এ রোগী বাঁচে না এ কথা মশায় জানতেন, কিন্তু বাধা দেন নি। দাঁড়িয়ে দেখলেন, লক্ষ্য করে গেলেন। নিপুণ ক্ষিপ্ৰ হাতে সাবধানতার সঙ্গে ওরা কাজ করে গেল। শিরা কাটলে, এক মুখ বন্ধ করলে—অন্য মুখে স্যালাইনের নলের মুখটা ঢুকিয়ে দিলে। একজন কাচের নলটুকুর দিকে চেয়ে রইল। বুদ্বুদেব মধ্য দিয়ে বায়ু না যায়। সতর্ক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে।
বুদ্বুদে বায়ু গেলেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। চারিদিকে দূরে দাঁড়িয়ে বিস্ময়াভিভূত জনতা। জীবন মশায়ের দৃষ্টিতে কৌতূহল—আনন্দ। অদ্ভুত! অদ্ভুত! মেয়েটার দেহ থেকে মৃত্যুছায়া অপসারিত হয়ে যাচ্ছে, কালি মুছে গিয়ে তার গৌরবর্ণ ফুটে উঠছে। রস শুষে-নেওয়া শুষ্ক দেহ রস-সঞ্চারে আবার নিটোল পরিপুষ্ট কোমল হয়ে উঠছে; জীবনের লাবণ্য ফিরে আসছে। অদ্ভুত, এ অদ্ভুত! যুগান্তর, সত্যই এ যুগান্তর! মৃত্যু ফিরে গেল?
সে বড় কঠিন! যায় না। বৃদ্ধ জীবনমশায় হাসলেন আজ।
মনে পড়ছে যে!
ইনজেকশন শেষ হল—মেয়েটি হাসিমুখে সলজ্জভাবে মাথার ঘোমটা টেনে দিয়ে নিজেই পাশ ফিরে শুলে। ডাক্তারেরা যন্ত্রপাতি গুটিয়ে নিয়ে ব্লিচিং পাউডার মেশানো জলে হাত ধুচ্ছে, এই সময় হঠাৎ জলভরা পাত্র ভেঙে যেমন জল ছড়িয়ে পড়ে ঠিক তেমনিভাবেই মুহূর্তের মধ্যেই একরাশি জল ছড়িয়ে পড়ল, মলের আকারে নির্গত হয়ে গেল। এবং মুহূর্তে মেয়েটা আবার হয়ে গেল সেই মৃত্যুছায়াচ্ছন্ন, কালিবর্ণ, কঙ্কালের মত শুষ্ক। অবিনাশ বাউরির স্ত্রী মারাই গেল। কিন্তু জীবনমশায় সেদিন মনে মনে মৃত্যুর সঙ্গে মানুষের সাধনাকেও প্রণাম জানিয়েছিলেন। মৃত্যুকে জয় করা যাবে না, কিন্তু মানুষ অকালমৃত্যুকে জয় করবে। নিশ্চয় করবে। ধন্য আবিষ্কার। ইউরোপের মহাপণ্ডিতদের প্রণাম করেছিলেন। হা-আজ বেদজ্ঞ তোমরাই। এই কথাই বলেছিলেন।
আজ পেনিসিলিনের ক্রিয়া দেখে এবং প্রদ্যোতের উদ্যম দেখে ঠিক সেই কথাই বলছেন। তোমরা ধন্য।
সেদিন তার জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হয়েছিল। মনে পড়ছে, সংকল্প ছিল কলেরার আক্রমণ ক্ষান্ত হলেই আবার তিনি ঘরে ঢুকে বসবেন। কিন্তু তা পারেন নি। বিচিত্রভাবে শুরু হয়ে গেল। ডাক্তারদের সঙ্গে কলেরা-সংক্রামিত পাড়া ঘুরে রোগী দেখে ফিরে এসে কিশোরদের বাড়িতে বসতেন, হাত-পা ধুতেন—ব্লিচিং পাউডারে মাড়িয়ে জুতার তলা বিশুদ্ধ করে নিতেন—ততক্ষণে দুজন চারজন এসে জুটে যেত; জ্বরে আমাশয়ে পুরনো অজীর্ণ ব্যাধিতে ভুগছে। এমনি রোগী সব।
—একবার হাতটা দেখুন।
জীবনমশায় প্রথম প্রথম বলতেন—এই এদের দেখাও।
–না। আপনি দেখুন।
ডাক্তার দুটি বড় ভাল ছেলে ছিল, তারা বলতদেখুন ডাক্তারবাবু, আপনাকেই দেখাতে চায় ওরা।
মশায় দেখতেন। শুধু বলতেন—এই ন দিন না-হয় এগার দিনে জ্বর ছাড়বে। ওষুধ দিতেন না।
তারপর একদিন ঈশানপুরে পরান কাহার তাঁকে টেনে নামালে।
সংসারে কত বিচিত্ৰ ঘটনাই ঘটে!
সে এক দুরন্ত কালবৈশাখীর ঝড়ের অপরা। ঈশানপুরে কলেরার আক্রমণের খবর পেয়ে কিশোর এবং তরুণ ডাক্তার স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে গিয়েছিলেন ঈশানপুরে। গ্রামে ঢোকবার মুখে হঠাৎ ঝড়। বজ্ৰাঘাত। বর্ষণ। সবশেষে শিলাবৃষ্টি। আশ্রয় নিয়েছিলেন গ্রামের প্রান্তের প্রথম ঘরখানিতে।
একখানা মাত্র ঘরকোলে একটা পিড়ে, মানে ঢাকা রোয়াক, মেটে রোয়াক। পাশে আর-একখানা ছিটে বেড়ার হাত তিনেক মাত্র উঁচু ঘর। রোয়াকেও স্থান ছিল না। সেখানটা ঘিরে তখন অ্যাঁতুড়ঘর হয়েছে। ঘরের ভিতর থেকে ক্ষীণকণ্ঠে কেউ বলছিল—কোথায় পাড়াবা বাবা? বাইরের পিঁড়েতে ঘিরে আমার পরিবারের সন্তান হয়েছে। ভিতরে আমি রোগা মানুষ শুয়ে আছি। তিনটে শুয়োর আছে, পাঁচ-ছটা হস আছে। আপনারা বরং একপাশে কোনোরকমে দাঁড়াও।
তাই দাঁড়িয়েছিলেন; মসীবর্ণ মেঘ থেকে শিল ঝরছিল অজস্র ধারে; বিচিত্র সে দৃশ্য। লাখে লাখে শূন্য মণ্ডলটা পরিব্যাপ্ত করে ঝরঝর ধারে ঝরছিল। সবুজ পৃথিবী সাদা হয়ে যাচ্ছিল। অনেক কাল এমন শিলাবৃষ্টি হয় নি। মশায়েরা ভাবছিলেন মাঠে আজ কতজন, কত জীবজন্তু জখম হবে, মরবে। আবার পৃথিবী বাচল, শান্ত হল, শীতল হল।
কিশোর কর্মী হলেও কবি মানুষ, ছেলেবেলা থেকে পদ্য লেখে। কিশোর মুখে মুখে পদ্য তৈরি করেছিল তার একটা চরণ আজও মনে আছে :
ক্ষ্যাপার মাথায় খেয়াল চেপেছে
নাচন দিয়েছে জুড়ে।
এরই মধ্যে ঘরের দরজার ফাঁক থেকে ক্ষীণ ক্লান্ত কণ্ঠে কে অসীম বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করেছিল—মশায়, বাবা! আপনি?
দরজাটা খুলে গিয়েছিল। বসে বসেই নিজেকে হেঁচড়ে টেনে কোনোরকমে বেরিয়ে এসেছিল এক কঙ্কালসার মানুষ। যুবা না পৌঢ় না বৃদ্ধ তা বুঝতে পারা যায় নি। শুধু চুল কালো দেখে সন্দেহ হয়েছিল—রোগেই জীর্ণ, বৃদ্ধ নয়।
—কে রে?
লোকটা হাউহাউ করে কেঁদে উঠে বলেছিল—আমার যে নড়বার ক্ষ্যামতা নাই মশায়। আমাকে চিনতে পারছেন বাবা?
–কে? ঠিক চিনতে তো পারছি না বাবা! কী হয়েছে তোমার?
–আমি হাটকুড়ড়া কাহারের বেটা পরান। আপনকার গেরামে আপনার পেজা হাটকুড়ো। হাটকুড়োর ছেলে পরান।
তারই গ্রামের—তারই পুকুরপাড়ের প্রজাই বটে হাটকুড়ো। পান, শূরবীর পরান। বছর কয়েক আগে প্রেমে পড়ে পরান বাপ মা জাতি জ্ঞাতি সব ছেড়ে প্ৰেমাস্পদা একটি ভিন্নজাতীয় মেয়েকে নিয়ে গ্রাম ত্যাগ করেছিল।
সেই পরানের এই কঙ্কালসার মূর্তি দেখে শিউরে উঠেছিলেন মশায়।—তোর এমন চেহারা হয়েছে? কী অসুখ রে?