নারায়ণ! নারায়ণ! গোবিন্দ হে!
হঠাৎ গভীর কণ্ঠে ডেকে উঠলেন মশায়। গোবিন্দ রক্ষা করেছেন, ভূপীকে না পেলে সে এমনিভাবে বিষ খেতে পারত। হা পারত। সে এই জাতের মেয়ে ছিল।
চঞ্চল হয়ে মশায় বারান্দা থেকে নিচে নেমে এসে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালেন। পরমানন্দ মাধব!
হাসপাতালের লম্বা ঘরটার মধ্যে থেকে মৃদু আলোর আভাস বেরিয়ে আসছে। রোগীরা ঘুমুচ্ছে। তার মধ্যে কেউ কেউ অসুখে এ-পাশ ও-পাশ করছে। আশপাশে কোয়ার্টারগুলি নিস্তব্ধ। অন্ধকারের মধ্যে ঘন কালো ছবির মত দেখাচ্ছে। পরিত্যক্ত কবরস্থানটার মাঝখানে বটগাছটার পত্রপল্লবের মধ্যে বাতাসের বেগে সস শব্দ উঠছে একটানা। হঠাৎ পায়ের তলায় পট করে একটা শব্দ উঠল; এঃ, একটা ব্যাঙ!
–কে? একটি সাদা-কাপড়পরা মূর্তি হাসপাতালের বারান্দার উপর। নারীমূর্তি একটি। মশায় জিজ্ঞাসা করলেন—কে?
মৃদুস্বরে উত্তর এল-আমি একজন নার্স। আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে? বসুন।
—নাঃ, বেশ আছি। কেমন আছে মেয়েটি?
–ভাল না।
–নারায়ণ হে! গভীর স্বরে আবার ডাকলেন মশায়। নার্সটি চলে গেল ঘরের মধ্যে।
ব্যাঙটা তার পায়ের চাপে ফেটে পিষ্ট হয়ে গিয়েছে। বিচিত্র। তিনিই হলেন এই মুহূর্তে মৃত্যুর দূত। কোথায় নেই মৃত্যুঃ কিসে নেই মৃত্যু?
—মশায়!
–কে? হরিহর?
–হ্যাঁ।
–কী হল?
–আর কী? শেষ হয়ে গেল। হল না কিছু।
প্রদ্যোত ডাক্তার বেরিয়ে এল। বললে–পারলাম না কিছু করতে। দেখবেন নাকি?
–নাঃ। আমি যাই তা হলে।
–আচ্ছা! প্রদ্যোত যেন হঠাৎ প্রশ্ন করলে আপনি ওদের বাড়িতে গিয়ে তো মেয়েটিকে দেখেছিলেন। তখন কি নাড়ি দেখে জানতে পেরেছিলেন, বাঁচবে না?
—ওর হাত আমি দেখি নি ডাক্তারবাবু।
–দেখেন নি?
–না। আমি আপনার এখানেই আনবার ব্যবস্থা করেছিলাম। আপনি দেখবেন, চিকিৎসা করবেন, আধুনিক চিকিৎসা আপনাদের। আমি নাড়ি দেখি নি।
৩৩. দুদিন পর মশায় বসে ছিলেন
দুদিন পর মশায় বসে ছিলেন আরোগ্য-নিকেতনের দাওয়ায়। সামনে পড়ে রয়েছে একখানা পত্র। সাদা কাগজের চারিধারে কালো বর্ডার দেওয়া ছাপা নিমন্ত্রণপত্র। বিপিনের শ্রাদ্ধের নিমন্ত্ৰণলিপি। মশায় বাড়ির ভিতর থেকে আসবার আগেই রতনবাবুর লোক এসে দিয়ে গিয়েছে। কৃতী প্রতিষ্ঠাবান বিপিনের শ্রাদ্ধ যোগ্য মর্যাদার সঙ্গেই করতে হবে বৈকি। রনবাবু তা করবেন। মশায় শুনেছেন, রনবাবু বলেছেন—তা না করলে চলবে কেন?
পরানের বিবির দেহটা পোস্টমর্টেমের জন্য চালান গেছে। হতভাগিনীর সকারও হল না?
গতকাল সন্ধ্যায় নবগ্রামে একটি শোকসভাও হয়ে গিয়েছে। মশায় যান নি। এসব সভায় সমিতিতে কেমন অস্বস্তি বোধ করেন তিনি। কিশোর এ সভার উদ্যোক্তা। সভায় গ্রামগ্রামান্তরের লোক এসেছিল। ডাক্তারেরা সকলেই ছিলেন। বিপিন এখানকার হাসপাতালে পাঁচ। হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছে। রক্ত ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের সঙ্গে ক্লিনিক হবে ওই। টাকায়। বিপিনের যোগ্য কাজই বিপিন করে গিয়েছে। রোগার্তের বন্ধুর কাজ করেছে। অকালমৃত্যুর গতি রুদ্ধ হোক। বাপকে যেন সন্তানের শ্রাদ্ধ করতে না হয়।
নবগ্রামের তরুণ ছেলে একটি নতুন উকিল হয়েছে, সে বক্তৃতাপ্রসঙ্গে বলেছে—আমাদের এখানে ডাক্তার এসেছে, হাসপাতাল হয়েছে—নতুনকালের ওষুধপত্রও এসেছে, তবুও হাতুড়ের যুগের অন্ধকার সম্পূর্ণরূপে আমাদের যায় নি। বিপিনবাবুর দানে সেই অন্ধকার দূর হল।
কথাটা মিথ্যা নয়। অধিকাংশ ডাক্তারেরাই হাত দেখতে জানেন না, যা জানেন তাকে ঠিক নাড়িজ্ঞান বলা চলে না। কিন্তু তবু যেন কথাটা তাকে একটু লেগেছে।
নারায়ণ! নারায়ণ! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। মনটা খচখচ করছে। এই তরুণ ছেলেটির সঙ্গে প্রদ্যোত ডাক্তারের বন্ধুত্বটা একটু গাঢ়।
আট-দশ জন রোগী এসেছে। রোগী আবার দু-এক জন করে বাড়ছে। যেদিন থেকে তিনি বিনয়ের দোকানে বসেছেন সেই দিন থেকেই এর সূত্রপাত হয়েছে।
বিনয় মধ্যে মধ্যে হেসে বলে—দেখুন। দেশে ম্যালেরিয়া কমে গিয়েছে। ডি-ডি-টি ছড়িয়ে মশার বংশ নির্বংশ হয়ে গেল, থাকবে কোথা থেকে! টাইফয়েড এখানে কম। ওদিকে হাসপাতাল হয়েছে। রোগীরা ওসব রোগে হাসপাতাল যাচ্ছে। চারুবাবু হরেন বসে আছে। আপনার রোগী বাড়ছে।
তা বাড়ছে। কতকগুলি পুরনো রোগে রোগীরা তার কাছে আসে। তিনি সারাতে পারেন। বিশেষ করে পুরনো রোগে ডাক্তারেরা যখন রোগ নির্ণয় করতে না পেরে রক্ত পরীক্ষা এক্স-রে ইত্যাদির কথা বলেন তখন তারা তার কাছে আসে। আর আছে এ দেশের বিচিত্র কতকগুলি ব্যাধি। যেসব রোগের নাম পর্যন্ত দেশজ; যার সঠিক পরিচয় এখনও নূতন মতে সংগ্রহও হয় নি।
রোগীগুলিকে বিদায় করছিলেন মশায়, ভিক্ষের ঝুলি কাঁধে লাঠি হাতে এসে দাঁড়াল মরি বমী।
–জয় গোবিন্দ! মশায় বাবা গো, পেনাম।
ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলে মরি। মাথার চুলগুলি ছোট করে ছাঁটা, কপালে তিলক, পঞ্চান্নষাট বছরের প্রৌঢ়া মরি বন্ধুমী দীর্ঘদিন পর এল। একসময় নিত্য আসত। ওর ছেলে এবং মেয়ে দুজনেরই হয়েছিল যক্ষ্মা। তাদের জন্য ওষুধ নিতে আসত। সে অনেক দিনের কথা। মরির বোষ্টমও মরেছিল যক্ষ্মায়। কিন্তু মরির কিছু হয় নি। এতকাল পর মরিকে সেই কালে ধরল নাকি? এতকাল পর?
মরি এখানকার নিয়মকানুন জানে। মশায়ও জানেন মরির ধরনধারণ। এখন কী হয়েছে প্রশ্ন করলে মরি বলবে—সকল জনাকে বিয়ে করুন বাবা, তারপর বলছি!