হরেন আবার ছুটে গেল কলকাতা। ডাঃ চ্যাটার্জি বললেন–ওইটেই আমার আশঙ্কা ছিল। তাই দাঁড়াল। এখন
একটু চিন্তা করে বলেছেন হাতে আর কিছু নেই।
ঘাড় নেড়েছেন বার বার।-নাঃ, হাত নেই। শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন-ডিজিটিলিস ইনট্রাভেনাস দিয়ে দেখ।
হরেন আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল শুনে। ডিজিটিলিস ইনট্রাভেনাস? আপনি চলুন তা হলে।
–আমি? আমি গিয়ে আর কী করব? আমি তো বলছি—সামনে চরম অবস্থা। ধ্রুব বললেই হয়। এখন চান্স নিয়ে দেখতে পার। যদি ভাল করে, ক্রাইসিসটা কাটবে। ক্রাইসিসটা কাটলে দরকার হয় যাব।
কিন্তু সে ঝুঁকি এখানে কেউ নিতে চায় নি। হরেন চারুবাবু কেউ না। প্রদ্যোত একটু ভেবেছিল। শেষ পর্যন্ত সেও সাহস করে নি। মনে অস্বস্তিরও শেষ ছিল না।
বিপিনবাবুর তখনও জ্ঞান ছিল। কলকাতার ডাক্তার না আসতেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। নিজেকে প্রস্তুত করতে গিয়েই বৃদ্ধ পিতার দিকে লক্ষ্য করে ওই কথাগুলি বলেছিলেন।
–এ লজ্জা রাখবার আমার ঠাঁই নাই। মরণের আগেই আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি। আপনাকে দুঃখ দিয়ে গেলাম। শত্ৰু-পুত্রের কাজ করে গেলাম।
অসাধারণ মানুষ রতনবাবু। বিষণ্ণ হেসে তিনি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন তুমি আমার বীরপুত্র। জীবন-সংগ্রামে ভয় পাও নি, পিছু হট নি, বিশ্রাম নাও নি—যুদ্ধ করতে করতেই পড়লে; তার জন্য লজ্জা কী?
–লজ্জা? বৃদ্ধ বয়সে আবার আপনাকে বর্ম পরতে অস্ত্র ধরতে হবে। এ থেকে আপনাকে আমি রক্ষা করতে পারলাম না। এই লজ্জা। এই তো আমার চরম হার।
রতনবাবু ছেলের মাথায় হাত রেখে চোখের জলের সঙ্গে ঠোঁটের বিচিত্র হাসির সঙ্গে বলেছিলাম—কার কাছে হার? যার কাছে তোমার হার তার কাছে রাম কৃষ্ণ বুদ্ধ থেকে ভীষ্ম দ্রোণ নেপোলিয়ান-হার মেনেছে। ও কথা ভেবো না।
ঘাড় নেড়ে বিপিন বলেছেনা। আর আমার নিজের কাছে। ডাক্তার চ্যাটার্জি আমাকে বার বার বলেছিলেন, এ কর্মজীবন আপনি ছাড়ন। এ রোগ রজগুণের রোগ, রাজসিকতা সব ছেড়ে সাত্ত্বিক জীবন না হলে আপনার রোগ সারবে না, বাড়বে। আমি বলি নি কাউকে। চেষ্টা করেও পারি নি ছাড়তে। আর আমার নিজের কাছে।
এরপর আর কিশোর ঘরে থাকতে পারে নি। বেরিয়ে চলে এসেছিল। এর আগের দিন থেকেই বিপিনের প্রস্রাব বন্ধ হয়েছিল। তারই পরিণতিতে ক্রমশ মোহাচ্ছন্ন হয়ে বিকেলবেলা পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। রাত্রি এগারটার সময় মৃত্যু হয়েছে।
সমস্ত গ্রামটা—শুধু গ্রামটা কেন, এ অঞ্চলটা বিপিনের মৃত্যুতে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে। এত বড় একটা মানুষ, কৰ্মবীর, স্বনামধন্য পুরুষ। তার মৃত্যুতে হওয়ারই কথা। সকালবেলা শবযাত্রার সময় কাতারে কাতারে লোক ভেঙে এসেছে। স্লান বিষণ্ণ মুখ। সমস্ত অঞ্চলটার আকাশে যেন একটা ছায়া পড়েছে। জীবনমশায়ও উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন বাইরের দিকে। মৃত্যুমুখরা পৃথিবী! হেন ক্ষণ নাই যে ক্ষণে লয় না ঘটছে, মৃত্যুর রথ না চলছে। জীবন জন্ম দিয়ে মৃত্যুকে ছেয়ে ফেলতে চেষ্টা করছে। তবু তাকে জানা যায় না, জানবার উপায় নাই। তাই তাকে এত ভয়। মধ্যে মধ্যে তো ভয় ঘোচে, মানুষ তো জয় করে মৃত্যুভয়কে, দলে দলে তো ছুটে চলে মৃত্যুবরণ করতে। তখন তো মৃত্যু অমৃত হয়ে যায়। বিপিন যে ধরনের মানুষ, যে শিক্ষা সে পেয়েছিল, তাতে তার দেশের জন্যে মৃত্যুবরণ করা আশ্চর্যের কথা ছিল না, তাই যদি সে করত, তবুও কি এমনি ছায়া পড়ত? তা তো পড়ত না! অকস্মাৎ মশায়ের খেয়াল হল, কিশোর কখন উঠে গিয়েছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন মশায়। তারপর নিজের নাড়িটা ধরে বসলেন।
কিছু বুঝতে পারা যায়? কোনো বেলক্ষণ, কোনো ইঙ্গিত? না।
–হাত দেখছেন? নিজের? বিনয় এসে ঢুকল।
–হ্যাঁ। শরীরটরীর—
–না। হাসলেন মশায়।
–ক এসেছে। ওর আজ ইনজেকশনের দিন।
–কই?
–হুজুর! এসে দাঁড়াল বুড়ো জুতো-সেলাইওয়ালা।
বিনয়ের এখানে কই তার প্রথম রোগী। রানা সেদিন এখানে আসবার আগেই সে এসেছিল। বুড়ো, আমাশয়ের রোগী। পুরনো রোগ। কিন্তু আশ্চর্য রোগী। এমন সাবধানী রোগী আর দেখা যায় না। রোগ তার দুরারোগ্য, আজও সারল না। কিন্তু ককে কখনও পাকড়াও করতে পারলে না। রোগ বাড়লেই ক খাওয়াদাওয়া প্রায় ছেড়ে দেয়। চিকিৎসক যদি বলেন—এক পোয়া খাবে তবে সে আধ পোয়র বেশি খাবে না।
বাতিক তার ওষুধের। বার মাসই একটা-না-একটা ওষুধ তার খাওয়া চাই-ই। তা সে ডাক্তারি, কবিরাজি, হাকিমি, টোটকা যা হোক। পালা আছে। কিছুদিন ডাক্তারি তারপর কিছুদিন
কবিরাজি।
কদ্রু তার পুরনো রোগী। কদ্রু এ দেশের লোক নয়। বোধ করি বিলাসপুর অঞ্চলের চর্ম-ব্যবসায়ী। সেকালে এ দেশে তাদের যে প্রথম দল এসেছিল তাদের মধ্যে ছিল করু। কদ্রু তখন নূতন জোয়ান, সঙ্গে বউ আর একটি ছেলে।
মশায় সেকালে ওর ছেলেটাকে কঠিন রোগ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। সেই কারণে কৰ্ম্ম মশায়কে দেখলেই এসে পথ রোধ করে দাঁড়াত। জুতোটা বুরুশ করে দিব মহাশা।
জুতো পরিষ্কার না করিয়ে উপায় ছিল না তার। দাঁড়াতেই হত। সে যেখানেই থোক। বাজারে, হাঁটে, স্কুলের সামনে, সবরেজিস্ট্রি আপিসের অশ্বত্থতলায়—করু এক-একদিন একএক জায়গায় পালা করে বসত। সেদিক দিয়ে যেতে হলেই ককে দিয়ে জুতো পালিশ করিয়ে নিতে হত।
পয়সা অবশ্যই দিতেন মশায়। কর আগ্রহের দাম দেওয়া যায় না। বনবিহারীর মৃত্যুর পর যখন তিনি ঘর থেকে বের হতেন না তখনও মধ্যে মধ্যে কদ্রু বাড়ি গিয়ে জুতো পালিশ করে দিয়ে এসেছে। তখন কোনোদিন পয়সা পেয়েছে কোনোদিন পায় নি। আজ বছর কয়েক কদ্রু বুড়ো হয়ে অক্ষম হয়েছে। সবরেজিস্ট্রি আপিসের অশ্বত্থতলাটি ছাড়া অন্য কোথাও আর যায় না, যেতে পারে না। বিনয়ের দোকান সাবরেজিস্ট্রি আপিসের কাছেই। এবার কদ্রু ঠিক এসে হাজির হয়েছে। জুতোও সাফ করে দিয়েছে। এবার অসুখটা বেশি।