রানা খুশি হয়ে উঠল। বললে—আজ্ঞে হ্যাঁ। যা বললেন– আমি তাই করব। কাল আমি গাড়ি করে বিনয়ের দোকানেই আসব। আর একটা কথা আছে আমার, রাখতে হবে।
–কী, বল? হাসলেন মশায়।
–সে মেয়েটার ব্যামো আমার চেয়েও বেশি। বাঁচবে না। তবে রোগ তো একই। তাকেও আমার সঙ্গে দেখুন না কেন? আপনি বিশ্বাস করুন, আদি। তাকে ছোব না। কিন্তু তাকে যখন আশ্রয় দিয়েছি—আর ধরুন—তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। একটা দায় তো আমার আছে। তাকে আজ তাড়িয়ে দেওয়াটা কি আমার পাপ হবে না? সে হতভাগী আবার কোথায় কার ঘরে যাবে, বিষ ছড়াবে!
—এনো। তাকেও এনো। দেখব।
রানা চলে গেল। মশায় বিনয়কে বললেন–এই জন্যেই রানাকে আমি এত ভালবাসি।
বিনয় হেসে বললে—আমাকেও বাসেন। আমার দোকানে বসতে রাজি হয়ে আমার কী মুখটা যে রেখেছেন আপনি—সে কী বলব?
ইন্দির এসে দাঁড়াল। একখানা ফর্দ হাতে দিলে। বললে—একবারে মাসকাবারি হিসেব করে জিনিস নিয়ে এলাম। এই ফর্দ।
মোয় হাসলেন, বললেন–উত্তম। গিনিকে দাও গে, রেখে দেবে। না হয় ফেলে দেবে। কমিশনে কুলোয় ভাল, না হলে বিনয়কে তালগাছ দিলেই হবে।
বিনয়ের দোকানে বিকেলবেলা বসতে তিনি রাজি হয়েছেন। অহি সরকারের বাড়ি থেকে এসে রানার পাশে বিনয়কে বসে থাকতে দেখেই বলছেন—এসেছিস? আচ্ছা তাই হল, বসব তোর দোকানে। ইন্দির চলে যেতেই সেতাবের দিকে তাকিয়ে মশায় বললেন–বলছিলাম না, সংসারচক্র! এই দেখ বিনয়চন্দ্র মাসকাবারি জিনিস পাঠিয়ে দিয়েছে।
সেতাব বসে ছিল ঘরের কোণে। সামনে দাবার ছকটি বিছিয়ে দুদিকেই খুঁটি সাজিয়ে নিবিষ্ট মনে খেলে যাচ্ছিল।
এতক্ষণে মুখ তুলে সেতাব বললে—তালগাছ বেচতে গিনি রাজি হয়েছে?
জীবন মশায়ের লাইকার পুকুরে পঁচিশটা তালগাছ আছে। সোজা এবং সুদীর্ঘ আর বহু পুরনো। এ অঞ্চলে গাছ কটির খ্যাতি বহুবিস্তৃত এবং সর্বজনস্বীকৃত। এমন পাকা সোজা তালগাছ। একালে সুদুৰ্লভ। ওই গাছ কটি আতর-বউয়ের সম্পত্তি, তার বক্ষপঞ্জর বললেও অত্যুক্তি হয়। না। যুদ্ধের আগেই এসব গাছের দাম ছিল তিরিশ টাকা। এখন আশি-নব্বই টাকা লোকে হাসিমুখে দিতে চায়। কিন্তু আতর-বউ তা দেবেন না। ছন্নমতি লক্ষ্মীছাড়া ভাগ্যহীন স্বামীর উপর তাঁর আস্থা নাই। পঁচিশটির দশটি নিজের এবং দশটি স্বামীর পারলৌকিক ক্রিয়ার জন্য রেখেছেন। পাঁচটি রেখেছেন আপকালের জন্য।
জীবনমশায় হেসে বলেন-কুড়িটি হল ভবসাগর পারের ভেলা। আর পাঁচটি হল শেষ বয়সে খানা-খল পার হওয়ার নড়ি। তা বিনয় বলেকয়ে ওই পাঁচটি নড়ির থেকে একটা দিতে রাজি করেছে। বলেছে, টাকাটা পোস্টাপিসে জমা রেখে দেব।
৩১. বিপিনবাবুর শেষ কথা
এ লজ্জা রাখবার আমার আর জায়গা নাই। মৃত্যু হবার আগেই আমি মরে গেলাম লজ্জায়। আমি আপনাকে দুঃখ দিয়ে গেলাম। শত্ৰু-পুত্রের কাজ করে গেলাম।
কথাগুলি বিপিনবাবুর প্রায় শেষ কথা। বলে গেছে বাপকে। রতনবাবুকে। এ দেশে চলতি একটা প্রাচীন ধারণা আছে;–পূর্বজন্মের ক্ষুব্ধ শত্রু পরজন্মে পুত্র হয়ে জন্মায়, বড় হয়, মাবাপের মনে বিপুল প্রত্যাশা জাগিয়ে তোলে, তারপর একদিন সে মরে, নিষ্ঠুর আঘাত দিয়ে–পূর্বজন্মের শত্ৰু এ জন্মের বাপের উপর শোধ নিয়ে যায়। মৃত্যুর পূর্বে উচ্চশিক্ষিত বিপিনও এ ছাড়া বলবার কথা খুঁজে পায় নি।
দিন বিশেক পরের কথা।
মশায় বসে ছিলেন বিনয়ের দোকানে। কথাগুলি বলছিল কিশোর। গতকাল বিপিন রাত্রি সাড়ে এগারটায় মারা গিয়েছে। দশ দিন আগে ডাক্তারেরা বলেছিলেন বিপিনবাবু ভাল আছেন। অন্তত এবারের মত বিপদ কেটেছে। এবং আর অবস্থা খারাপ না হলে ধীরে ধীরে সেরে উঠবেন। আটদিন আগে কলকাতা থেকে ডাক্তার চ্যাটার্জি এসেছিলেন। তিনি ডাক্তারদের মত সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু উৎসাহের সঙ্গে নয়।
রতনবাবু একবার মশায়ের কথা তুলতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন–আমাদের এখানে একজন। নাড়ি দেখার বিশেষজ্ঞ আছেন। তিন পুরুষ ধরে নাড়ি দেখার সুনাম। নিদান দিয়েছেন।
বাধা দিয়ে প্রদ্যোত বলেছিল—তার কথা বিশ্বাস করলে—
ডাঃ চ্যাটার্জি ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলেছিলেন কী বলেছেন তিনি? নিদানটিদান দিয়েছেন নাকি?
–না। তা ঠিক বলেন নি—তবে–।
ডাঃ চ্যাটার্জি বলেছিলেন-হাত দেখায় অবিশ্বাস আমি করি না, আমার বয়স হয়েছে। প্রথম জীবনটা হাত দেখার উপর নির্ভর করতে হত অনেকটা। আমাদের ডাক্তারেরাও অনেকে খুব ভাল হাত দেখতে পারতেন। পারেন। কিন্তু চিকিৎসা যখন আমরা করছি আমাদের কথাই বিশ্বাস। করুন। তিনি হয়ত বলেছেন—রোগ একেবারেই অসাধ্য। এই এতদিনের মধ্যে কিছু হবে। আমরা বলছিনা হতেও পারে। অসাধ্য রোগ আমরা বলব না। শেষ পর্যন্ত লড়াই করব। তার কথায় বিশ্বাস করলে রোগীকে আত্মীয়স্বজনকে হাল ছেড়ে দিয়ে চরম দুর্ঘটনার জন্যই শুধু অপেক্ষা করতে হবে।
তারপর আবার বলেছিলেন—একটু হেসেই বলেছিলেন-আমিও এদেশের লোক, ডাক্তারি করি অবশ্য। কিন্তু যা তিনি বলেছেন—তা তো বুঝছি। সে তো একটা বড় জিনিস। কষ্টদায়ক দুঃসাধ্য ব্যাধি, কোনোক্রমে বাঁচলেও সে জীবন্ত হয়ে বেঁচে থাকা। এবং সংসারে জন্ম হলেই যেখানে মৃত্যু ধ্রুব সেখানে যদি অনায়াসে স্বচ্ছন্দে জীর্ণ অকেজো দেহটার পতনই কাম্য মনে করতে পারেন, সে তো বড় জিনিস। সেটা আপনাদের দিকের কথা, আমরা বলব কেন?
ডাঃ চ্যাটার্জি চলে যাবার তিন দিন পর রোগ হঠাৎ বেঁকে দাঁড়াল। প্রস্রাবের রঙ খারাপ হল, পরিমাণে কমে গেল। এবার প্রস্রাব পরীক্ষার ফল দাঁড়াল শঙ্কাজনক। হার্টের অবস্থা খারাপ। দাঁড়াল। হার্টে রেট একশো তিরিশ। এবং গতি তার বাড়বার দিকে।