মশায় যেন আগুনের হেঁকা খেয়ে চঞ্চল হয়ে উঠলেন। ভুরু কুঁচকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে সবিস্ময়ে বললেন–ভূত?
বিনয় বললে—দাঁতু দেখেছে। কবরস্থান থেকে–
—দাঁতু?
–হ্যাঁ। আজ সকালে মহা হাঙ্গামা করেছে। থাকবে না সে হাসপাতালে। কাল সারা রাত্রি নাকি ঘুমোয় নি ভয়ে।
এ কথায় মশায় যা করলেন তা বিনয়ের কল্পনাতীত। ক্রোধে ঘৃণায় তিনি যেন ফেটে পড়লেন।—দাঁতু মরবে। নিদানে আমার ভুল হয় নি। প্ৰেত দেখা দিয়েছে দাঁতুকে নেবার জন্যে। এ প্রেত দাঁতুর সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। অন্যে পায় না দেখতে, আমি পাই।
কদ্রু বিনয় স্তম্ভিত হয়ে গেল কথা শুনে। বিনয়ের মনে হল—মশায়ের মাথার গোলমাল হল না তো?
মশায় বললেন– ডাক যারা রোগী আছে। উঠব। সেতাব এল না কেন?
বিনয়ের দোকানেই এখন সেতাব আসে ছক খুঁটি নিয়ে। এখানেই বসে দাবার আসর। বেশ একটি মজলিস জমে যায়।
***
সেতাব আসে নি, সেতাবের বাড়ির দোরে নিশিঠাকরুনের ভাইঝি মারা গিয়েছে। সেই পনের বছরের মেয়ে, দুটি সন্তানের জননী—সূতিকায় যার দেহবর্ণ হয়েছিল অতসী ফুলের মত। মশায় যার নাড়ি দেখে মৃত্যু স্থির বলে জেনে এসেছিলেন। নিশি শেষ পর্যন্ত দেখিয়েছিল শশীকে। শশী বিচিত্ৰ উদ্ভট চিকিৎসা পদ্ধতিতে মেয়েটাকে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিয়েছে খেয়ার ওপারে।
শেষ তিন দিন অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় নিশি হরেনকে ডেকেছিল।
গ্রামের লোক হরেন বিনা ফিজেই দেখেছিল। কয়েকটা ইনজেকশনও দিয়েছিল। আধুনিক মূল্যবান ওষুধ।
নিশি এখন গালাগাল করছে হরেনকে।
মশায় বাড়ি ফিরবার পথে সেতাবের বাড়ি এসেছিলেন। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ফিরে গেলেন। কাল রাত্রে বিপিন মারা গিয়েছে; আজ সূর্যোদয়ের পূর্বে বিপিনের শবযাত্রায় এ অঞ্চলের আবালবৃদ্ধবনিতা ভিড় করে রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়েছিল, শ্মশান পর্যন্ত বিরাট জনতা অনুসরণ করেছে। সারাটা দিন জীবনের জ্যোতির উপর একটা ম্লান ছায়া ফেলে রেখেছে। মানুষ ক্লান্ত, শোকাৰ্ত। আর তারা পারছে না। নিশির ভাইঝির মৃতদেহের পাশে নিশি বিলাপ করে কাঁদছে, ডাক্তারকে গাল দিচ্ছে। দু-তিনটি প্রতিবেশিনী বসে আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কিপোর আর তিন-চার জন কিশোরপন্থী জোয়ান ছেলে। তারাই নিয়ে যাবে শবদেহ।
বাজারটা আজ ম্রিয়মাণ। আলো আছে। কয়েকটাই হ্যাজাক-বাতি জ্বলছে। বাতির সংখ্যা বেড়েছে এখন। ডাক্তারদের নতুন কো-অপারেটিভ মেডিক্যাল স্টোর্সে দুটো আলো জ্বলছে। একটা ভিতরে একটা বাইরে। এখনও সব ওষুধের চালান আসে নি, কিছু কিছু নিয়ে দোকান খোলা হয়েছে। চারুবাবু বসে আছেন বাইরে। হরেনও রয়েছে। বিপিনের কথাই হচ্ছে।
মশায় ভাবছিলেন নিশির ভাইঝির কথা। সেদিন ওকে দেখেই মনে পড়েছিল তার জীবনে নাড়ি-পরীক্ষা বিদ্যায় দীক্ষার দিন—তাঁর বাবা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন একটি কঠিন রোগী দেখতে। ঠিক এই রোগী। এমনই বয়সের মেয়ে, এমনি দুটি সন্তানের জননী, আর একটি গর্ভে। বাবা আসবার পথে বলেছিলেন—এই হল মৃত্যুরোগের নাড়ি! মেয়েটি বাঁচবে না, বাবা। আর একটি লক্ষণ দেখলে? মেয়েটির রুচি যাতে রোগ বাড়ে তাতেই।
মেয়েটির হাতে তেলেভাজার তৈলাক্ততা এবং গন্ধ তার দৃষ্টি এড়ায় নি। নিশির ভাইঝিও সেদিন আচার চুরি করে খাচ্ছিল। ওঃ, সেদিন মেয়েটিকে খুঁকি বলাতে ওর কী হাসি। বার বছর বয়সেই মেয়েটির প্রথম সন্তান হয়েছিল; সাড়ে তেরতে দ্বিতীয় সন্তানের মা হয়েছে; পনেরতে তৃতীয়টিকে গর্ভে ধারণ করে রয়েছে। সে খুকি!
মেয়েটা হাসলে গালের দুদিকে দুটি টোল পড়ত।
অন্ধকার রাত্রে ছায়ামূর্তির মত কে যেন মনশ্চক্ষুর সামনে দাঁড়াল। কালো কোঁকড়া একপিঠ খাটো চুল। এও মুখে কাপড় দিয়ে হাসে। এও হাসলে গালে টোল পড়ে।
মঞ্জরী বোধহয় মরেছে। মধ্যে মধ্যে নির্জন অবসরে ঠিক এমনিভাবে চকিতের মত ভেসে উঠে মিলিয়ে যায়।
হাসপাতালের কম্পাউন্ডে প্রদ্যোত ডাক্তারের বারান্দায় আলো জ্বলছে। প্রদ্যোত আজ চুপ করে বসে আছে। বোধহয় ভাবছে ডাক্তার। ডাক্তার মাত্রই ভাবে। ভাবে কোথাও কোনো ত্রুটি তার ঘটেছে কি না!
ত্রুটি ঘটে থাকলে নীরব অনুশোচনায় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকবে। অন্তরটা হায় হায় করবে। ক্ৰটি না থাকলে এমনি গ্লানিহীন উদাসীনতায় আচ্ছন্ন হয়ে বসে থাকবে। মনটা শূন্য হয়ে যায়। হঠাৎ বাতাস জাগে শূন্য-মণ্ডলে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চিকিৎসক ভাবে অসহায়, মানুষ বড়। অসহায়! কারও মনে বিদ্যুচ্চমকের মত প্রশ্ন জেগে ওঠে ডেথ! হোয়াট ইজ ডেথ!
৩২. বিছানায় শুয়েও মশায় জেগেই ছিলেন
বিছানায় শুয়েও মশায় জেগেই ছিলেন। ঘুম আসে নি। তার মনটাও উদাসীনতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ঘুম আসছে না। বিপিনের মৃত্যু এবং নিশির ভাইঝির মৃত্যু তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। দতুর কথা, ওই লোকটার উপর তিক্ততা, মনের কোণে কোণে ঢাকা পড়ে গেছে। পাশের বিছানায় আতর-বউ ঘুমুচ্ছে। পাশের খোলা জানালাটা দিয়ে খানিকটা রাত্রির আকাশ দেখা যাচ্ছে। শরতের গাঢ় নীল নক্ষত্রখচিত আকাশের খানিকটা অংশ। কানে আসছে ঝিল্লির অবিরাম একটানা ডাকের শব্দ। তিনিও ভাবছিলেন—মৃত্যু কী? অনিবার্য পরিণতি, দুৰ্জ্জেয় রহস্য—এসবে মন ভরে না। পুরাণের সেই পিঙ্গলকেশিনীর কাহিনীতেও মনের তৃপ্তি হয় না। অজ্ঞান মুমূর্ষ রোগী বিচিত্রভাবে বেঁচে উঠেছে, তাদের দু-একজন বিচিত্ৰ কাহিনী বলে। কেউ বলে সে যেন শূন্যলোকের মধ্য দিয়ে ভেসে যেতে যেতে ফিরে এসেছে; সে শূন্যলোক বিচিত্র। কেউ বলে—সে যেন সমুদ্রের মধ্য দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। দুজনের অভিজ্ঞতা একরকম নয়। এতেও নানা প্রশ্ন জাগে মনে। মন ভরে না। একটি কিশোর ছেলের কথা মনে পড়ছে। সে যা বলে গেছে তা অদ্ভুতভাবে মনে গেঁথে রয়েছে তাঁর। অনেকদিন আগের কথা। নবগ্রামের গোবিন্দ পাঠকের ছেলে নসীরাম। মৃত্যুশয্যায় মৃত্যুর বোধ করি মিনিট পনের আগে বলেছিল। সে কী ঘাম! এমন ঘাম তিনি তার সুদীর্ঘ চিকিৎসক-জীবনে কম দেখেছেন। আবীর, ঊটড়ো মাখিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেল শুশ্ৰুষাকারীরা, ফুরিয়ে গেল আবীর, শুটগুড়ো—যা আনা হয়েছিল। রোমকূপের মুখগুলি থেকে অনর্গল ঘাম বের হচ্ছিল জলাজমি থেকে জল ওঠার মত। স্তিমিত হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে কিন্তু জ্ঞান ছিল ছেলেটির। তিনি দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে দেখছিলেন। নাড়ি তার আগে থেকেই নেই। কে তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিল—নসু, নসু, নসু–! অ নসু!