নিজের জীবনে আক্ষেপ থেকে গেল, ডাক্তারি পড়া তাঁর হয় নি। হলে—এ বয়সেও এ অস্ত্র নিয়ে ব্যাধির সঙ্গে সগ্রাম করতেন তিনি। হয় নি এক সর্বনাশীর জন্য।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নিজেকেই নিজে বললেন–থাক, আর না।
৩০. ঘুম আসতে রাত্রি তৃতীয় প্রহর পার
ঘুম আসতে রাত্রি তৃতীয় প্রহর পার হয়ে গিয়েছিল। রাত্রি দেড়টার সময় ইনজেকশন দিয়ে। প্রদ্যোত বাড়ি গিয়েছিল, তারপর ছেলেটির নাড়ি দেখে মশায় বাড়ি ফিরেছিলেন। বিছানায় শুয়ে অনেক কথা মনে পড়েছে; ঘুম আসতে তিনটে পার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঘুম ভাঙল সকালেই। ছেলেটির জন্য উৎকণ্ঠা নাই। সে তিনি রাত্রেই বুঝে এসেছেন। সংকটের ক্ষণ আসতে আসতে, আসতে পায় নি, গতিকে মোড় ফিরিয়েছে ওষুধ। তবু ঘুম ভাঙল। জ্বর কমেছে, ওই ফুলোটা কীভাবে কমে, কতটা কমেছে দেখতে হবে। রাত্রে ভাল দেখা যায় নি। প্রদ্যোত ডাক্তারকে অভিনন্দন জানাতে হবে, অকুণ্ঠ অভিনন্দন। সে ঘড়ির কাঁটার মত আসবে, ইনজেকশন দেবে।
আতর-বউ তার আগেই উঠেছেন। নিচে একদফা তেজ বিকিরণ শেষ করেছেন। ভোরবেলা কালীতলায় জল দিতে গিয়ে মতি কর্মকারের মাকে দেখেছেন। কালীতলার পাশেই মতির বাড়ি; মতির মা কোঠাঘরের জানালা খুলে কালীমন্দিরের দিকে তাকিয়ে কাতরস্বরে যন্ত্রণা উপশমের জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছিল। মতির মায়ের প্লাস্টার-করা পায়ের যন্ত্রণা কাল কোনো কারণে বেড়েছে। সম্ভবত বর্ধমান থেকে এখানে আসার পথে কোনো কিছু অনিয়ম ঘটে থাকবে। মতির মাকে দেখে আতর-বউ তারই উপর বর্ষণ করেছেন তাঁর রাত্রির অবরুদ্ধ ক্ৰোধ।
মানুষের এত বাবার সাধ? এত ভয়? মরণে এত দুঃখ! চিরন্তন প্রশ্নগুলি তিরস্কারের সঙ্গে মতির মায়ের কাছে উথাপিত করেছেন। বাড়ি ফিরেই স্বামীকে নিচে নামতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন—এত সকালে উঠলে? শুয়েছ তো রাত্রি দুটোর পর।
-ঘুম ভেঙে গেল। ছেলেটার খবর নি—কেমন আছে?
–ওখানেও কি কিছু হেঁকে বসে আছ নাকি?
গভীর স্বরে মশায় ডেকে উঠলেন–নারায়ণ নারায়ণ!
–আর তোমার নারায়ণ নারায়ণ! নিজের সন্তানের মৃত্যুকালে ওষুধ দিতে বললে যে দুধ। গঙ্গাজল দিতে বলে, তাকে কিছু বিশ্বাস নাই। কিন্তু সেকাল এককাল ছিল। একাল হলে আর এই ডাক্তারের মত ডাক্তার হলে বনু মরত না। মতির মাকে দেখে এলাম। কোঠার জানালা খুলে কালীমাকে প্রণাম করছে।
মশায় ক্ষুব্ধ হলেন না। একটু হাসলেন। কী বলবেন আতর-বউকে? জীবনের দুরারোগ্য অথচ অক্ষম ব্যাধির মত! মৃত্যুর শান্তি কোনোদিন দিতে পারবে না, শুধু ব্যাধির জ্বালা-যন্ত্রণায় কষ্ট দেবে।
স্বামীর মুখে হাসি দেখে আতর-বউও হাসলেন। হেসে বললেন– রতনবাবুর ছেলেকে দেখে কী বলে এসেছ? ছি-ছিছি! ওরকম করে বোলো না, বলতে নাই। বয়স হয়েছে। এখন ভ্রম হবে। সেটা বুঝতে হয়। কাল তখন অনেক রাত, তুমি অহি সরকারদের বাড়িতে। রতনবাবুর লোক এসে চারটি টাকা আর চিঠি দিয়ে গিয়েছে। আমি ব্যস্ত হলাম। কী জানি, এখুনি হয়ত যেতে হবে। বিনয় তখনও বসে ছিল—তাকে ডেকে পড়লাম। সে বললে—মশায়কে যেতে বারণ করেছে। ডাক্তারেরা সবাই বলছে—ভাল আছে। এক মশায় বলেছেন, মুখে কিছু। বলেন নি, ইশারায় বলেছেন—ভাল নয়। তা বিপিনবাবুর ইচ্ছে এই নাও চিঠি। রাত্রে দিই। নি। কী জানি, মানুষের মন তো!
চিঠি আর চারটি টাকা নামিয়ে দিলেন। মশায় টাকাটা ছুঁলেন না। চিঠিখানাই তুলে নিলেন। হ্যাঁ, তাই লিখেছে রতনবাবু। ক্ষমাও চেয়েছে তার কাছে। লিখেছে—তোমার ইঙ্গিত যে ধ্রুব সত্য তাহা আমি জানি। এবং সে সত্যকে সহ্য করিবার জন্য নিজেকে প্রস্তুতও করিতেছি। কিন্তু বিপিন তাহা পারিল না। প্রদ্যোতবাবু প্রভৃতি ডাক্তারেরা অন্য মতই পোষণ করেন। সকলেরই মত বিপিন ভাল আছে। এবং কলিকাতা হইতে বড় ডাক্তার চ্যাটার্জি মহাশয়কে আনিবার কথা বলিয়াছে। বিপিনেরও তাই ইচ্ছা। সুতরাং…।
যাক, মুক্তি! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন মশায়। কিন্তু মুক্তিই বা কোথায়? বিপিন তো। তাঁকে সে যেতে বারণ করেছে, তিনি যাবেন না, কিন্তু সে পিঙ্গলকেশী তো ফিরবে না। বিপিনের জন্য দুঃখে মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল।
—মশায়! উঠেছেন? মশায়?
ভারী গলা, দীর্ঘায়িত উচ্চারণ; এ রানা পাঠক। ওকে আজ আসতে বলেছিলেন কাল।
—মশায়!
রানা অধীর হয়ে উঠেছে মনে হচ্ছে।
—কাল রাত্রে রক্ত একটু বেশি উঠেছে মশায়।
–এ অবস্থায় তোমার হেঁটে আসা উচিত হয় নি, বাবা।
–কী করব? আপনি যে আসতে বলেছিলেন আজ।
একটু চুপ করে থেকে মশায় বললেন– কিন্তু আমি কী করব বাবা, এ রোগে?
–পরমায়ু থাকলে বাঁচাবেন, না থাকলে সময়ে বলে দেবেন, কালী কালী বলে তৈরি হয়ে যাব আর যতটা পারবেন কষ্টের লাঘব করবেন। আর কী করবেন?
—মশায়!
–রানা!
–দেখুন আমার হাত। কী ভাবছেন আপনি?
মশায় বললেন–ভাবছি, তুমি প্ৰদ্যোত ডাক্তারদের দেখিয়ে–
বাধা দিয়ে রানা বললে—আজ্ঞে না। ও লোকটির নাম আমার কাছে করবেন না। ওর নাম না, চারুবাবুর নামও না। ওদের দুজনের কাছে আমি গিয়েছিলাম। সব কথা আপনাকে বলি নি। শুধু বলেছিলাম, ওরা লম্বা ফর্দ দিয়েছে। কিন্তু আরও আছে। আমি বলেছিলাম—এক্স-রে-টে–যা বলছেন—কমসমে করিয়ে দেন। বামুন বলে গরিব বলে ক্ষ্যামাঘেন্না করে নিন। তা হাসপাতালের ডাক্তার বললেবামুটামুন আমি মানি না। আর গরিব বলেই বা তোমাকে দয়া করব কেন? তুমি অসচ্চরিত্র লোক, একটা স্ত্রীলোক থেকে অসুখ ধরিয়েছ। চারুবাবু বললে–তোমাদের ঘরে মাকালী রয়েছে গো, অনেক পয়সা পাও তোমরা। তারপর হেসে বললে–মা-কালীর কাছে পড় না হে। মা-কালী সারাতে পারবে না? …ওদের কাছে আমি যাব না।