বলেছিল।
–মানুষ মাত্রেরই ভুল হয় বাবা।
–এই তো শশাঙ্কের স্ত্রীকেও বলেছিল যক্ষ্মা। আপনি বলেছেন যক্ষ্মা নয়।
–হ্যাঁ। আমার বিচারে এটাও ওঁরা ভুল করেছেন। শশাঙ্কের স্ত্রী সেরে উঠবে। এক্স-রে করলে এখুনি বুঝতে পারবেন। ভাল নাড়ি দেখতে পারলেও ধরতে পারতেন। আসল হল যকৃতের দোষ। বিধবা মেয়ে, শরীরকে বড় কষ্ট দেয়, অবেলায় খায়, উপবাস মাসে তিনচারটে। লিভার খারাপ থেকেই কাশিটা হয়েছে। তার ওপর পুরনো জ্বর। ওঁরা ধরতে পারেন নি।
–আমার তো যক্ষ্মা বটে। তা আমিও তো ভাল আছি।
–ভাল আছ?
—তাই তো মনে হচ্ছে। জ্বর আজ দুদিন কমে গিয়েছে। সামান্য, খুব সামান্য। নিজেও তো নাড়ি দেখতে জানি। ওদের ওই পারাকাঠি আমার লাগে না। নিয়ম করে খাইদাই! ভাল লাগছে একটু। তা ছাড়া সে সব্বনাশী তো খালাস দিয়েছে আমাকে।
সেই মেয়েটি মরেছে। আশান্বিত হয়ে উঠেছে রানা।
—দেখুন, হাতটা দেখুন।
হাত দেখে বুক দেখে মশায় বললেন– ওই ওষুধই খেয়ে যাও। ওই নিয়মই করে যাও বাবা। দেখ!
—কী দেখলেন বলুন। আমার কাছে আপনি লুকুবেন না মশায়। আপনি তো রানাকে জানেন। মরণকে আমার ভয় নাই। মরতে সাধও নাই। মরব শুনলে কদব না আমি। তবে যদি ভাল হই, আর কিছুকাল বঁচি, তা কেন চাইব না! যক্ষ্মা যখন হয়েছে তখন যাবার নোটিশ আমার হয়ে গিয়েছে, সে আমি জানি। এখন যদি দশদিন মানে কিছুদিন জামিনে খালাস পাই তো সাধআহ্লাদটা মিটিয়ে নি। এই আর কি! ভগবানের নাম ভাল করে করি নাই, তাও করে নি। এই আর কি। আপনি নিৰ্ভয়ে বলুন।
—বলবার সময় এখনও হয় নাই বাবা। তবে খারাপ হয় নাই—এটুকু বলতে পারি। আরও পনের দিন পরে তুমি এসো বাবা।
–ব্যস, ব্যস! তাই আসব। এখন মাছটা রইল। ওটা আপনার জন্যে এনেছিলাম।–মাছ কেন আনলে রানা? আমার বাড়িতে খাবে কে? –পেলাম পথে, নিয়ে এলাম আপনার জন্যে। ইচ্ছে হল। জেলেরা নদীতে মাছ ধরছিল, নদী আমার এলাকা, জমা পাই। দাঁড়ালাম। দেখলাম বেশ মন দুই-আড়াই মাছ উঠল। এ মাছটা চমৎকার লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল আপনাকে নিয়ে এলাম। ঘরে খান, বিনয়-টিনয়কে দেন। পাড়ায় দেন। আমাকে আশীর্বাদ করুন। বাঁচি মরিশিগগির শিগগির হয়ে যাক, যেন না ভুগি। চললাম তা হলে—
বিচিত্র মানুষ রানা। ভয় নাই। কিন্তু রানা বাঁচবে না।
বিনয় বললে—আজ রাত্রে তা হলে আপনার বাড়িতে খাওয়াদাওয়া। বাজার করে মাছ নিয়ে দি গিন্নিমায়ের কাছে।
মশায় হাসলেন–দে! বিনয় চলে গেল।
ঘরে একা বসে নিজের নাড়ি দেখছিলেন। আজকাল প্রায় দেখেন। মৃত্যুর পদধ্বনি যদি শুনতে পান। এখন ওই একটি কল্পনা তার মনে দিন দিন প্রবল হয়ে উঠছে। তিনি তাকে সৰ্বেন্দ্রিয় দিয়ে প্রত্যক্ষ করবেন। সতর্ক হয়ে বসে থাকবেন। তার পদধ্বনি, তার রূপ, তার স্বর, তার স্পৰ্শ, তার স্বাদ তিনি প্রত্যক্ষ করবেন। রূপ থাকলে দেখবেন, স্বর থাকলে শুনবেন, স্পর্শ যদি থাকে তা তিনি অনুভব করবেন। পারলে বলে যাবেন।
সে আতর–বউ? সে মঞ্জরী? সে কেমন? সে কে?
***
একটি তরুণী মেয়ে এসে তাঁর ঘরে ঢুকল। সবিস্ময়ে তিনি তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
শান্ত দৃষ্টি, বড় বড় দুটি চোখ, প্রসন্ন মুখশ্রী, ফরসা রঙ, বাইশতেইশ বছরের একটি মেয়ে। সাদা ব্লাউজ, ফিতেপাড় সাদা শাড়ি, গলায় একছড়া সরু তার চিকচিক করছে, হাত দুখানি নিরাভরণ, বাঁ হাতে একটি কালো ট্র্যাপে বাধা ছোট হাতঘড়ি। প্রসন্নতা মেয়েটির সর্বাঙ্গে।
দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল।
মেয়েটি বললে—আমি এখানে নার্স হয়ে এসেছি। আপনার নাম শুনেছি। হাসপাতালের সামনে দিয়ে আসেন যান দেখি। বড় ইচ্ছে হয় কথা বলতে আজ বাজারে এসেছিলাম, দেখলাম আপনি একা বসে আছেন।
—বোসো মা, বোসো। আলাপ করতে এলে, দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে কেন? আর আমার মত বুড়ো মানুষকে তোমার সঙ্কোচ কী? বোসো। সেদিন রাত্রে হাসপাতালের দাওয়ায় তুমিই দাঁড়িয়ে ছিলে?
–আপনাকে দেখছিলাম।
–আমাকে?
–আপনার অনেক গল্প শুনেছি আমি।
–কার কাছে?
–আমার মার কাছে। আমার মাকে, আমাকে আপনি বাঁচিয়েছিলেন। আমি তখন খুব ছোট। আমার জন্ম এইখানে। ওই আপনাদের গ্রামে।
—কে মা তুমি? আমি তো। বিস্ময়ের আর সীমা রইল না তার।
–কী করে চিনবেন? আমার মায়ের বাবা এখানে চাকরি করতে এসেছিলেন। সে আপনার মনে থাকবে কী করে? কত লোককে আপনি বাঁচিয়েছেন—আপনার কি মনে আছে? কিন্তু যারা বেঁচেছে তাদের মনে থাকে।
—থাকে? হাসলেন জীবনমশায়।
–আমার তো রয়েছে। আমি প্রায় মরে গিয়েছিলাম। মা বলে। তাই তো আমি হাসপাতালে সকলের সঙ্গে তর্ক করি। ওরা বলে পাস-করা তো নন, কোয়াক তো!
মশায় হাসলেন।
মেয়েটি বললে—আমি বলি, না। তা উনি নন। আমি মায়ের কাছে শুনেছি। আপনারা মশায়। মানে মহাশয়ের বংশ।
বিস্ময়ের আর সীমা রইল না মশায়ের।—তোমার মা কে ভাই?
হেসে বললেন–ভাই বললাম, তুমি আমার ছেলের ছেলের বয়সী, কিছু মনে কোরো না।
—না। আপনি আমার দাদুই তো। আমার মা আপনাকে জ্যেঠামশায় বলত।
–কে? কে তোমার মা?
চুপ করে রইল মেয়েটি। একটু পর বললে—একদিন আপনার বাড়ি যাব। সব বলব।