***
সুন্দরী তরুণী মেয়ে। বিষের ঘোরে অর্ধ-অচেতন। বিষের যন্ত্রণায় ভেতরটায় মোচড় দিচ্ছে। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। মুখ নাক দিয়ে পেঁজলা বেরিয়ে আসছে, বুকে চাড়া দিয়ে উঠছে, যেন বুকটা শতধা বিদীর্ণ হয়ে যেতে চাইছে। চোখ দুটি অর্ধনিমীলিত, লাল, সর্বনাশের ঘোর লেগেছে। বিস্ত বেশবাস, মাথার একরাশ চুল খুলে এলিয়ে ধুলায় ধূসর হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। চারিপাশে। লোকেদের টানাটানিতে চিমটিতে মধ্যে মধ্যে জ্ঞান আসছে, তখন মুখর হয়ে উঠছে সে।
—আঃ! মরতেও আমারে দিবা না? মরণেও আমার একতিয়ার নাই? হারে নসিব! হারে নসিব!
হেসে আবার বলেপারব না মিয়া, পারব না। রব্বানি শ্যাকরা কাছে যাতি দিতে আমারে না পার, কিন্তু ইবার যে বঁধুর সাথে আসনাই করে তার হাত ধরেছি—তার হাত ছাড়াইতে তুমি। পারব নাপারবা না-পারব না। আঃ, আমারে একবার ছেড়ে দাও, খানিক ঘুমায়ে লই।
—অঃ–। আঃ–।
বলতে বলতে আবার বিষের ঘোরের একটা ঝলক ছড়িয়ে পড়ে তার চেতনাকে আচ্ছন্ন। করে দেয়; ঢলে পড়ে মেয়েটি, মাথাটা হেলে পড়তে চায়।
মশায় বললেন–পরান, তুমি হাসপাতালে নিয়ে যাও বিবিকে।
–হাসপাতালে? না। আমি তো বুলেছি মশায়
–মাথা খারাপ কোরো না পরান। তোমার ভালর জন্যেই বলছি। আমি আর সে মশাই নই। পরান। যখন প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত ছিলাম তখন এরকম অনেক কেসের হাঙ্গামা আমার হুকুমে মিটে গিয়েছে। আজ সেদিন নাই। আজ আমাকে যখন ডেকেছ, আমি যখন এসেছি, দেখেছি, তখন আমাকেই খবর দিতে হবে থানায়। তা ছাড়া আমি চিকিৎসক। আমি রোগীকে বাঁচাতে আসি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরণ দেখতে আসি না।
পরান গুম হয়ে বসে রইল কয়েক মিনিট। তারপর বললে, গাড়ি জুড়ে নিয়ে আয় রে হানিফ। জলদি! আপুনি তা হলে সঙ্গে চলেন মশায়!
রাত্রি তখন দুটো। মশায় ডাকলেন ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু!
প্রদ্যোত উঠে এল—কে?
–আমি জীবন দত্ত।
–আপনি এত রাত্রে?
–বিষ খেয়েছে একটি মেয়ে! কল্কেফুলের বীজ। তাকে নিয়ে এসেছি। পরান খয়ের স্ত্রী।
–আমি আসছি এক্ষুনি। ওদিকে কম্পাউন্ডার নার্সরা উঠেছে? তাদের ডেকেছেন?
–ডেকেছি।
–এক মিনিট। আসছি আমি।
ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা হাফশার্ট গায়ে দিয়ে সে বেরিয়ে এল। কোনো প্রশ্ন করলে না, কোনো মন্তব্য করলে না। হাসপাতালে এসে সামনেই কম্পাউন্ডার হরিহরকে দেখে প্রশ্ন করলে, সব তৈরি করতে কতক্ষণ সময় লাগবে?
হরিহর বললে, মিনিট পনের লাগবে বৈকি? পটাশ পারম্যাঙ্গানেট লোশন আমি খাইয়ে। দিয়েছি খানিকটা।
ডাক্তার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল, পরান বললে–আমি চললাম ডাক্তারবাবু, মেয়েটা বাঁচলে পর পুলিশে দিবেন, না বাঁচে লাশ সদরে চালান দিবেন; সেখানে ফেড়েছুঁড়ে দেখে যা করবার করবে। সালাম!
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার বললে–আঃ, তখুনি যদি আপনার কথায় গোসা না করতাম! আপনাকেই যদি দেখাইতাম! মশায় বুড়ো লোক, সিকালের লোক, নাড়ি দেখে মরণ ডাকতে পারে। ই ধরতে পারে না। চলে গেল পরান।
প্রদ্যোত ঘরে ঢুকে গেল। মশায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। এই হতভাগিনী মেয়েটাকে ফেলে যেতে তার পা উঠছে না। হতভাগিনীর এতখানি ছলনা তিনি বুঝতে পারেন নি। মুক্তকণ্ঠে। স্বীকার করবেন, তা তিনি পারেন নি। তবে এটা তিনি জানতেন; বৃদ্ধ স্বামীর প্রতি তরুণীর বিরূপ মনোভাবও তাঁর অজানা নয়; কিন্তু তার এমন বিচিত্র প্রকাশের স্বরূপটি তিনি অনুমান করতে পারেন নি। পরানের অতিরিক্ত সমাদর ও পত্নীপ্রীতিকেই এর কারণ বলে ধরেছিলেন। এবং আদরিণী ভাগ্যবতী মেয়ের দুলালীপনাকে পিতা যেমন স্নেহের চক্ষে দেখেন সেই চক্ষেই দেখেছেন। তিনি ভাবছিলেন সন্তান হলেই সেই সন্তানের স্নেহে তার জীবনের অপূর্ণতা পূর্ণ হয়ে যাবে। তার সন্তানধারণশক্তিকেই তিনি সবলতর করবার চেষ্টা করে এসেছেন। সে চেষ্টা তার ফলবতীও হয়েছে। কিন্তু সে যে যৌবনপ্রভাবাচ্ছন্ন মনের বিচিত্র তৃষ্ণার তাড়নায় এই কুটিল পথে ফলবতী হতে পারে সে তিনি ভাবেন নি। প্রদ্যোত ডাক্তার বোধ করি ভেবেছিল। মশায় একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। মেয়েটার প্রতি শত মমতায় যেন তিনি জড়িয়ে গেছেন। মেয়েটি কতবার তার দিকে সজল চোখে চেয়ে বলেছে, বুঝতে পারি না মশায়-বাবা! মনে হয় হেথায় অসুখ, হেথায়, হেথায়, হেথায়। সখানে গো বাবা, কুনখানে লয়। কী অসুখ তাও ঠিক ধরতে নারি। কনকনানি, বেথা, যেন বল নাই, সাড় নাই। আবার সময়ে সময়ে ছুঁলে পরেতেই যেন চিড়িক মেরে ওঠে। বলতে বলতে চোখের জল গড়িয়ে পড়ত। কতদিন প্রশ্ন করেছে—মশায়-বাবা আমি বাঁচব তো?
চোখে দেখেছেন, সে কী ভয়!
সেই মেয়ে আজ বিষ খেয়েছে। মুখর হয়ে উঠেছে। বলেছে—পারবা না মিয়া, পারব না। যে বঁধুর হাত ধরেছি সে বঁধুর হাত থেকে কেড়ে নিতে পারব না।
হরিহর বেরিয়ে এল, বলল—আপনি কি বসবেন মশায়?
–হ্যাঁ বসব হরিহর। পরান তো চলে গেল। আমি পারছি না। হতভাগিনীর শেষটা না দেখে যেতে পারছি না।
দরজাটা খুলে বেরিয়ে এল প্রদ্যোত ডাক্তার। কম্পাউন্ডিং রুমে গিয়ে একটা কী নিয়ে এল। হরিহর বললে—উনি থাকবেন স্যার।
—থাকবেন? বেশ তো। তা একা বাইরে বসে থাকবেন? আসুন না, ভিতরে।
মশায় হেসে বললেন–আমি বাইরেই থাকি। বেশ থাকব।
শেষ রাত্রির আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বসে রইলেন। আকাশে নক্ষত্রদের স্থান পরিবর্তন ঘটছে। কালপুরুষ অনেকটা সরেছে। বৃশ্চিকের বকা লেজের ডগায় ওই দেখা যাচ্ছে। সপ্তর্ষিমণ্ডল পাক খাচ্ছে। ওই বশিষ্ঠের নিচে অরুন্ধতী। অরুন্ধতী যে দেখতে পায়, সামনে অন্তত আরও ছ মাস পরমায়ু নাকি নিশ্চিত। আরও দু মাস তিনি তা হলে নিশ্চয় বাঁচবেন। সে অবশ্য তিনি নাড়ি দেখেও বলতে পারেন। কিন্তু হঠাৎ মনে হল—যদি তিনি বিষ খান এই মেয়েটার মত, তা হলেও কি বাঁচবেন? নাড়ি দেখে সে কথা তো বলা যায় না। অরুন্ধতী দেখে কি তা বলা যায়? অবশ্য বিষ তিনি খাবেন না, কখনই খাবেন না। অধিকাংশ লোকই খায় না। মর্মান্তিক শোকে ক্ষোভে ব্যর্থতাতেও খায় না। মরণকে মানুষের বড় ভয়। মদ খেয়ে মরে, ব্যভিচার করে। মরে, অনাচার করে মরে। বনবিহারীর মত, ওই নিশির ভাইঝির মত। বিপিনের নাম তিনি এদের সঙ্গে করবেন না। কিন্তু এরাও বিষ খেয়ে মরতে পারে না। সে এক আলাদা জাত আছে। এই মেয়েটার জাত। মেয়েদের মধ্যেই এ জাত বেশি।