কদ্রুর মৃত্যুকাল নিরূপণ করা কঠিন। ক রোগকে প্রশ্রয় দেয় না। সাবধানী লোক। কিন্তু রোগটা যেন ক্রমশ গ্রহণীতে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে মনে হচ্ছে। তার পায়ের ধ্বনি এইবার
কোনোদিন বেজে উঠবে।
এবার কদ্রু বলেছে—সুই দাও বাবা মহাশা। বেশ ভাল তেজী টাটকা আমদানি দাওয়াই দিয়ে সুই দাও।
–সুই? ইনজেকশন? মশায় হাসলেনজলদি আরাম চাই কদ্রু?
–হাঁ বাবা। বিনা কামসে খাই কী করে?
কদ্রুর ছেলেরা বড় হয়ে বাপকে ফেলে অন্যত্র চলে গেছে। স্ত্রী মরেছে। কদ্রু এখন। একা। কাজেই খাটতে হবে বৈকি।
মশায় বলেছিলেন তার থেকে তুই হাসপাতালে যা না ক! তোর সাহেবকে ধরলেই তো হয়ে যাবে।
কদ্রুর সাহেব হল কিশোর। কিশোরকে, কেন কে জানে, কিশোরের ছেলেবেলা থেকেই কদ্রু বলে সাহেব। ওই আর-একজন তার ভালবাসার জন। কিশোরকে সে ভারি ভালবাসে।
কিশোরের সঙ্গে কর আলাপ ফুটবল মেরামতের সূত্র ধরে। তখন কিশোর হাফপ্যান্ট, জারসি পরে ফুটবল খেলত। ছেলেদের দলের ক্যাপ্টেন ছিল, বোধ করি সেই কারণেই বলত। সাহেববাবু। পরে খদ্দরধারী কিশোর কত আপত্তি করেছে, কখনও কখনও ধমকও দিয়েছে। ককে, তবু কদ্রু সাহেববাবু নাম ছাড়ে নি।
কদ্রু হাসপাতালে যেতে রাজি হয় নি।–নেহি মা-বাপ। উসমে হামি যাবে না। উ সব বাবু লোক—মেমসাহেব লোক ওষুধ পিলায়, আর তা ছাড়া বাবা, দিনরাত বিস্তারায় শুয়ে থাকা, ওই সব লোকের সেবা নেওয়া কি আমার মত চামারের কাজ?
–আরে! ওই জন্যেই তো ওরা আছে। হাসপাতাল তো সবারই জন্যে। রোগী তো হল হাসপাতালের দেবতা রে। তার জন্যে তুই শরম করিস না।
—না বাবা। না।
—কেন রে? আমি বলছি ভাল হবে। তুই যে রকম নিয়ম করিস তাতে চট করে সেরে যাবি। আর রোগ হলে শুয়ে থাকাই তো নিয়ম।
—তাই তো থাকি বাবা। গাছতলায় চ্যাটাই পেড়ে বসে থাকি, বসে বসেই কাম করি। ঘুম পেলে ঘুমুই।
—সেই হাসপাতালে ঘুমোবি।
–আমি দাওয়াইয়ের দাম দেব বাবা।
–তার জন্যে আমি বলি নি করু। হাসপাতালে গেলে তোর ভাল হবে।
–নেহি বাবা। হাসপাতালে যে যাবে সে বাঁচবে না। আমি বলে দিলাম।
–কেন?
–হাসপাতালে দেও আছে বাবা। রাতমে ঘুমে ঘুমে বেড়ায়। কবরস্তানের উপর হাসপাতাল; সেই কবর থেকে ভূত উঠেসে।
মশায়ের মনে পড়ে গেল কথাটা। সেদিন রাত্রে প্রদ্যোত ডাক্তারের রান্নাঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে ভূতে নাকি মাংস চেয়েছিল। ডাক্তারেরা কেউ মাংস খান নি। পরের দিন দাঁতু ঘোষাল হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে।
মশায় ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। একটা কথা তার মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিন্তু থাক সে কথা। ভূত একবার তিনি দেখেছিলেন। সে মাছ খাচ্ছিল। রাজি তখন একটা। তিনি ডাক থেকে রোগী দেখে ফিরছিলেন। পথে নবগ্রাম ঢুকবার মুখে বাগানওয়ালা পুকুরটার ঘাটের পাশে গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিল একটা আপাদমস্তক সাদা-কাপড়-ঢাকা মূর্তি। কিছু যেন খাচ্ছিল। জ্যোৎস্নার মধ্যে হাত মুখের কাছে তোলা বুঝতে পারা যাচ্ছিল।
গাড়োয়ানটা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তিনি ভয় পান নি। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গিয়েছিলেন। দেখেছিলেন প্রেতই বটে। মাছ খাচ্ছে। সে ছবিটা যেন চোখের উপর ভেসে
উঠছে। দেখেছেন তিনি।
এবার তার মুখে এক বিচিত্র ধরনের হাসি দেখা দিল। এ সংসারে সবই আছে। ভূত প্ৰেত ব্ৰহ্মদৈত্য সবই আছে। নাই কে বলে? যদি সত্যকারের সেই দৃষ্টি থাকে তবে নিশ্চয় দেখতে পাবে।
কদ্রুকে ইনজেকশন দিয়েই চিকিৎসা তিনি শুরু করেছিলেন। বিনয়ের দোকানে নতুন আটনে ক তাঁর প্রথম রোগী। আজ আবার কর ইনজেকশনের দিন। ঠিক সে এসে দাঁড়িয়েছে।
মশায় জিজ্ঞাসা করলেন–কেমন আছিল?
—না—না। ঘাড় নাড়লে করু। ভাল না বাবা মহাশা। ভাল না। থোড়াথুড়ি বুখার ভি হয়।
–দেখি, হাত দেখি। হাত ধরে মশায় বললেন–বড় যে দুর্বল হয়ে পড়েছিস করু। অসুখ বেড়েছে? বেশি ঝাড়া যাচ্ছি?
—না বাবা। কম হোয়েসে। সো তো কম হোয়েসে।
–তবে? খাচ্ছিস কী?
–কী আর খাব বাবা? থোড়াসে বার্লিকে পানি। ব্যস। আর কুচ্ছ না। কুছ না।
–কিন্তু খেতে যে হবে রে। না খেয়েই এমন হয়েছে।
–ডর সে মারে, খেতে পারি না বাবা মহাশা।
–ডর করলে হবে না। খেতে হবে। না খেয়েই তুই মরে যাবি।
—মরণকে তোডর নেহি বাবু। বেমারির দুঃখকে ডর করি বাবা। খানাপিনা করব, যদি বেমারি বাড়ে? পেটকে দরদ যদি বেড়ে যায় বাবা? শেষে কি ময়লা মিট্টি মেখেই মরব বাবা?
মশায় আজও বললেন–তুই হাসপাতালে যা। তোর সাহেববাবু রয়েছেন বলে দিলেই হয়ে যাবে। আর তুই যে রকম রোগী, হয়ত অল্পেই ভাল হয়ে যাবি।
কদ্রু বললেওই তো বাবু, এত বড়া বাবু এতনা কিস্মত-কাঁচা উমরমে চলিয়ে গেল। এতনা দাওয়াই, ভারী ভারী ডাকডর! কী করলে হুজুর? কুছ না। হুজুরকে বাতই সাচ হইয়ে গেল।
–কী? মশায় আর্ত চকিত স্বরে প্রশ্ন করলেন।
–হুজুর তো বলিয়ে দিয়েছিলেন বাবু নেই জীয়েগা, ওহি তো সত্যি হইল হুজুর। কলকাত্তা সে ডাকডর আইল—কুছ হইল না।
মশায়ের সমস্ত শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল। এ কী বলছে কদ্রু! চুপ করে বসে রইলেন তিনি, আত্মসংবরণ করছিলেন।
কদ্রু বলেই গেল—আর বাত আছে বাবা। উ রোজ আপনাকে বলিয়েছি, বিনয় বাবা ভি জানে হাসপাতালমে পিরেত আছে, হঁয়া কোই নেহি বঁচেগা।
বিনয় বাইরে দাঁড়িয়েছিল—ঘরে এসে ঢুকল। বললে—মিথ্যে বলে নি করু। সেদিন প্রদ্যোত ডাক্তারের বাসায় খাওয়াদাওয়ার জন্যে মাংস রান্না হয়েছিল। জানালার বাইরে থেকে ভূতে মাংস চেয়েছিল। ডাক্তারের রাঁধুনী বামুন চোখে দেখেছে। গণেশ ভটচাজের মেয়ের প্রসব হয়েছিল হাসপাতালে, ডাক্তার কেসটা খুব বাঁচিয়েছে। সে মেয়ে ভয়ে বাঁচে না। গণেশ তাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে।