–রক্ত উঠছে মুখ দিয়ে বাবা। বমি হয়।
–রক্ত উঠছে! টিবি? নতুন ডাক্তারেরা শিউরে উঠেছিলেন।
—আজ্ঞে লবগেরামের ডাক্তারখানার ডাক্তার বলছে—রাজব্যাধি যক্ষ্মা! জবাব দিয়েছে। বলেই সে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মশায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল—তবে এইবার আমি বাঁচব। ভগবান আপনাকে ডেকে এনেছেন ঘরে। আমার কপাল। আপনি একবার দেখ বাবা। আমাকে বাঁচাও। ফুরির আর কেউ নাই বাবা।
ফুরি পরানের প্রণয়াস্পদা, তার প্রিয়তমা। যার জন্য সে সব ছেড়েছে। তাকে ও ছেড়ে গেলে তার আর কেউ থাকবে না বলেই পরানের ধারণা। কিন্তু ফুরি আবার বিয়ে করবে। ফুরিও তাঁর গ্রামের মেয়ে, তার কথাও তিনি জানেন, ফুরি লাস্যময়ী স্বৈরিণী। তার জন্য বহুজনেই মোহগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু পরানের মত তাকে গলায় বেঁধে ঝাঁপ কেউ দেয় নি। সকরুণ হাসিই এসেছিল তাঁর ঠোঁটের রেখায়। কিন্তু সে হাসি স্তব্ধ হয়ে মিলিয়ে গেল মুহূর্তে।
ফুরিও এসে দাঁড়িয়েছিল তার অ্যাঁতুড়ঘরের দরজায়।—মশায়! বাবা! আমার কেউ নাই বাবা। তাকে দেখে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এই সেই ফুরি? সে স্বৈরিণীর কোনো চিহ্ন অবশেষ নাই মেয়েটার মধ্যে। সদ্য সন্তানপ্রসবের পর সে ঈষৎ শীর্ণ পাণ্ডুর; কিন্তু রূপের অভাব হয় নি। লাবণ্য রয়েছে, স্বাস্থ্য রয়েছে, চিকুণতা রয়েছে। চোখের দৃষ্টিতে গঠনে ফুরির একটি মাধুর্য ছিল সে মাধুর্যও রয়েছে, নাই শুধু লাস্যচাপল্য, যার ফলে ওকে আর চেনাই যায় না ফুরি বলে। ঠোঁটের পাশে গালে ওটা কী? তিল? ওটা তো মশায় কখনও দেখেন নি। তিনি অবশ্য ফুরিকে পথে চলে যেতেই দেখেছেন, দূর থেকেই দেখেছেন, তার মত মানুষের সামনে ফুরির মত মেয়েরা বড় একটা আসত না। তাকে দেখলে সমে পাশে সরে দাঁড়াত। তিলটা ঠিক বনবিহারীর স্ত্রী—তাঁর বউমার ঠোঁটের পাশের তিলের মত অবিকল।
ওঃ, বনবিহারীর স্ত্রীর তার পুত্রবধূর ধনী বাপ আছে, মা আছে। এ মেয়েটার সত্যিই আর কেউ নাই। বাপ-মা মরেছে। এবং ওর মনের ভিতর যে স্বৈরিণী লীলাভরে এক প্ৰিয়তমকে ছেড়ে তাকে ভুলে গিয়ে আর-একজনকে প্রিয়তম বলে গ্রহণ করতে পারত সে স্বৈরিণীও মরে গেছে। পরান মরে গেলে ওর আর কেউ থাকবে না-এ বিষয়ে আর তার সন্দেহ রইল না।
তিনি দাওয়ায় উঠে পরানের হাত ধরে নাড়ি পরীক্ষা করতে বসেছিলেন।
সেই হল তার নূতন করে নাড়ি ধরা, চিকিৎসা করতে বসা।
পরানকে তিনি বাঁচিয়েছিলেন।
যক্ষ্মা বা টি-বি পরানের হয় নি। পুরনো ম্যালেরিয়া এবং রক্তপিত্ত দুইয়ে জড়িয়ে জট পাকিয়েছিল। চারুবাবু, চক্রধারী রক্তবমি এবং জ্বর, দুটো উপসর্গ দেখেই সাংঘাতিক ধরনের গ্যালপিং থাইসিস বলে ধরেছিল। একালে দেশে যক্ষ্মার ব্যাপক প্রসার হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু সাধারণ ডাক্তারেরা রক্ত এবং জ্বর দুটোকে একসঙ্গে দেখেই টি-বি বলে ধরে নিয়েছিল। বিশেষজ্ঞ দেশে ছিল না, পরানেরও দূর শহরে গিয়ে দেখাবার সাধ্য ছিল না।
মশায় তার চিকিৎসার ভার নিয়েছিলেন। নিজেই আসতেন দেখতে। নিজে হাতে ওষুধ তৈরি করে দিতেন। পরান ভাল হল, তিনি হয়ে উঠলেন ধন্বন্তরি। নূতন করে জীবনের আকাশে সৌভাগ্যের সূর্য উদয় হল তার। মাস কয়েক পর পরান সুস্থ দেহে বল পেয়ে কোদাল ঘাড়ে মজুর খাটতে বের হলে লোকের আর বিস্ময়ের সীমা ছিল না।
এরপরই একদিন পরানের এখনকার গ্রাম ঘাট-রামপুরের চি য়াদের বাড়ি থেকে ড়ুলি এসে নেমেছিল আরোগ্য-নিকেতনের সামনে।
বৃদ্ধ সৈয়দ আবু তাহের সাহেব পুরনো আমলের কাশ্মিরি কাজ-করা শালের টুপি, সাদা পায়জামা শেরোয়ানী পরে ড়ুলির বেহারাদের কাঁধে ভর দিয়ে এসে ওই রানা আজ যে চেয়ারখানায় বসেছে ওইখানাতেই বসে বলেছিলেন আপনার কাছে এলাম মশায়, আপনি পরান কাহারের এত বড় ব্যামোটা সারিয়ে দিলেন। আমারে আরাম করে দ্যান আপনি। আপনারে ঘরে ডাক না দিয়া নিজে আপনার ঘরে এসেছি। আপনারে ধরবার জন্য এসেছি। আমারে আরাম করে দ্যান কবিরাজ।
বাঁ হাত দিয়ে মশায়ের হাতখানি চেপে ধরেছিলেন। কথা শুনেই বুঝেছিলেন মশায় মিয়া সাহেবের ব্যাধি কী? কথাগুলি জড়িয়ে যাচ্ছিল। মিয়া সাহেবের পক্ষাঘাতের সূত্রপাত হয়েছে, ডান হাতখানি কোলের উপর পড়েছে, ডান দিকের ঠোঁট বেঁকে গিয়েছে, ডান হাতখানি কোলের উপর পড়ে আছে। ডান পা-খানাও তাই।
মশায় ম্লান হেসে বলেছিলেন—এ বয়সে এ ব্যাধির মালিক পরমেশ্বর মিয়া সাহেব। ওই চোখ ওই হাত ওই অঙ্গটা তাঁর সেবাতেই নিযুক্ত আছে ভাবুন। আমার কাছে এর ইলাজ নাই। সে কিসমতও নাই।
একটু চুপ করে থেকে মিয়া সাহেব বলেছিলেন বলেছেন তো ভাল মশায়! মশায়ঘরের ছাওয়ালের মতই বাত বলেছেন। কিন্তু কী জানেন—শেষ বয়সে নিজেই বাঁধিয়েছি ফ্যাসাদ, মামলাতে পড়েছি। তাঁর সেবাতে ডান অঙ্গটা দিয়া নিশ্চিন্দি হতে পারছি কই! কিছু করতি পারেন না আপনি?
মশায় বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন—আপনার সঙ্গে মামলা কে করছে? সে কী?
রামপুরের মিয়ারা এ অঞ্চলের মুসলমান সমাজের ধর্মগুরু। তাঁদের সম্পত্তি সমস্তই নানকার অর্থাৎ নিষ্কর। এবং নিঝঞ্ঝাট। তার সুদীর্ঘ জীবনে তিনি কখনও রামপুরের মিয়াদের আদালতের সীমানায় যাতায়াতের কথা শোনেন নি। তারা কাউকে খাজনা দেন না, খাজনা পান বহুজনের কাছে; কিন্তু তাদের বংশের প্রথা হল—সুদও নাই, তামাদিও নাই। সে প্রথা তাদের প্রজারাও মানে। পঞ্চাশ বছর পরও লোকে খাজনা দিয়ে গেছে। তার সঙ্গে মামলা। করলে কে?