দাঁতু ঘোষাল ভাল আছে। বিপিনবাবু ভাল আছেন। মতির মা বর্ধমান থেকে ফিরে এসেছে। কাল। বুড়ির পায়ের যন্ত্রণা কাল রাত্রে বেড়েছে একটু। এই এখুনি এখানে আসার পথে, মতি মুখ-শুকনো করে দাঁড়িয়ে ছিল; বলেছে—ডাক্তারবাবু মায়ের পায়ের যন্ত্রণা যে বেড়ে গেল কাল রাত্রি থেকে! তা হলে?
প্রদ্যোতের বুঝতে বাকি থাকে নিমতি যা বলতে চাইছে অথচ মুখে উচ্চারণ করতে পারছে না, সে কথাটা কী? একবার মনে হয়েছিল বলে, তা হলে মশায় যা বলেছিল তাই কর। খোল করতাল বাজিয়ে নিয়ে যাও গঙ্গাতীরে। কিন্তু আত্মসংবরণ করেছে। বলেছে আসবার সময় দেখব। কিছু নয়, ট্রেনে আসবার সময় পা নিয়ে নড়াচড়া হয়েছে, সেইজন্য বেদনা হয়ে থাকবে।
প্রদ্যোতকে সাদর সম্ভাষণ মশায়ই জানালেন—আসুন। রোগী আপনার দিব্যি কথা বলছে। ভাল আছে।
কপালে হাত ঠেকিয়ে নীরবে প্রতি-নমস্কার জানিয়ে রোগীর বিছানার পাশে বসল।
মশায় বললেন–আমি দেখেছি—
মধ্যপথে বাধা দিয়ে প্রদ্যোত বললে–আমি দেখি।
–বিপদ কেটে গিয়েছে।
–না। বলেই প্রদ্যোত প্রশ্ন করলেন–রাত্রে প্রস্রাব কেমন হয়েছে বলুন তো?
বৃদ্ধ বুঝতে পারছেন না, ওষুধের প্রতিক্রিয়া আছে। প্রস্রাব বন্ধ হতে পারে। পেটে ফাঁপ দেখা দিতে পারে।
প্রস্রাব কমই হয়েছে। রাত্রি বারটা থেকে সকাল পর্যন্ত একবার। পেটে ফাপ রয়েছে একটু। রোগী বেশ কয়েকবার জলের মত তরল মলত্যাগও করেছে, পেটের দোষ হয়েছে। প্রদ্যোত ডাক্তার গভীর মনোযোগর সঙ্গে দেখে তারপর ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বের করলে।
ইনজেকশন শেষ করে প্রদ্যোত উঠল। কই? মশাই কই?
–নাই। চলে গিয়েছেন। অহি সরকার বললে, ওঁর আরোগ্য-নিকেতন থেকে ডাকতে এসেছিল।
প্রদ্যোত একটু দাঁড়িয়ে ভেবে নিল। সে কি কোনো রূঢ় কথা বলেছে? না। বলে নি।
অহি বললে—উনি বলে গেলেন আমাকে ডেকে, বিপদ কেটে গিয়েছে। আপনার খুব প্রশংসা করে গেলেন। বললেন, খুব যুঝেছে। খুব সাহস। খুব ধীর।
প্রদ্যোত বললে, প্রস্রাবের উপর নজর রাখবেন। একটু দেরিতেই হবে। তবু লক্ষ্য রাখবেন। আর পেটে ফাপ একটু রয়েছে ওই ফাঁপটা দেখবেন। বাড়ছে মনে হলেই আমাকে খবর দেবেন। আর একটা কথা, মশায় নাড়ি দেখছেন বার বার, এটা ঠিক হচ্ছে না। আপনারাও চঞ্চল হতে পারেন। আমারও একটু কেমন মনে হয়। বেরিয়ে এল সে।
সাড়ে আটটা বাজছে। হাসপাতালে কত কাজ, কত কাজ! কম্পাউন্ডার হরিহর এখানকার লোক, বয়স হয়েছে। লোকটি আশ্চৰ্য শিথিল-চরিত্র। হবে-হচ্ছে করেই চলা স্বভাব। দু-দশ মিনিটে কী আসে যায়? নার্সরাও সুবিধে পায়।
মঞ্জুকে বলে এসেছে। সে অবশ্য দেখবে। নিয়মিতভাবে সে এসব দেখে। এদিক দিয়ে সে ভাগ্যবান। মঞ্জু তাঁর কর্মের বোঝার ভার মাথায় তুলে নিয়েছে। রোজ সকালে একবার নিজে সে রোগীদের খোঁজ নিয়ে আসে, মিষ্ট কথায় সান্ত্বনা দিয়ে আসে। হাসপাতালটির পরিচ্ছন্নতার দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার। নিজের বাড়ি থেকে মধ্যে মধ্যে পথ্য তৈরি করে দিয়ে আসে। মেয়েদের সম্পর্কে বলতে গেলে মঞ্জুর জন্যই সে নিশ্চিন্ত। রোগিণীদের ও দিদি। ষাট বছরের রোগিণীও দিদি বলে।
এই দাঁতু ঘোষালটা তো মঞ্জুকে পেয়ে বসেছে। হাসপাতালের ভাতের সঙ্গে মঞ্জুর পাঠানো তরকারি ভিন্ন চিৎকার করবে। মঞ্জুকে রাজ্যের ভূত-প্রেতের গল্প বলে ভাব জমিয়েছে দাঁতু ঘোষাল। লোটা অত্যন্ত পাজি। হাসপাতালে থেকেও কী করে যে ও গাঁজা খায়-গাঁজা পায়–বুঝতে পারে না প্রদ্যোত। ওকে তাড়িয়েই দিত সে। কিন্তু মশায়ের নিদানটার জন্যই রেখেছে। দেখবে সে।
আরোগ্য-নিকেতনের সামনে দিয়ে যাবার পথে নজরে পড়ল-মশায় কার হাত দেখছেন। ঘাড়টি ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছে। বোধ করি চোখ বন্ধ করে রয়েছেন। প্রদ্যোত হাসলে। সে শুনেছে, বিনয় মশায়কে তার দোকানে বসবার জন্য ধরেছে। অন্তত কিছুকালের জন্য। যতদিন সে কোনো পাস-করা ডাক্তারকে এনে বসাতে না পারে!
রানার হাতই দেখছিলেন মশায়। ভুজঙ্গগতি। কুটিল সর্পিল ভঙ্গি। এ সাপ রাজগোরই বটে, দেহ-বিবরের মধ্যে বাসা বেঁধেছে; তার বিষ-নিশ্বাসে সারাটা দেহ অহরহই জ্বরজর্জর। গায়ের গন্ধ থেকেও বুঝতে পারছেন। সাপের গায়ের গন্ধ চেনে যে প্রবীণ বিষবৈদ্য, গর্তের বাইরে বসেও তার গায়ের গন্ধ পায়। সে গন্ধ তিনিও পাচ্ছেন। ধীরে ধীরে এবার চোখ খুলে চাইলেন। রানার মুখের দিকে তাকালেন। চোখের চারিপাশে কালো ছায়া পড়েছে; চোখ দুটি ক্লান্তিতে কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্রের মত বিষণ্ণ, তার চারিপাশে রাহুর উদ্যত গ্রাসের মত গাঢ় কৃষ্ণমণ্ডল। রানার হাতখানি ছেড়ে দিয়ে বিষণ্ণ হেসে বললেন–রোগ তাই বটে বাবা।
রানা হেসেই বললেসে তো আমি জানি গো! নিজে তো গোড়া থেকেই বলছি। তা কী বুঝছেন? বাঁচব? ভাল হবে? না? একটু হেসে বললে—যদি মরি তো কতদিনে মরব? বলুন। আপনি, অসঙ্কোচে বলুন। রানা ভয় করে না।
মশায় চুপ করে রইলেন। ভাবছিলেন নূতন ওষুধ উঠেছে স্ট্রেপ্টোমাইসিন, তার কথা। সে নাকি অব্যৰ্থ।
রানা আবার বললে–বলুন গো! আপনি মশায়, আপনি ভয় করছেন কেন গো!
মশায় বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন। তিনি হঠাৎ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন– আজও কিছু বলব না বাবা। তুমি কাল বিকেলে আসবে—এখানে নয়, বিনয়ের দোকানে। ওখানেই আমাকে পাবে। কিন্তু হেঁটে এমন করে এসো না, গরুর গাড়ি করে আসবে। হাঁটাহাটি পরিশ্রম এসব এখন স্থগিত রাখ। আর সেই মেয়েটির সংস্রব একেবারে পরিত্যাগ করতে হবে। বুঝেছ?