—কে? মাঠাকরুন! এই, এই আছেন শশীবাবু আছেন।
—একটু ডেকে চেতন করিয়ে দাও বাবা।
মায়ের ডাকে শশী টলতে টলতে উঠে আসত। মা নিয়ে আসতেন তার জামা হুঁকো কল্কে স্টেথোসকোপ! শশী বলত—ওগুলো নে।।
বৈশাখের ঝা-ঝ-করা দুপুরে গামছা মাথায় দিয়ে শশীর মায়ের ছেলের সন্ধানে বের হওয়ার একটি স্মৃতি তার মনে আছে। জীবনমশায় কল থেকে ফিরছেন গরুর গাড়িতে। পৃথিবী যেন পুড়ে যাচ্ছে। রাস্তায় জনমানব নাই, জন্তু-জানোয়ার নাই, কাকপক্ষীর সাড়া নাই, অস্তিত্ব নাই। এরই মধ্যে শশীর গৌরবর্ণা মোটাসোটা মা আসছিলেন, মধ্যে মধ্যে দাঁড়াচ্ছিলেন, এদিকওদিক দেখছিলেন। সাহাদের দোকানে সেদিন ছেলের সন্ধান পান নি। সাহা বলেছে, শশীবাবু আজ বাইরে কোথা খেয়ে এসেছেন; দোকানে ঢােকেন নি। গিয়েছেন এই পথ ধরে। মা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন; তা হলে নিশ্চয় রাস্তায় কোথাও পড়ে আছে।
পড়েই ছিল শশী, পথের ধারে একটা বটগাছতলার ছায়ায় শুয়ে বমি করে জামায় কাপড়ে মুখে মেখে পড়ে আছে; পাশে বসে একটা কুকুর পরম পরিতোষের সঙ্গে তার মুখ লেহন করে উগীরিত মাদক-মেশানো খাদ্য খেয়ে মৌজ করছে। মা তাকে ডেকে তুলতে চেষ্টা করে তুলতে পারেন নি। জীবনমশায় তার গাড়ােয়ানকে দিয়ে শশীকে তুলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
মত্ত শশী উঠে জীবন মশায়কে দেখে বলেছিল—কথাটা আজও মনে আছে জীবন মশায়ের। বলেছিল—মশায়বাবু গুরুদেব, চলে যান আপনি! মা ছুঁয়েছে—আমি ঠিক হয়ে গিয়েছি; আমার। মায়ের একবিন্দু চোখের জল পৃথিবী ড়ুবিয়ে দিতে পারে মহাশয়! ইয়েস, পারে। আলেকজান্ডার দি গ্রেটের কথা স্যার! অ্যান্টিবোডাস ডাজ নট নো-অ্যান্টিবোডাস জানে না আমার মায়ের একবিন্দু চোখের জল—!
জীবনমশায় ধমক দিয়ে বলেছিলেন—যা—যা, বাড়ি যায়।
—যাব, নিশ্চয় যাব! নিজেই যাব! কারুর ধমক খাই না আমি।
খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আবার বলেছিল–হু ইজ টু অ্যাভিসিয়েট মাই মেরিটস? মাই মাদার! মাই মাদার।
মা লজ্জিত হয়ে শুধু একটি কথাই বার বার বলেছিলেন-বাড়ি চল শশী। বাড়ি চল! বাড়ি চল!
সেই মা যদি মরণেও শশীর মত ছেলের চিন্তা ছাড়তে না পেরে থাকেন তাতে। আর পরলোক মিথ্যাই যদি হয়, তবে শশী, শশী তার মাকে ভুলতে না পেরে অসুস্থ মস্তিষ্কে যদি এমনি কল্পনা রচনা করে থাকে, অসুস্থ দৃষ্টিতে যদি মায়াকে কায়া ধরতে দেখে থাকে তবে আশ্চর্য কী?
কত রাত্রে তিনি আতর-বউকে দেখেন বনবিহারীর ঘরে ঊকি মারছেন। তিনি নিজে? কখনও কখনও চেয়েছেন বৈকি!
এই অতসীর ছেলেটি যদি–।
মশায় বললেন–কাল, কাল আসিস বিনয়। কাল। কাল। ছত্রিশ ঘণ্টার আঠার ঘণ্টা গিয়েছে। আরও আঠার ঘণ্টা। ঠিক মধ্যস্থলে।
কে আসছে? অহি?
জ্বর বাড়ছে কাকা। ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। ফুললা বাড়ছে। মুখখানা এমন ফুলেছে—
—অহির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।–আপনি একবার–
–না। তুমি ডাক্তারের কাছে যাও। যদি পারে তো ওরাই পারবে বাঁচাতে। আমি জানি না। আমাদের আমলে এ ছিল না।
২৮. বাঁচালে প্রদ্যোত ডাক্তার
বাঁচালে। তাই বাঁচালে প্রদ্যোত ডাক্তার। ধীর অথচ সাহসী, নিজের শাস্ত্রে বিশ্বাসী নির্ভীক তরুণ চিকিৎসক।
তখন বেলা দুটো। মশায় খাওয়াদাওয়া সেরে সবে উপরের ঘরে এসে গড়িয়েছেন, অহীন সরকার ছুটে এল—মশায়কাকা! কাকা!
কে? অহীন? গলা শুনেই চিনেছিলেন মশায়। ঝড় তা হলে এসেছে! শায়িত অবস্থাতেই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন তিনি। পারলেন না কিছু করতে প্রদ্যোত? নতুন ওষুধ, যার এত। নাম—কিছু হল না তাতে?
—একবার আসুন কাকা!
–কী হল?
–বুঝতে পারছি না। প্রবল জ্বর। ফোলা এমন বেড়েছে যে দেখে ভয় লাগছে। ছেলের সাড়া নাই। বেঘোর। আপনি একবার আসুন!
—উনি গিয়ে কী করবেন বাবা? পাস-করা ডাক্তারও নয়, আজকালকার চিকিৎসাও জানেন না! হাতুড়ে। তার ওপর উনি গেলে তোমাদের নতুন ডাক্তার যদি বলে-হাত ধরব না, দেখব না? মধুর অথচ তীক্ষকণ্ঠে কথাগুলি বলতে বলতেই বেরিয়ে এলেন আতর-বউ। তার ওপর তোমার জামাই হালফ্যাশানে লেখাপড়া-জানা ছেলে!
—চুপ কর আতর-বউ। ছিঃ! চল—আমি যাই অহীন।
–চুপ করব? ছিঃ! আতর-বউ বিস্মিত হয়ে রইলেন স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে।
–হ্যাঁ, চুপ করবে বৈকি।
বলতে বলতেই বেরিয়ে গেলেন মশায়। আতর-বউয়ের কথার দিকে কান দিলে চলবে না এখন।
স্তব্ধ উৎকণ্ঠায় ঘরখানা যেন নিশীথ রাত্রির মত গাঢ় হয়ে উঠেছে। ব্যাধির প্রবল আক্রমণে শিশু চৈতন্যহীন-স্তিমিত দৃষ্টি, নিথর হয়ে পড়ে আছে। শুধু জ্বরজর্জর ঘন শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে ছেলেটির বুক পেট উঠছে নামছে; যেন হাঁফাচ্ছে। মধ্যে মধ্যে অস্ফুট কাতর শব্দ নিশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসছে। মুখের ফোলার অবস্থা দেখে চমকে উঠলেন মশায়। এদিকে বুকের উপর পর্যন্ত চলে এসেছে, ওদিকে দুই কৰ্ণমূল পার হয়ে পিছনের দিকে ঘাড় লক্ষ্য করে এগিয়ে চলেছে। চামড়ার নিচেটা যেন রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে।
ঘরের লোকগুলির মুখে ভাষা নাই, উৎকণ্ঠায় ভয়ে ভাষা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে, নিম্পলক আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। নিশীথ আকাশের তারার মত জেগে রয়েছে। অসহায় গ্ৰহউপগ্রহ সব-অসহায়; তারা তাকিয়ে দেখছে একটি নবজাত গ্ৰহ বিচিত্র কারণে নিভে যাচ্ছে।
মশায় এসে দাঁড়ালেন বিছানার পাশে। সন্তৰ্পণে বসে হাতখানি তুলে দিলেন। অহীন বললেচার। আপনাকে ডাকতে যাবার আগে দেখেছি। প্রদ্যোত ডাক্তারের বন্ধু অরুণবাবু যখন। রক্ত নিয়ে গেলেন তখন ছিল তিন, তিনের কিছু কম ছিল। তারপর দেড়টার সময় বেশডাকে। সাড়া দেয় না দেখে জ্বর লেখা হল—একশো তিন পয়েন্ট দুই। দুটোর সময় প্রায় চার। দুপয়েন্ট কম। তারপর চার দেখে আপনার কাছে গিয়েছিলাম।