ধীরে ধীরে ক্লান্ত চোখের পাতা দুটি খানিকটা খুলে গিয়েছিল, চোখের দৃষ্টিতে সাড়া দেওয়ার ইঙ্গিত ফুটে উঠেছিল। অতি ক্ষীণ কণ্ঠে বলেছিল—অ্যাঁ?
কী কষ্ট হচ্ছে তোমার? খুব কষ্ট?
ক্লান্তির সঙ্গে ঘাড় নেড়ে বলেছিল–না।
—তবে?
একটু চুপ করে থেকে চোখ বুজতে বুজতে বলেছিল—মনে হচ্ছে—আমি—
–কী?
–আমি যেন অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। তোমাদের কথা ভাল শুনতে পাচ্ছি না। তোমাদের ভাল দেখতে–
ঘাড় নেড়ে জানাতে চেষ্টা করেছিল—পাচ্ছে না দেখতে। যেন আবরণ পড়েছে এবং সে আবরণ ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে।
এর চেয়ে ভাল বিবরণ তিনি আর শোনেন নাই।
ঠিক এই সময়টিতেই কে ডাকল—মশায়!
—কে? কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে জানালা দিয়ে বাইরের পথের দিকে তাকালেন মশায়। আলো হাতে দুজন লোক। কারা? কার কী হল?
–কে?
–আজ্ঞা আমরা পরান খাঁ সাহেবের বাড়ি থেকে আসছি।
–কী হল? বিবি তো ভাল আছে।
–আজ্ঞা না। বড় বিপদ! বিবি বিষ খেয়েছে মালুম হচ্ছে।
–বিষ খেয়েছে? কী বিপদ? ধড়মড় করে উঠলেন মশায়। আশ্চর্য! মানুষ আবার বিষও খায়, গলায় দড়িও দেয়, কাপড়ে আগুন লাগিয়ে পুড়েও মরে, জলে ঝাঁপ দেয়।
পরান খাঁ দু হাতে মাথা ধরে চুপ করে বসে ছিল। মুখখানা তার ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। বিবি কল্কেফুলের বীজ বেটে খেয়েছে। পরান তাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল, পরানেরও চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে। বললে–সরকারি ডাক্তার ঠিক বলেছিল মশায়। রোগটোগ উয়ার। সব মিছা কথা; মেয়েটা নষ্ট মেয়ে। আমার মত বুড়ো ওকে ছোঁয় তাই রোগের ছলা করে পড়ে থাকত। বিষ খেয়ে গলগল করে বুলছে সব।
বাঁধা বন্য মহিষের মত গর্জে মাথা নেড়ে পরান বললে—ওই হারামি গোলাম ছামুতে পেলে বেটার গলার নলিটা আমি ছিঁড়ে নিতাম। ওই হারামির হারামি–রব্বানি। আর উয়ার মা। হারামজাদী বাঁদী। এককালে হারামজাদী আমার–
অশ্লীল কথা উচ্চারণ করলে পরান।
মশায় বললেন–এখন ওসব কথা থাক পরান। এখন ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে হবে।
—মরে যাক, মরে যাক। কসবী শয়তানী জাহান্নামে যাক মাশয়, আপুনি শুধু শুনে যান উয়ার নিজের মুখে যে শয়তানী বিষ খেয়েছে। ওই নফর ওই হারামি রব্বানির লেগে খেয়েছে। নইলে আমাকে ফাসাবে ওই শয়তানেরা!
পরান দু হাতের মুঠোয় নিজের বাবরি চুল ছিঁড়ে দন্তহীন মুখের মাড়িতে মাড়িতে টিপে বললে—আঃ, নিজের ঘরে আমি নিজে শয়তান ঢুকায়েছি! আঃ!-সরকারি ডাক্তার ঠিক বুলেছিল।
পরানের বিবি নিজে-মুখেই সব বলছে। গোঙাচ্ছে, মধ্যে মধ্যে কথা বলছে। গোঙাতে গোঙাতেই বলছে।—পোড়া নসিব! পোড়া নসিবের সবই তো মানায়ে নিয়েছিলাম কোনো রকমে। খাঁ, রব্বানিকে তুমি ঘরে ঢুকালেই বা ক্যানে; উয়ার মাকেই বা রাখলা ক্যানে? রেখে, যা হবার হয়ে যখন গেল, তখুন তারে দূর করেই বা দিলা ক্যানে?
ঘটনাটা ঘটেছে এই :
কাল বিকেলবেলা থেকে পরানের বিবি বমি করতে আরম্ভ করেছিল। প্রথমটা ওটাকে অন্যতম গৰ্ভলক্ষণ বলেই মনে হয়েছিল সকলের। কিন্তু বার বার বমি এবং সেই বমির সঙ্গে কয়েতবেল, বনফুল, লঙ্কার খোসা ইত্যাদি উঠতে দেখে প্রশ্ন ওঠে–এসব বিবি পেলে কোথায়?
কে এনে দিলে?
বিবির তখন প্রায় অজ্ঞান অবস্থা। অনুসন্ধান করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ে। পরানের বিবির খাস-ঝি রব্বানির মা অত্যন্ত সমাদর এবং অনেক তরিবত করে কয়েতবেল গুড় লঙ্কা নুন মিশিয়ে চাটনি করে এনে খাইয়েছে। তার সঙ্গে কাঁচা বনকুল। এ আজ নূতন এবং একদিন নয়, এ চলছে কয়েক দিন ধরেই। কোনোদিন বাজারের মিষ্টি, কোনোদিন তেলেভাজা, কোনোদিন অন্য কিছু আসছেই। নিজের হাতে মুখে তুলে দিয়ে সাকিনা বেওয়া বিবিকে খাইয়েছে। এনে যুগিয়েছে রব্বানি। নতুন নক্সাপেড়ে শাড়িও নাকি দিয়েছে বুড়ি পরানের বিবিকে। পরানের বড় বিবি কথাটা বলেছে। সে নিজের চোখে দেখেছে রানিকে কাপড় হাতে বাড়ি ঢুকতে, নিজের মায়ের হাতে দিতে; এবং সেই কাপড় নতুন বিবির পরনেও সে দেখেছে।
পরানের বুকের মধ্যে লোহার ডাঙশ পড়েছিল। রাগের মাথায় সে প্রথমেই বড় বিবির চুলের মুঠো ধরে টেনে বলেছিল—ঝুটা বাত!
বড় বিবি আল্লার নামে কসম খেয়েছিল। বড় বিবিকে ছেড়ে দিয়ে পরান খুঁজেছিল সাকিনা। বেওয়া আর বাদীর বাচ্চা রব্বানিকে। কিন্তু তারা দুজন তখন ফেরার। খুব হইচই করতে পরান পারে নি। আশপাশ গ্রামে হিন্দু মুসলমান দুই জাতের মধ্যেই তার দুশমন আছে। আজ চারপাঁচ বছর ধরে নতুন-কেনা জমি নিয়ে তাদের সঙ্গে পাঁচ-সাতটা মামলা চল ছ। রব্বানি মাকে। নিয়ে তাদেরই কারুর বাড়িতে যে আশ্রয় নিয়েছে এতে সন্দেহ নাই। পরান বিষদাঁতভাঙা সাপের মত নিষ্ঠুর আক্ৰোশে ঘুরে আক্রমণ করেছিল নতুন বিবিকে। প্রায়-অচেতন অবস্থার মধ্যেই তার চুলের মুঠো ধরে বার বার টেনে তাকে সচেতন করে তুলতে চেয়েছিল। হয়ত মেরেই ফেলত। কিন্তু নিবারণ করেছিল বড় বিবি!—করছ কী সাহেব, শ্যাষে?ে মরে যাবে। মরে গেলে যে ফাঁসিকাঠে বেঁধে টান দিবে গো! খেদায়ে দাও ওরে।
তাও পরান পারে নাই। তাকে তালাক দিয়ে তাড়িয়ে দেবে, হারামজাদী হাসিমুখে মাঠ পার হয়ে রব্বানির হাত ধরে তার আশ্রয়ে গিয়ে উঠবে তা হবে না। ঘরে বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল। আজ সন্ধেবেলা ঘাটে যাবার জন্য মিনতি জানিয়েছিল নতুন বিবি। খুলে দিয়েছিল বড় বিবি। ঘাটে অবশ্য পাহারা ছিল। ঘাটের পাশে ছিল কলকে ফুলের গাছ। পাহারাদারের চোখ এড়িয়ে কয়েকটা ফল পেড়ে অ্যাঁচলে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল। তারপর কখন খেয়েছে। এখন অর্ধ-চেতন অবস্থা। মরে গেলে ক্ষতি নাই। জাহান্নামে যাক নষ্টদুষ্ট আওরত, কসবী খানকী হারামজাদী। মশায় শুধু নিজের কানে শুনে রাখুন-হারামজাদী নিজে বিষ খেয়েছে। পরানের এতে কোনো দায় নাই। সে নির্দোষ।