দীর্ঘ পাঁচ বছর তাঁর জীবনে আর কেউ ছিল না, কিছু ছিল না। নিজের নাড়ি পরীক্ষা করতেন। কিন্তু কোনো কূলকিনারা পান নি। মধ্যে মধ্যে গ্রামের কারুর জীবন-মৃত্যুর যুদ্ধে আত্মীয়েরা এসে ডাকত—একবার! একবার চলুন!
গিয়েছেন। চিন্তার মধ্যে যাকে ধরতে পারেন নি, তে পারেন নি, যার ধ্বনি শোনেন নি, নাড়ি ধরে তার স্পষ্ট অস্তিত্ব অনুভব করেছেন। তখন মনে হত, তাকে জানতে হলে তার এই পথ।
তারপর একদিন গেলেন তীর্থভ্রমণে। মৃত্যুর কোনো সন্ধান না পেয়ে আবার খুঁজতে গেলেন, পরমানন্দ মাধবকে। গয়ায় বনুকে নিজ হাতে পিণ্ড দিয়ে সরাসরি গেলেন বৃন্দাবন। বৃন্দাবনে বনুর আত্মার জন্য শান্তি প্রার্থনা করে মন্দিরপ্রাঙ্গণে একখানি মার্বেল পাথর বসিয়ে দিলেন। অন্য একখানা মার্বেল পাথর দেখে কথাটা মনে হয়েছিল। অনেক পাথরের মধ্যে চোখে পড়ল। প্রথমটা চমকে উঠেছিলেন তিনি।
কাঁদী-নিবাসী ভূপেন্দ্র সিংহের আত্মার
শান্তির জন্য–
হে গোবিন্দ দয়া কর, চরণে স্থান দাও।
মঞ্জরী দাসী।
তীর্থ থেকে ফিরে নবগ্রাম স্টেশনে নামলেন; দেখা হল কিশোরের সঙ্গে। কিশোর তখন প্রদীগুললাট যুবা। পাঁচ বৎসরই কিশোরকে দেখেন নি মশায়। তিনি নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন। ঘরে, কিশোরকে আবদ্ধ রেখেছিল গভর্নমেন্ট, রাজা।
কিশোর সবিস্ময়ে বলেছিল—মশায়!
তিনিও সবিস্ময়ে বলেছিলেন–কিশোর।
–এই নামছেন আপনি?
–হ্যাঁ। কিন্তু তুমি ছাড়া পেলে কবে? ওঃ, কত বড় হয়ে গিয়েছ তুমি!
হেসে কিশোর বলেছিল—তা হয়েছি। আর ক্ষীর চাঁচি ছানা চুরি করে খাই না।
—সে বুঝতে পারছি। মশায় বলেছিলেন হেসে অবসর কোথায়? রুচিই বা থাকবে কী করে? এখন প্ৰভু কংসারির সঙ্গে ধনুৰ্যজ্ঞে নিমন্ত্রণ রাখবার পথে সঙ্গীর সাজে সেজেছ যে!
কিশোর একটু লজ্জিত হয়েছিল এমন মহৎ পরিচয়ের ব্যাখ্যায়। পরশ্ন ণে সে লজ্জাকে সরিয়ে ফেলে সহজভাবে বলেছিল—আপনাকে যে কত মনে মনে ডাকছি এ কদিন কী বলব? আপনি এসেছেন—বালাম।
—কেন কিশোর কিসে তোমাকে এমন মরণের ভয়ে অভিভূত করেছিল? মরণের ভয় তো তোমার থাকবার নয়।
–কলেরা আরম্ভ হয়েছে মশায়। নিজের মৃত্যুকে ভয়ের কথা তো নয়; মানুষের মৃত্যু দেখে মানুষের ভয় দেখে ভয় পাচ্ছি। জানেন তো, ডাক্তারেরা কলেরা কেসে যেতে চান না, গেলে ফি ডবল। চারুবাবুর ফি ছ টাকা—আট টাকা। চক্রধারীর ফি চার টাকা। আমি হোমিওপ্যাথিক একটু-আধটু দি, কিন্তু ভাল তো জানি না। আপনি এলেন এবার বাঁচলাম। আমাদের ছেলেবেলায় যখন কলেরা হয়েছিল তখন আপনিই গরিব-দুঃখীদের দেখেছিলেন। আজও যে আপনি না হলে উপায় নেই মশায়।
তিনি সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিতে পারেন নি। আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিলেন। কিছুক্ষণ। সেই পুরনো কালের–উনিশশো পাঁচ সালের মহামারীর কথা মনে পড়েছিল। সেই অন্ধ বধির পিঙ্গলকেশিনী দুই হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে; মহাকালের ডমরুতে বেজেছে তাণ্ডব বাদ্যতারই তালে তালে উন্মত্ত নৃত্যে আত্মহারা হয়ে ছুটে চলেছে সব মৃত্যুভয়ভীত মানুষ, আগুনলাগা বনের পশুপক্ষীর মত আর্ত কলরব করে ছুটে পালাচ্ছে। ছুটে পালাচ্ছে—পিছনের লেলিহান শিখা বাতাসের ঝাপটায় মুহূর্তে নুয়ে দীর্ঘায়ত হয়ে তাকে গ্রাস করছে—আকাশে পাখি উড়ে পালাচ্ছে—আগুনের শিখা লকলক জিহ্ব প্রসারিত করে তাকে আকর্ষণ করছে—পাখির পাখা পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে–অসহায়ের মত পুড়ছে আগুনের মধ্যে। মহামারীর স্মৃতি তার ঠিক তেমনি।
কিশোর বলেছিল—মশায়!
–কিশোর!
–আপনি চলুন, চলুন আপনি।
–আমি পারব? আমার কি আর সে শক্তি, সে উৎসাহ আছে কিশোর?
কিশোর বলেছিল—এই কথা আপনি বলছেন? মশায়ের বংশের মশায় আপনি।
কিশোরের কথা মনে পড়েছিল বাবার কথা। গুরু রঙলালের কথাও মনে হয়েছিল। পরমুহূর্তেই তিনি বলেছিলেন—বেশ, যাব। তুমি ডাক দিলে—নিলাম সে ডাক।
সেইবার কলেরার সময় ইনট্রাভেনাস স্যালাইন ইনজেকশন দেখেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে মেডিক্যাল ভলান্টিয়ার্স এসে উপস্থিত হয়েছিল। একদল সোনার চাঁদ ছেলে। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড থেকে এল লোকজন। স্যানিটারি ইন্সপেক্টার। আর একদল এল, কী নাম যেন তাদের? কোদালি ব্রিগেড! কোদাল ঘাড়ে করে এল শিক্ষিত যুবকেরা।
শুকনো পুকুরের তলায় কুয়ো কেটে তারা জল বের করলে। তাই তো! কথাটা তো কারুর মনে হয় নি! স্যানিটারি ইন্সপেক্টারেরা পুকুরে পুকুরে ব্লিচিং পাউডার গুলে দিয়ে জলকে শোধন করলে। অ্যান্টি-কলেরা ভ্যাকসিন ইনজেকশন দিলে। কলেরার টিকে!
সব থেকে বিস্মিত হয়েছিলেন স্যালাইন ইনজেকশন দেখে।
অবিনাশ বাউরির বউ–সত্যকারের সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী মেয়ে, সকালে সে এসে ভদ্রপাড়ার বাসন মেজে ঘরদোর পরিষ্কার করে ঝিয়ের কাজ করে গেল তাঁর চোখের সামনে। দুপুরে শুনলেন তার কলেরা হয়েছে। বিকেলে গিয়ে দেখলেন সেই স্বাস্থ্যবতী সুন্দরী মেয়েটার সর্বাঙ্গে কে যেন কালি মাখিয়ে দিয়েছে; একগোছা ঝাঁটার মত কঙ্কালসার দেহের সকল রস কে যেন নিঙড়ে বের করে দিয়েছে। দেখে শিউরে উঠলেন তিনি। মৃত্যুর ছায়া পড়েছে সর্বাঙ্গে। নাড়ি নাই, হাতের তালু পায়ের তলা বিবৰ্ণ পাণ্ডুর, হাত-পা কনুই পর্যন্ত হিমশীতল।
তরুণ দুটি ডাক্তার তখন তাদের দলে এসে যোগ দিয়েছে। চোখে তাদের স্বপ্ন, বুকে তাদের অসম্ভব প্রত্যাশা, ওই কিশোরের জাতের ছেলে। তারা বললে—স্যালাইন দেব একে। বের করলে স্যালাইনের বাক্স।