–নয়? উঠে বসল অভয়া।
–না।
—ডাক্তারেরা যে সকলে একবাক্যে বলে গেল।
–তারা তো এক্স-রে করতে বলেছেন?
–হ্যাঁ।
–এক্স-রে করবার দরকার নাই মা। এঁরা বুঝতে পারেন নি। ভুল চিকিৎসা হয়েছে। তুমি এক মাস দেড় মাসের মধ্যেই সেরে উঠবে মা। সংসারে তোমাকে আরও কিছুদিন থাকতে হবে।
স্তব্ধ হয়ে বসে রইল অভয়া।
–আমি ওষুধ পাঠিয়ে দেব। নিয়মের কথা তোমাকে বলতে হবে না। তুমি শুদ্ধাচারিণী নির্লোভ—আমি তো জানি।
অকস্মাৎ দুটি জলের ধারা নেমে এল মেয়েটির দুই চোখের দুটি কোণ থেকে। চোখ ফেটে যেন জল বের হল। কিন্তু নিৰ্নিমেষ দৃষ্টিতে যেমন সে বাইরের শূন্যলোকের দিকে চেয়ে ছিল তেমনিই চেয়ে রইল।
–মা!
—আপনি আমাকে সেদিন বাপের মত স্নেহ করে নেমন্তন্ন করেছিলেন—আমি–
–ওসব কথা থাক মা। অল্পদিনেই তুমি সেরে উঠবে, আমি বলে যাচ্ছি। আমি একদিন অন্তর এসে দেখে যাব তোমাকে।
অভয়া আবার বললে–বনবিহারী ঠাকুরপোর অসুখের সময় আমি মা-কালীর কাছে মানত করেছিলাম, পুজো দিয়েছিলাম। ইচ্ছে হয়েছিল পুষ্প নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে দিয়ে আসি। কিন্তু পারি নি। তিনি মারা গেলে মনে হয়েছিল জিভটা কেটে ফেলি।
মশায় হেসে বললেন–ও নিয়ে তুমি ভেবো না মা। মানুষের শাপে মানুষ মরে না। মানুষ মরে মৃত্যু ধ্রুব বলে। তবে অকালমৃত্যু আছে। বনবিহারী মরেছে নিজের কর্মফলে।
বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল অভয়ার ভাইপো। অভয়া যাকে সন্তানস্নেহে মানুষ করেছে; যে তার যথাসর্বস্ব নিয়ে যক্ষ্মার ভয়ে এই ঘরে নির্বাসন দিয়েছে। তাকে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন মশায়। পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করলেন। বেচারির চোখে-মুখে কী উদ্বেগ-কী ভয়!
–দেখলেন মশায়?
–-হ্যাঁ, কোনো ভয় নাই। এক মাস দেড় মাসের মধ্যেই বউমা ভাল হয়ে উঠবেন।
–ডাক্তারেরা যে বলে গেছেন
–যক্ষ্মা? না, যক্ষ্মা নয়। পার তো এক্স-রে করে দেখতে পার। না পার, এক মাস অপেক্ষা। কর। পনের দিন। পনের দিনেই ফল বুঝতে পারবে। বলতে বলতে মশায় নিজেই একটু সংকোচ অনুভব করলেন। কণ্ঠস্বর একটু বেশি উঁচু হয়ে উঠেছে, কথাগুলি যেন বেশি শক্ত হয়ে গেল।
নারায়ণ নারায়ণ! মনে মনে নারায়ণ স্মরণ করলেন তিনি।
৩৪. মৃত্যু সংসারে ধ্রুব
দেখ, বিনয়, মৃত্যু সংসারে ধ্রুব। যে জন্মায় তার মৃত্যু হবেই। মৃত্যুর বহু পথ, সে অনিবার্য। কেউ রোগে মরে, কেউ আঘাতে মরে, কেউ ইচ্ছে করে মরে,-আত্মহত্যা করে। তবে রোগই হল মৃত্যুর সিংহদ্বারের পাকা সড়ক। রোগমাত্ৰেই মৃত্যুর স্পর্শ বহন করে; সব রোগে মানুষ মরে না কিন্তু খানিকটা এগিয়ে দেয়; জীবনীশক্তি ক্ষয় করে ঠেলে দেয় খানিকটা। চিকিৎসক চিকিৎসা করে, তার জ্ঞানমত যে বাঁচবে বলে মনে হয় তাকে সে মরবে বলে না। যে মরবে বলে মনে হয় তার ক্ষেত্রে কেউ আকারে ইঙ্গিতে জানায়, বলে বড় ডাক্তার আনুন, কেউ নিজের মত স্পষ্ট। করে বলে দেয়। তারও ক্ষেত্র আছে। শশাঙ্কের বউ আমার মতে বাঁচবে। তাই বলেছি।
বিনয়ের দোকানে বসেই কথা বলছিলেন মশায়। আরও একদিন পর। শশাঙ্কের স্ত্রীকে দেখে মশায় যা বলে এসেছেন তাই নিয়ে এখানে বেশ খানিকটা উত্তাপের সৃষ্টি হয়েছে। নবগ্রামের ডাক্তারেরা—হরেন, চারুবাবু, প্ৰদ্যোত তিন জনে ভ্রূ কুঞ্চিত করেছেন। প্রদ্যোত বলেছে—হাত দেখে বলেছে যক্ষ্মা নয়?
কথাটা নিয়ে হইচই করছে শশী ডাক্তার। সে বলে বেড়াচ্ছে—শতমারী ভবেদ্ বৈদ্য, সহস্ৰমারী চিকিৎসক! দু-চার হাজার রোগী মেরে জীবনমশায় আবার মরা বাঁচাতে লেগেছে। রামহরে বেটাকে আমাশা পেটের অসুখ থেকে বাঁচিয়ে এবার শশাঙ্কের বউকে যক্ষ্মা থেকে বাঁচাবে। রানা পাঠককে বাঁচাবে।
শশীর দোয়ারকি করছে দাঁতু ঘোষাল। বিনয় বললেসে বামুন হাসপাতাল থেকে কাল চলে এসে শশীর সঙ্গে জুটেছে। শশী তাকে বলেছে, পেঁতো, জীবন দত্ত যদি যক্ষ্মা ভাল করতে পারে তো আমি আর তোর বদহজম সারাতে পারব না! খুব পারব। ক্যানাবিসিন্ডিকা খাইয়ে তোকে সারিয়ে দেব।
মশায় চকিত হয়ে উঠলেন—দাঁতু হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে, না ডাক্তার ছেড়ে দিয়েছে?
—জোর করে চলে এসেছে। হাসপাতালে ভূত ভূত গুজব শুনেছে—তার ওপর পরশু রাত্রে পরানের বিবি মরেছে বিষ খেয়ে হাসপাতালের টেবিলের উপর। দাঁতু কাল বন্ড লিখে দিয়ে চলে এসেছে।
মশায় অকস্মাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন, বাইরের জানালা দিয়ে গাছের পল্লবের মাথায় আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনটা যেন খোলা পথে শূন্যলোকের অন্তহীনতার মধ্যে কিছু খুঁজে বেড়াতে লাগল। মুখে ফুটে উঠল ক্ষীণ রেখায় একটু হাসি।
—মশায়!
ভারী গলায় ডাক দিয়ে ঘরে এসে ঢুকল রানা পাঠক।
–আমি একটু ভাল আছি মশায়। দু-তিন দিন থেকে জ্বর কম হয়ে গিয়েছে। কাল বোধহয় হয়ই নাই।
সে এসে বেঞ্চে বসল। মেঝের উপর নামিয়ে দিলে সের পাঁচেক একটা মাছ।
মশায় রানার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। ওকে দেখতে লাগলেন। রানার মুখে কোনো পরিবর্তনের ছাপ দেখা যায় কি না। রানা বললে–হাসপাতালের ডাক্তার, হরেন ডাক্তার, চারুবাবু ওদের আজ দুটো কথা বলে এলাম গো!
মুখের দিকে দেখতে দেখতেই ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললেন– কী বলে এলে?
রানা বললেওই ওদের কো-অপারেটিভ না ফো-অপারেটিভ ডাক্তারখানা হয়েছে, সেইখানে ওরা শশাঙ্কের বউয়ের রোগ নিয়ে, আমার রোগ নিয়ে আপনার নামে পাঁচ কথা বলছিল। আমি দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। শুনে আমিও দু-কথা বললাম। তা ওই নতুন ডাক্তার ফট করে বললে–তুমি বচবে না বাপু। মশায় তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। বাঁচতে চাও তো কোথাও কোনো যক্ষ্মা-হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হও। তা আমিও দু-চার কথা বললাম।