–আর পারছি না মশায়। অনেক জায়গা ফিরে এলাম। আপনি বলেছিলেন পারুলেতে কবরেজদের কাছে যেতে, তাও গিয়েছিলাম। কিন্তু পোষাল না। কোথাও টাকা, কোথাও কিছু। মন লাগল না। শেষে আপনার কাছেই ফিরলাম।
আরোগ্য-নিকেতনের ভিতরে আলো জ্বলছিল। সেতাব বসেছিল আপন মনে ছকে খুঁটি সাজিয়ে, একাই দু পক্ষের হয়ে চাল চালছিল। ঘরে ঢুকে রানা একখানা পুরনো চেয়ারে বসতে গিয়ে নেড়ে দেখে বললে–ভাঙবে না তো? যক্ষ্মা রোগে ধরলেও আমি তো রানা পাঠক! ওজন
আড়ই মন! হাসলে সে।
–ওটাও শালবৃক্ষের সার বাবা রানা।
কপালে হাত দিয়ে রানা বললে—আমি রানা পাঠক, আমিও নিজেকে দৈত্যি মনে করতাম গো! বুক ঠুকে চেঁচিয়ে বলেছি, আশি বছরেও পাকা তাল কাঠের মত সোজা থাকব, হাতির মত গণ্ডারের মত হাটব। সোজা চলে যাব দশ-বিশ ক্রোশ! তা—হুঁ। হতাশার হাসি ফুটে উঠল মুখে, ঘাড় নেড়ে আক্ষেপ করে বললে–পাকা তালেও ঘুণ ধরে, পচ ধরে মশায়!
আশ্বাস দিয়ে বললেন––চিকিৎসা করাও বাবা, নিয়ম কর, ভাল হয়ে যাবে, ভয় কী!
–ভয়! হতাশার হাসির একটি বিশীর্ণ রেখা রানার মুখে লেগেই ছিল, সেই হাসির চেহারাটা পালটে গেল মুহূর্তে। এ হাসি সাধারণ লোকে হাসতে পারে না। এ রানারাই পারে। অনেককাল আগে—এক ভালুকওয়ালা এসেছিল প্রকাণ্ড বড় ভালুক নিয়ে, সে নিজে ভালুকের সঙ্গে কুস্তি করত। রানা তখন বছর বিশেকের জোয়ান। সে বলেছিল–আমি লড়ব তোমরা ভাকাকা সাথ। মারেগা, কামড়ায়ে গা-অ্যাঁচড়ায়ে রক্তারক্তি করে গা তো তোমারা কুছ দায় নেহি। এবং মালসাট মেরে এই হাসি হেসে বলেছিল—আওরে বেটা বনকা ভালকা, আও; চলে আও জঙ্গি জোয়ান! এবং দন্তী ও নখী বিপুলকায় জানোয়ারটাকে পরাভূত করেছিল সে। নিজেও জখম। হয়েছিল কিন্তু তাতে তার এ হাসি মিলিয়ে যায় নি।
ভয়? রানা বললে—না–না না মশায়, ভয় নয়।
বাইরে বাইসিকেলের ঘণ্টা বেজে উঠল। কে? মশায় চকিত হলেন। আবার প্রদ্যোত ডাক্তার এল? কেন? এখন তো আসবার কথা নয়?
রানা বলে গেল—ভয় নয় মশায়। ছেলেগুলা ছোট। অসময়ে যাব? বহুরঙ্গের বহুরসের সংসারে এলাম-রঙ্গরস ভোগ করতে পেলাম না! আর যাব যাব-একটা পাপ করে তারই ফলে পাপীর মত যাব? এই আর কি! এখুনি পথে মতে কামারের দরজায় মতের মা-বুড়িকে তাই বললাম।
—মতির মা ফিরে এল? মশায় ঈষৎ চকিত হয়ে উঠলেন।
পথের দিকে নিবদ্ধ তার উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি রানার মুখের উপর ফিরল। একটা যেন ঝুঁকি খেলেন তিনি। ঘরে ঢুকল বিনয়; বললে–হ্যাঁ এল। দেখে এলাম।
রানা বললে—একটা পা সাদামতো কী দিয়ে ব্যান্ডেজের কাপড় লেপন দিয়ে বেঁধে রেখেছে। গরুর গাড়ি থেকে মতি আর মতের বেটা ধরাধরি করে নামাচ্ছে। আমি মশায় দেখে থমকে দাঁড়ালাম। বললাম তা তুই একটা রঙ্গ দেখালি মতির মা! তা ভাল। বুড়ি বললে—তা রঙ্গ বটে ঠাকুর। সে কী কাণ্ডকারখানা। কী ঘর-দুয়োর, কী আলো, কী ব্যবস্থা, কী চিকিচ্ছে। কাটলে কুটলে—তো জানতে নারলাম। তাপরেতে, দিন কতক কষ্ট বটে। শুয়ে শুয়ে মল-মূত্র। ত্যাগ। তবে যত্ন বটে, ফুটফুটে টুকটুকে ভদ্রঘরের মেয়ে ধবধবে পোশাক পরে, মাথায় টুপি দিয়েওষুধ খাইয়ে দেওয়া, পথ্যি দেওয়া, মুখ মুছিয়ে নেওয়া-বাবা, বলব কী ময়লা মাটির পিত্তর সরানোসব করছে! আর ডাক্তার কী সব? মশায় তো আমার নিদেন হেঁকে দিয়েছিল তা দেখ বাবা ফিরে এসেছি। বলেছে মাস তিনেক পরে এইসব খুলে দেবে তার পরে এক মাস মালিসতার পরে পা ফিরে পাব। আমি বললাম আর কী পেলি মতির মা? অমর বর। পেলি না? তা মতে কামার রেগে উঠল, বললে—যাও ঠাকুর যাও। নিজে তো বাঁচবার জন্যে পথে পথে এর কাছে ওর কাছে ঘুরছ—এ দেবতা ও দেবতার পায়ে মাথা খুঁড়ছ! বললাম—মতে, তোর মায়ের বয়েস হলে কি রানা বাঁচতে চাইত রে? আমার ছেলে দুটো নেহাত নাবালক, একটা কন্যে আছে, আর আমার দাদা রাঘব বোয়াল, আমি না থাকলে সব গিলে খেয়ে দেবে। বুঝলি? নইলে রানার মরতে ভয় নাই। কতবার মরণের সঙ্গে পড়েছি। বন্যেতে ভেসে যাওয়া লোক মরণের মুখ থেকে এনেছি। জিতেছি। একবার না হয় হারব। তাতে কী?
জীবনমশায় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন, কথাগুলি শুনছেন বলেও মনে হল না। মাটির মূর্তির মত নিথর নিস্পন্দ হয়ে গেছেন তিনি।
তার মনে পড়ে গেল প্রদ্যোত ডাক্তারের আজকের চেহারা। ধীর নির্ভীক চিন্তাকুল দৃষ্টি, তাতে ইনজেকশনের সিরিঞ্জে স্পিরিট ভরে ধুচ্ছেন। মধ্যে মধ্যে রোগীর দিকে তাকিয়ে দেখছেন। চিবুক, ঠোঁটের রেখায় দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ফুটে রয়েছে।
বিনয় বললে—দাঁড়ান, তিন মাস কেটেছে, এখনও তিনি মাস বাকি। ছ মাসের মেয়াদ দিয়েছিলেন মশায়।
–না। ঘাড় নেড়ে মশায় বললেন–মতির মা বাঁচবে।
–তা বাঁচুক। রাবণের মা নিকষা হয়ে বেঁচে থাকুক।
নারায়ণ! নারায়ণ! বলে উঠলেন মশায়। যেন সমস্ত পরিবেশটা অশুচি অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে।–থাক ও কথা।
—থাকুক। কিন্তু আপনি আমার চিকিৎসা করুন। বাঁচি বাঁচি, না বাঁচি না বাঁচি। মরণে আমার ভয় নাই। নিন্দেও আমি করব না। বিনয় আমাকে দয়া করেছে, বলেছে ওষুধ যা লাগে ও দেবে; আপনি চিকিৎসা করুন। আমি শুনলাম, বিনয় আজই বললে—হাকুড়ো কাহারের ছেলে পরানের মুখ দিয়ে ঝলক ঝলক রক্ত উঠত, আপনি তাকে সারিয়েছিলেন।
মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, তিনি সারিয়েছিলেন কিন্তু সে এ কালরোগ নয়।
বিনয় বললে—আপনি দেখুন মশায়। ব্রাহ্মণকে বাঁচান।