মিয়া বলেছিলেন—কে করবে মশায়! করছে নিজের ব্যাটা-জামাই। ঘরের ভেঁকি কুমির হল মশায়—তাই তো বাঁচবার লাগি এসেছি আপনার কাছে। ডান অঙ্গটা না থাকলে লড়ি, ঠেকাই কী করে?
—কাজটা যে আপনি ভাল করেন নি মিয়া সাহেব; উচিত হয় নি আপনার। মশায় সম্ভ্রমের সঙ্গেই বলেছিলেন কথাটা।
মিয়া সাহেব বছর পাঁচেক আগে নতুন বিবাহ করেছেন। উপযুক্ত ছেলে তিনটিমেয়ে জামাই নাতি নাতনী, বৃদ্ধা দুই পত্নী থাকতে হঠাৎ বিবাহ করে বসেছেন এক তরুণীকে। এবং সে তরুণীটি মিয়া বংশের ঘরের যোগ্য বংশের কন্যা নয়। স্ত্রী-পুত্রদের পৃথক করে দিয়ে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে পৃথক সংসার পেতেছেন। একটি সন্তানও হয়েছে। এখন ছেলেরা শরিক হয়ে মামলা বাঁধিয়েছে। এদিকে মিয়া সাহেবের দক্ষিণ অঙ্গ পঙ্গু হয়ে পড়েছে।
মিয়া সাহেব একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, হাঁ, ইকালে কাজটা নিন্দার বটে, তবে মশায় আপনিও সিকালের লোক, আমিও তাই। আমাদের কালের মানুষের কাছে কি পঞ্চান্ন ষাট বয়সটা একটা বয়স?
একটু চুপ করে থেকে আবার বলেছিলেন-কারেই বা বলি ই কথা! আপন-বয়সী ইয়ারবন্ধু ছাড়া বলিই বা কী করে! মশায়, প্রথম যখন কাঁচা উমর আমারষোল-সতের বছর উমর,–তখুন—সেই কাঁচা নজরে মহব্বত হয়েছিল এক চাষীর কন্যের সঙ্গে। আমার দিল দেওয়ানা হয়ে গেছিল তার তরে। ধরেছিলাম-উয়াকেই শাদি করব। বাপ রেগে আগুন হলেন। আপনি তো জানেন আমাদের বংশে বাদী কি রক্ষিত রাখা নিষেধ আছে। নইলে না হয় তাই রেখে দিতেন। আমি গো ধরলাম। বাবা শেষমেশ আমাকে লুকায়ে সেই কন্যের শাদি দিয়া পাঠায়ে দিলেন—এক্কেরে দুটো জেলার পারে। আমাদেরই এক মহলে, পত্তনিদারের এলাকায়। মশায়, এতকাল পরে হঠাৎ একদিন নজরে পড়ল—এক কন্যে; ঠিক তেমুনি চেহারা–যেন সেই কন্যে নতুন জোয়ানি নিয়ে ফিরে এসেছে। লোকে অবিশ্যি তা দেখে না। তা দেখবে কী করে বলেন? আমার অ্যাঁখ দিয়া তো দেখে না! তাই ভাই, মেয়েটাকে নিকা না করে পারলাম না।
মশায় একটু হেসেছিলেন।
মিয়া সাহেব বলেছিলেন আপনিও হাসছেন গো মশায়? তবে আপনারে বলি আমি শুনেন। ই শান্দি করে আমি সুখী হয়েছি। হ্যাঁ। মনে হয়েছে কি দুনিয়াতে যা পাবার সব আমি পেয়েছি। হাঁ। দুঃখ শুধু আয়ু ফুরায়ে আসছে; দেহখানা পঙ্গু হয়ে গেল; মেয়েটাকে দুনিয়ার মার থেকে বাঁচাতে পারছি না।
তাঁর চোখমুখের সে দীপ্তি দেখে মশায় বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন। বৃদ্ধের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠেছিল। মনে হয়েছিল তার সমস্ত অন্তরটা যেন প্ৰবল আবেগে ওই দুটো চোখের জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে, বলছে দেখ, সত্য না মিথ্যা—দেখ!
মিয়া সাহেব বলেছিলেন—মশায়, আমি বলি কি, আপনি আমারে দেখেন—তারপর আমার নসিব। বুঝলেন না?
কম্পিত ডান হাতখানা তোলবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বাঁ হাতের আঙুল কপালে ঠেকিয়ে বলেছিলেন ইটাকে লঙ্ন করবার ক্ষমতা কারুর নাই। সে যা হয় হবে। ইয়ার লেগে এত ভাবছেন কেন আপনি মশায়? যিনি যক্ষ্মার মতুন ব্যামো ভাল করতি পারেন তিনি যদি এই একটা সামান্য ব্যাধি সারাবারে না পারেন—তবে দোষটা আপনারে কেউ দিবে না, দিবে আমার নসিবের লিখনকে।
মশায় সেকথা শুনেও যেন বুঝতে পারেন নি।
তিনি চলে গিয়েছিলেন দূর অতীতকালে। অন্তরের মধ্যে কোথায় লুকানো গোপন আগুনের অ্যাঁচ অনুভব করছিলেন; অতি ক্ষীণ ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছিলেন যেন; চোখ যেন জ্বালা করছিল। সত্য সত্যই তার চোখে জল এসেছিল। মনে পড়েছিল মঞ্জরীর কথা।
মিয়ার চোখ এড়ায় নি। তিনি বলেছিলেন ইয়ারই তরে আপনার বংশকে বলে মশায়ের বংশ, ইয়ারই তরে লোকে আপনারে চায়। রোগীর দুঃখ-দরদে যে হাকিমের চোখে জল আসে–সেই ধন্বন্তরি গো!
মশায় মুহূর্তে সংবিৎ ফিরে পেয়েছিলেন; চোখ মুছে মনে মনে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করেছিলেন। মিয়া সাহেবের চিকিৎসার ভারও নিয়েছিলেন তাঁকেই স্মরণ করে। বলেছিলেন তাই হবে মিয়া সাহেব। চিকিৎসা আমি করব। আপনার ভাগ্য আর ভগবানের দয়া। আমার যতটুকু সাধ্য। কই দেখি আগে আপনার হাতখানি।
নিজেই তুলে নিয়েছিলেন তাঁর হাতখানি।
সেই হয়েছিল আবার শুরু।
প্রবাদ রটেছিল—পাঁচ বৎসর ঘরে বসে মশায় বাকসিদ্ধ হয়েছেন। মশায় যার নাড়ি ধরে বলেন-বাঁচবে, মরণ তার শিয়রে এসে দাঁড়িয়ে থাকলেও ফিরে যায়। আর যাকে বলেন বাঁচবে না—সেখানে আপনপুরে মরণের টনক নড়ে; সে মুহূর্তে এসে রোগীর শিয়রে দাঁড়ায়।
বৃদ্ধ মিয়া সাহেবের হাত ধরেই তিনি চমকে উঠেছিলেন। মৃত্যুলক্ষণ তিনি স্পষ্ট অনুভব করেছিলেন। ধীরভাবে ধ্যানস্থের মত অনুভব করে তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন বিষয় নিয়ে মামলায় আপনি বিব্রত বলছিলেন। মামলা আপনি মিটিয়ে ফেলুন মিয়া সাহেব। মামলা চালাবার সময় আপনার হবে না। একশো আশি দিন। ছ মাস।
—ছ মাস? মামলা মিটায়ে ফেলব?
–আমি তাই পেলাম।
পাঁচ মাসের শেষ দিনে মিয়া সাহেব দেহ রেখেছিলেন। মশায়ের নিজেরও যেন বিস্ময় মনে হয়েছিল। এত স্পষ্ট এবং এমন অঙ্কফলের মত ধারণা এর আগে ঠিক হত না। যে পিঙ্গলকেশীকে ঘরে বসে চিন্তা করে, ধ্যান করে বিন্দুমাত্র আভাসেও পান নি, তাকে তার চিকিৎসাসাধনার মধ্যে বিচিত্রভাবে অনুভব করছেন। নাড়ির স্পন্দনের মধ্যে, লক্ষণের মধ্যে, রোগীর গায়ের গন্ধের মধ্যে, তার উপসর্গের মধ্যে, গাত্রবর্ণের মধ্যে, এমনকি আঙুলের প্রান্তভাগের লক্ষণের মধ্যে সেই পিঙ্গলকেশীর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছেন। মধ্যে মধ্যে আরও বিচিত্র অনুভূতি তাঁর হয় এবং হয়েছে। আজই অতসীর ছেলের কাছে বসে বার বার অনুভব করেছেন। তার অশরীরী অস্তিত্ব দরজার মুখ থেকে পা-পা করে এগিয়ে আসছে মনে হয়েছে। আবার পিছিয়ে চলে যাওয়াও স্পষ্ট অনুভব করেছেন। রিপুপ্রভাবমুক্ত নিস্পাপ শিশু বলেই সে ওষুধের ক্রিয়া মেনে ফিরে গেল। কিন্তু প্রদ্যোত বীর সাহসী যোদ্ধা। বীরের মত যুদ্ধ করেছে। অস্ত্রও তেমনি অদ্ভুত শক্তিশালী। অদ্ভুত!