–ওষুধই যখন তুই দিবি তখন প্রদ্যোত ডাক্তারকে দেখানো ভাল। ভাল চিকিৎসক, ধীর চিকিৎসক; আজও আমি দেখলাম।
–উঁহুঁ আপনি দেখুন। আপনি বাঁচান রানা ঠাকুরকে। রামহরিকে বাঁচিয়েছেন। আর একটা চিকিৎসা দেখিয়ে দেন। শুধু তাই নয় মশায়, সকালবেলা আপনি শোনেন নি আমার কথা। বলেছিলেন-কাল। তা রাবণ ঠাকুর আমাকে আজই আবার নিয়ে এল আপনার কাছে। আপনাকে আমার ডাক্তারখানায় একবেলা করে বসতে হবে। ডাক্তারেরা নতুন ডাক্তারখানা করে আমাকে মারবার চেষ্টা করছে। আপনি আমাকে বাঁচান।
মশায় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন বিনয়ের মুখের দিকে।
—মশায়!
—কাল। কাল বলব। আজ নয়। কাল। রানা তোমাকেও কাল বলব। আজ নয়। অহি সরকারের নাতিই আজ সব ভাবনা জুড়ে রয়েছে। কাল এসো।
–দেখছে তো প্রদ্যোত ডাক্তার। বার লাখ পেনিসিলিন দিয়েছে আজ। বাঁচাবই বলে খুব হক মেরেছে বুঝি?
–বিনয়, কাল। কাল। আজ আর কথা বলিস নে বাবা। মশায় উঠে পড়লেন। এরা কি সবাই ভাবে মশায় মৃত্যুঘোষণা ছাড়া আর কিছু করে না! ওতেই তার আনন্দ?
সেতাব আপন মনে একলাই দাবা খেলে যাচ্ছিল, সে সব গুটিয়ে নিয়ে উঠল। আমিও আজ চললাম রে।
—যা। মন আজ আমার ওইখানে পড়ে আছে। খেলায় বসবে না। লড়াই চলছে, বুঝছিস না?
সত্যই লড়াই। মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই। তিনিও জীবনে বহুবার করেছেন। হারলে অগৌরব নাই। কিন্তু বেদনা আছে। বিশেষ করে অতসীর ছেলেটির মত ক্ষেত্রে। ইং শব্দে ক্লক ঘড়িতে একটা বাজল। প্রদ্যোত ডাক্তার সিরিঞ্জ পূর্ণ করে ঠিক করে রেখেছে। সে উঠে দাঁড়াল। ঠিক সাড়ে বারটায় সে এসেছে। ইনজেকশন শেষ করে সিরিঞ্জ ধুয়ে মুখ তুলে চাইলে। মশায় নাড়ি ধরে বসেছেন তখন। চোখ বুজে বসে রয়েছেন।
প্রদ্যোত বললে—আমার যা করবার করে গেলাম। সকালে ঠিক সময়ে আসব আমি। রোগীকে কিন্তু ঘুমুতে দিন। নাড়াচাড়া করবেন না।
চলে গেল সে। মশায় আরও কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে চাইলেন, চাইলেন দরজার দিকে। সরে যাচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
বললেন–ভাল আছে।
কীর্তিমান যোদ্ধা প্রদ্যোত ডাক্তার। এ যুগের আবিষ্কার বিচিত্র বিস্ময়কর! আর না। তাঁর কাল গত হয়েছে। আর না। কালকের সংকল্পটা মনে মনে দৃঢ় করলেন তিনি। আর না।
২৯. তিনি চিকিৎসা ছেড়ে দিয়েছিলেন
আর না বলে আরও একবার তিনি চিকিৎসা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বনবিহারীর মৃত্যুর পর। তখন ভেবেছিলেন আর কেন? পূৰ্ণাহুতি তো হয়ে গেল! কেউ ডাকতে এলে বলতেন ভেবে নিয়ো মশায় মরে গেছে। শোক-দুঃখ কতটা তা ঠিক আজও বলতে পারেন না; তিনি চিকিৎসক, মহাশয় বংশের শিক্ষা, ভাবনা তার মধ্যে, মৃত্যু অনিবার্য এ কথাও তিনি জানেন এবং শোকও। চিরস্থায়ী নয় এও জানেন। জীবনের চারিদিকে ছটা রসের ছড়াছড়ি; আকাশে বাতাসে ধরিত্রীর অঙ্গে ছয় ঋতুর খেলা; পৃথিবীর মাটির কণায় কণায় যেমন উত্তাপ এবং জলের তৃষ্ণা, জীবের জীবনেও তেমনি দেহের কোষে কোষে রঙ ও রসের কামনা ও না হলেও সে বাঁচে না। মানুষের। মনে মনে আনন্দের ক্ষুধা। শোক থাকবে কেন, থাকবে কোথায়? শোকের জন্য নয়, আক্ষেপে ক্ষোভেও নয়, অন্য কারণে ছেড়েছিলেন। প্রথম কারণ জীবনের সব কল্পনা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
বনবিহারীর মৃত্যুর পরই বনবিহারীর স্ত্রী একমাত্র শিশুপুত্রটিকে নিয়ে চলে গেল পিত্রালয়ে। গেল প্রথমটায় কিছুদিন পর ফিরবে বলে। বনুর স্ত্রী মা-বাপের একমাত্র সন্তান, বিষয়ের। উত্তরাধিকারিণী। মা-বাপ নিয়ে গেলেন সমাদরের সুখে বৈধব্যের দুঃখ প্রশমিত করে দেবেন। বলে। কিন্তু সেখানে গিয়ে কিছুদিন পরই লিখে পাঠালেন—মনো এবং খোকা এখানেই থাক। আমাদের তো আর কেহ নাই; ওই একমাত্র সম্বল। আপনাদের মেয়েরা আছে, দৌহিত্রেরা আছে। আমাদের কে আছে? অবশ্য ক্রিয়াকর্মে যাইবে। আপনাদের দেখিতে ইচ্ছা হইলে যখন খুশি আসিয়া দেখিয়া যাইবেন। ইহা ছাড়াও মনোর ওখানে যাইতে দারুণ আশঙ্কা! তাহার ভয়–ওখানে থাকিলে খোকনও বঁচিবে না। কিছু মনে করিবেন না, সে বলে—সেখানে রোগ হইলে আরোগ্যের কথা ভুলিয়া মৃত্যুদিন গণনা করা হয়, সেখানে আয়ু থাকিতেও মানুষ মরিয়া যায়।
এ ছাড়া আতর-বউ সম্পর্কে অভিযোগ ছিল। স্তার কঠোর তিরস্কার কাহারও পক্ষেই সহ্য করা সম্ভবপর নয়। ইত্যাদি।
সুতরাং আর অর্থ, প্রতিষ্ঠা অর্জন কেন, কিসের জন্য?
দ্বিতীয় কারণ, মনকে সঁপে দিতে চেয়েছিলেন কুলধৰ্ম ও পিতৃনির্দেশ অনুযায়ী পরমানন্দ মাধবের পায়ে। কিন্তু সেও পারেন নি। তার পরিবর্তে ভাবতেন নিজের জীবনের কথা আর ভাবতেন মৃত্যুর কথা। পরলোকতত্ত্ব চিকিৎসাতত্ত্ব সব তত্ত্ব দিয়ে এই অনাবিষ্কৃত মহাতত্ত্বকে বুঝবার চেষ্টা করতেন। কত রকম মনে হয়েছে। আরোগ্য-নিকেতনের পাশের ঘরখানায় চুপ করে বসে থাকতেন। বাড়ির ভিতরে ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদত আতর-বউ। গভীর রাত্রে উঠে গিয়ে বনুর ঘরে বারান্দায় ঘুরে বেড়াত। কখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত। প্রত্যাশা করত এত অতৃপ্তি এত বাঁচবার কামনা নিয়ে যে বনু মরেছে, মরবার সময় বাঁচাও বাঁচাও বলে কেঁদেছে, সে কি। গভীর রাত্রের নির্জনতার অবসরে ছায়াশরীর নিয়ে সবকিছুকে ছোঁবার জন্য, পাবার জন্য আসবে না? তিনি নিজেও মধ্যে মধ্যে উত্তপ্ত মস্তিষ্কে ভাবতেন—দেখা যদি দেয় বনু তবে প্রশ্ন করবেন মৃত্যু কী? মৃত্যু কেমন? কী রূপ? কেমন স্পর্শ? কেমন স্বাদ? বনু কাদল। ভুবন রায় ধীরভাবে হিসেব নিকেশ চোকালেন। গণেশ বায়েন পরমানন্দে জীবন-মহোৎসব করলে। এই বিচিত্ররূপিণী বহুরূপার আসল পরিচয়টি কী?