বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল মশায়ের মুখে। রানার অন্তরের ক্ষোভটুকু তিনি অনুভব করতে পারলেন। রানাদের জাত আলাদা। এ কথা ওরাই বলতে পারে।
রানা বলে গেল—আপনাকে বলেছি, একটি মেয়েলোক থেকে আমার মত অসুরের দেহে রোগটা ঢুকে গেল। কলকাতার এক হতভাগিনী মেয়ে। কলকাতার দাঙ্গার সময় গুণ্ডারা তাকে লুট করে। তারপর এখান ওখান করে তার লাঞ্ছনার আর বাকি রাখে নি। কোথা সেই বেহার পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে আবার কলকাতা–কলকাতায় আমাদের গায়ের ওপাশে গঙ্গারামপুরের মুসলমান গুণ্ডা রহমত ওকে পায়, সে তাকে বোরখা পরিয়ে নিয়ে আসে এখানে। নদীর ঘাটে নৌকোর উপর উঠিয়েছিল। আমি লগি ধরেছিলাম। আমার গলায় পৈতা। এই দেহ। তার ওপর লগিতে ঠেলা দিয়ে হক মারলামজয় কালী! সব হরি হরি বল! নৌকোতে সবই প্রায় হিন্দু। সবাই হরিবোল বলে উঠল। মেয়েটা তখন সাহস পেয়ে বোরখা ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠল—আমাকে বাঁচাও, আমি হিন্দুর মেয়ে। ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। রহমত ছুরি বার করেছিল কিন্তু আমার হাতের লগি তখন উঠেছে। মেরে উঠলাম হাঁক! রানা পাঠককে রহমত জানে। বেটা ঝপ করে নদীতে লাফিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গীটা। মেয়েটাকে নিয়ে গেলাম বাড়ি। মুসলমানেরা এল। বললে—দিয়ে দাও, নইলে ভাল হবে না। আমি বললাম মন্দকে ভয় করে না রানা, তা তোরা জানিস। পারিস নিয়ে যাস সেই মেয়ে। বাড়ি ফিরতে চাইলে না। থেকে গেল। তাপরেতে ঘি আর আগুন; জানতাম না মেয়েটার এ রোগ আছে। মেয়েটাও জানত না ঠিক। ক্রমে জানা গেল। কিন্তু তখন ওকে ছাড়া আমার সাধ্যর বাইরে। চরিত্রহীন বলছে বলুক, আমি ওকে বিয়ে একরকম করেছি। ভালবেসেছি মেয়েটাকে। ভালবাসতে গিয়ে রোগ ধরেছে, তার রোগ নিয়েছি, তাতে আমার লজ্জা নাই। সে যে যা বলবে বলুক। মরেও আমার সুখ। আর চারুবাবু বলে কালীর কথা। কালীর কাছে রোগ সারে কি না জানি না। তবে মায়ের ইচ্ছে হলে সারে। কিন্তু কালীর কাছে রোগ সারিয়ে দাও-এ বলতে আমি শিখি নাই মশায়। কালীর কাছে চাই—কালকে যেন ভয় না করি। তাকেই বলে মোক্ষ। কালীর কাছে চাই কালীর কোল! আপনি আমাকে ঘেন্না করবেন না, মাকালী নিয়েও তামাশা করবেন না আমি জানি। তাই আপনার কাছে আরও আসা।
তা তিনি করবেন না। করেন না। তাঁর বাবা বলতেন—রোগীকে রোগ নিয়ে কখনও কটু কথা বোলো না। কখনও শ্লেষ কোরো না। পাপ-পুণ্যের সংসারে মানুষ পুণ্যই করতে চায়, কিন্তু পারে না। শাসন কোবরা, ধমক দিয়ো, প্রয়োজন হলে ভয়ও দেখিয়ো। কিন্তু মর্মান্তিক কথা বোলো না, আর রোগী শরণাপন্ন হলে ফিরিয়ে দিয়ো না।
গুরু রঙলাল বলতেন মানুষ বড় অসহায়, জীবন। রাগ কোরো না কখনও। ঘৃণাও না।
গুরু রঙলাল অনেক ক্ষেত্রে রোগীর গালে চড় মেরেছেন। ভূপী বোসকে মেরেছিলেন। এক। শৌখিন তান্ত্রিক লিভারের কঠিন অসুখ নিয়ে এসেছিল তার কাছে। তিনি মদ খেতে নিষেধ করেছিলেন। সোজা কথা ছিল তাঁর। বলেছিলেন মদ খেলে বাঁচবে না। মদ ছাড়তে হবে। রোগী বলেছিল—কিন্তু আমার সাধনভজন? রঙলাল ডাক্তার বলেছিলেন–বিনা মদে কাসার পাত্রে নারকেল জল-টল দিয়ে করবে। পাঁঠা বলির বদলে মাষকলাই ছড়িয়েও তো হয় হে। লোকটা জিভ কেটে বলেছিল—বাপ রে! তা হলে আর মা দেখাই দেবেন না! ও আমার মায়ের আদেশ! মা আমাকে দেখা দিয়ে বলেছেন ডাক্তারবাবু। রঙলাল ডাক্তার খপ করে তার চুলের মুঠো ধরে বলেছিলেন কী বললি? মা তোক দেখা দিয়ে এই কথা বলেছেন? মিথ্যেবাদী! মা মদ খায়? খেতে বলে? যে মদে লিভার পচে–সেই মদ?
জীবনমশায় জানতেন—এ রোগী বাঁচবে না। প্রবল রিপুপ্রভাবে সে অসহায়। বাঁচেও নি সে।
মানুষ অসহায়, বড় অসহায়! প্রবৃত্তির তাড়নায় সে মর্মান্তিক কলঙ্ক-কাহিনী রচনা করে চলে। আজ রচনা করে—কাল অনুশোচনা করে, নিজেকেই নিজে অভিসম্পাত দেয়। মনে মনে ভাবে আকাশে সূর্য নিভে যাক; কাজ নাই, আলোতে কাজ নাই। অন্ধকারে ঢাকা থাক সব। বহু দেখেছেন তিনি। উপার্জনক্ষম পুত্রের মৃত্যুশয্যায় পিতাকে উইল তৈরি করিয়ে নিতে দেখেছেন বধূকে বঞ্চিত করে। আরও কঠিন পাপ করতেও দেখেছেন। ভাই-ভাগ্নে এদের কথা তিনি ধরেন না। পুত্রকেও ক্ষমা করেন তিনি। স্ত্রীর মৃত্যুশয্যায় স্বামীর ব্যভিচারে লিপ্ত থাকার ইতিহাস অনেক। স্বামীর মৃত্যুশয্যায় স্ত্রীও ব্যভিচার করে, ভ্ৰষ্টা স্ত্রী। ভ্ৰষ্টা নয় এমন অনেককে গোপনে মাছ চুরি করে খেতে দেখেছেন এই কঠিন লগ্নে। শুধু মা, মায়ের পুণ্য অক্ষয়।
মানুষ বড় অসহায়!
মশায় একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। রানা ডাকলে—মশায়!
–একটু বসে জিরিয়ে নাও বাবা। কথা বোলো না। অনেকটা হেঁটেও এসেছ। একটু পরে দেখব। বোসা। আমি এদের এই ছেলেটাকে দেখে আসি।
অতসীর ছেলে আজ ভাল আছে। জ্বর কম, ফুলোটাও কমেছে। ফুলোর উপরের রক্তাভার গাঢ়তাও কম হয়েছে। পরিধি কমে নি, কিন্তু বাড়ে নি, থমকে দাঁড়িয়েছে। কাল সকালে জ্বর ছিল একশো দুইয়ের কাছাকাছি, আজ সকালে জ্বর একশো একের নিচে। চৈতন্যের উপর আচ্ছন্নতার যে একটি আবরণ পড়েছিল, সেটি কেটে এসেছে; কুটকুট করে দু-চারটি কথা বলছে। ঠিক সাতটার সময় প্রদ্যোত ডাক্তারের বাইসিকেলের ঘণ্টা বেজে উঠল। ভোর পাঁচটার ট্রেনে সদর শহর থেকে অরুণেন্দ্র ব্লাড রিপোর্ট পাঠিয়েছে। কঠিন রোগ, মারাত্মক সংক্ৰমণ হয়েছিল—অরুণেন্দ্র রিপোর্টে লিখেছে উইথ এ টেন্ডেন্সি টু ইরিসিপ্লাস। চিকিৎসা তার নির্ভুল হয়েছে। রিপোর্টের জন্য কী উৎকণ্ঠাতেই কাল দিনরাত্রি সে কাটিয়েছে। পৃথিবীতে অমৃতই শুধু ওষুধ নয়, বিষও ওষুধ। কাল দিনরাত্রে এমনি ওষুধ অনেকটাই সে দিয়েছে। বৃদ্ধ মশায় অবশ্য তাকে বলেছিলেন কিন্তু তার উপর পূর্ণ ভরসা করতে সে পারে নি। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতেই কত ক্ষেত্রে কত ভ্ৰম হয়, কত ক্ষেত্রে প্রথম দু-তিনবার পর্যন্ত রোগ ধরা পড়ে না। এ তো মানুষের অনুভব অনুমান। কাল বিকেলে তার যখন সন্দেহ হয়েছিল মাস বলে এবং যখন ওই বৃদ্ধ বলেছিলেন মাস নয়; কঠিন বিষজর্জর রক্ত দূষিত করেছে, ঝড়ের মত বাড়ছে এবং বাড়বে—তখন তার খানিকটা রাগ হয়েছিল। বৃদ্ধ যদি বলত এ মৃত্যুরোগ তবে প্রদ্যোত হয়ত রাগে নিজেকে হারিয়ে ফেলত। মৃত্যুরোগ-নিৰ্ণয়-শক্তির একটা সুপিরিয়রিটি-কমপ্লেক্স বৃদ্ধের মাথা খারাপ করে দিয়েছে।