হাতখানি নামিয়ে দিলেন মশায়, বললেন– ডাক্তারের কাছে কাউকে পাঠিয়েছ?
—জামাই নিজে ছুটে গিয়েছে।
–তিনি আসুন। তিনি ওষুধ দেবেন।
–আপনি কিছু মুষ্টিযোগ
–আমার মুষ্টিযোগ কাজ করতে করতে রোগ হাতের বাইরে চলে যাবে বাবা। রোগ রক্তে। ইনজেকশন রক্তে কাজ করবে। তিনি আসুন।
—মশায়দাদু, আমার খোকন–?
–ভয় কী ভাই? ডাক্তার আসুন। ওষুধ দেবেন। এখন ঝড় উঠেছে দিদি। শক্ত হয়ে হাল ধরে বোসো। ভয় কী? নিম্পাপ শিশু, বালাধাত; ওষুধ পড়বামাত্র ধরবে। বাইরে বেরিয়ে এসে মশায় বললেন– জর আরও বেড়েছে অহীনচারের ওপর। এখনও বাড়বে।
–বাড়বে?
–বাড়বে—এই যে ডাক্তারবাবু এসে গিয়েছেন।
প্রদ্যোতকে নিয়ে এসে পৌঁছল অহীনের জামাই। অহীন বলে উঠল, জ্বর আরও বেড়েছে। বাবা। কাকা বলছেন–হাত দেখেছেন–
ডাক্তার ভিতরে চলে গেল বিনা বাক্যব্যয়ে। মশায়ের হাত দেখায় সে অসন্তুষ্ট হয়েছে বলে মনে হল।
মশায় ক্ষুণ্ণ হলেন না। ভিতরেও গেলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। রোগী এখানে শিশু। তার জীবনের কোনো ত্রুটিতে মৃত্যুকে নিমন্ত্ৰণ নাই। এই মৃত্যুই অকালমৃত্যু। এমন মৃত্যু দেখেছেন অনেক। কিন্তু সেখানে যুদ্ধ করেছেন প্ৰতিপক্ষ হিসেবে। আজ দেখছেন। ব্যাধির সঙ্গে নয়, এ যুদ্ধ মৃত্যুর সঙ্গে, রোগীর খুব কাছে এসে সে দাঁড়িয়েছে, শিয়রে নয়তো পাশে, নয়তো পায়ের তলায়, হয়ত মায়ের পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধ, বধির, পিঙ্গলকেশী।
ব্যস্তভাবে কে বেরিয়ে এল। কে? অহি সরকারের ছেলে। একখানা বাইসিকেল টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল। পিছনে এল ডাক্তার নিজে—চিৎকার করে বললে–বলবে, আমি বসে রয়েছি। এক্ষুনি আসেন যেন!
—ডাক্তারবাবু? মশায় ডাকলেন।
–বলুন।
–কেমন দেখলেন? আমি ছেলেটিকে ভালবাসি ডাক্তারবাবু।
—আপনি তো নিজে দেখেছেন। প্রদ্যোত একটু হাসলে।—আপনি যা দেখেছেন ঠিকই দেখেছেন, জ্বর বেড়েছে। সাড়ে চারের কাছে।
—কী বুঝছেন?
একটু চুপ করে থেকে প্রদ্যোত বললেচারুবাবুকে কল দিয়ে পাঠালাম। ওঁর সঙ্গে একটু পরামর্শ করব। আমার একটু বাঁধা লাগছে। স্ট্রেপ্টোকাসে তো সাধারণত এমনভাবে ফোলে না! এত জ্বরঃ ভাবছি মামস্ নয় তো?
–মামস্ নয় ডাক্তারবাবু। সেটা আমি আপনাকে বলছি। রোগীর রক্ত বিষাক্ত হয়েছে। বেশি সময় নেই ডাক্তারবাবু, যা করবার এখুনি করুন।
—তা হলে কী বলছেন? সেলুলাইটিস? ইরিসিপ্লাস? বাঁচবে না বলছেন?
–নিদান হাঁকার দুর্নাম আমার আছে। হাসলেন মশায়—কিন্তু না। সে কথা বলছি না আমি। নাড়িতে এখনও পাই নি। রোগ কখনও গোড়া থেকেই আসে মৃত্যুকে নিয়ে। কখনও রোগ বিস্তার লাভ করে মৃত্যু ঘটায়। আপনি আপনার ওষুধ দিন, মাত্রা দ্বিগুণ করুন। রোগ হু-হু করে বাড়ছে।
–বলছেন দেব পেনিসিলিন? আট ঘণ্টা অবশ্য পার হয়ে গেছে। চিন্তিত মুখে ঘরের মধ্যে চলে গেল প্রদ্যোত ডাক্তার। আবার বেরিয়ে এল। নিজের সাইকেলটা তুলে নিয়ে চলে গেল। বলে গেল—আসছি। পেনিসিলিন নিয়ে আসছি আমি। পাঁচ লাখ চাই। আড়াই লাখ আছে আমার কাছে।
বিস্ময়বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে মশায় প্রদ্যোতের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
চারুবাবু আসবার আগেই প্রদ্যোত পাঁচ লাখ পেনিসিলিন দিয়ে বেরিয়ে এল। খাবার ওষুধ তৈরি করতে লাগল। বসে রইল স্তব্ধ হয়ে রোগীর দিকে চেয়ে।
চারুবাবু এলেন। তখন জ্বর একশো চার পয়েন্ট ছয়—বললেন–তাই তো! মাম্স্ বলছেন?
–না—সেলুলাইটিস কি—
চোখ বিস্ফারিত করে তাকালেন চারুবাবু। বুঝেছেন তিনি। মশায় দেখেছেন নাকি?
–দেখেছেন। আমি পাঁচ লাখ পেনিসিলিন দিয়েছি।
–দিয়েছেন? তাই দিন। থাকলে ওতেই থাকবে। মশায় কই?
মশায় গিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ বসে আবার নাড়িটা ধরলেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে দেখলেন। ঝড়ের শেষের কিছু পূর্বে যেমন আলোর আভা ফুটে ওঠে বর্ষামুখর ছায়াচ্ছন্নতার মধ্যে-তেমনি যেন মনে হচ্ছে ঝড়ের ঊর্ধ্বগতিতে এখনকার মত ছেদ পড়ল। জ্বর কমবে এবার। মৃত্যু সরে যাচ্ছে—পায়ে পায়ে পিছনে হটে গেল খানিকটা। আবার রাত্রি তিনটেচারটের সময় একবার আসবে।
বেরিয়ে এলেন মশায়। চারুবাবু চলে গিয়েছিলেন। প্রদ্যোত ব্যাগ গোছাচ্ছে! মশায় বললেন––জ্বর বাঁধ মেনেছে ডাক্তারবাবু। এবার কমবে।
–কমবে?
–হ্যাঁ। নাড়ি দেখে এলাম।
–থার্মোমিটার দিয়েছিলেন?
–না। আরও আধঘণ্টা পর দেখবেন। এখন থার্মোমিটারে ধরা যাবে না।
তাই কমল। পাঁচটার সময় জ্বর উঠল তিন পয়েন্ট ছয়। রোগী চোখ মেলে। কথা কইলে। রোগীর চোখে পলক পড়ল, ভাষার মুখরতা ফুটল দৃষ্টিতে।
জীবনমশায় তাকিলে রইলেন–রক্তাভ স্ফীতির পরিধির দিকে। পুঞ্জীভূত মেঘের মত ব্যাধির বিষজর্জরতা জমে রয়েছে, জ্বরের বায়ুবেগ সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়েছে। মৃত্যু এখনও ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত ওই কোণে। শিশুটির দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন—ভয় নাই। চৈতন্য ফিরেছে—কথা বলছে, হাসছে কখনও কখনও, চৈতন্য স্তিমিত হলে আচ্ছনের মত পড়ে থাকবে। বাঁচাও বলে চেঁচাবে না, কাঁদবে না। শেষ মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যাবে, নিস্তরঙ্গ, স্থির হয়ে যাবে প্রশান্তির মধ্যে।
একটা ভারী গলার আহ্বানে মশায়ের চমক ভাঙল।—মশায় আছেন? মশায়! ভারী দরাজ গলা, কিন্তু ক্লান্ত। ও, রানা পাঠক! রানার টি-বি হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে নয় তাই-ই বটে। সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছেন। আজ এই রাত্রে? বেরিয়ে এলেন মশায়। রানীই বটে।
—কী বাবা রানা? এত রাত্রে?