ময়দানে বসে একদিন ও পকেট থেকে রুমাল বের করে আমার মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল, কল্পনা, হিরে ছুঁইয়ে তোমাকে বরণ করলাম।
আমি আমার ছোট ছোট চোখে বিপুল বিস্ময় জাগিয়ে বলেছিলাম, হিরে চুইয়ে? ছোঁয়ালে তো রুমাল।
ও বলেছিল, হাত পাতো।
আমি পেতেছিলাম। রুমাল ঝেড়ে একটা হিরে আমার হাতে ফেলে দিয়েছিল দুষ্টু রাজা রবি রে। আমার এই ছোট ছোট চোখ জোড়া নিশ্চয় সেদিন পদ্মদীঘির মতো বড় হয়ে গেছিল। পড়ন্ত রোদে যেন হাজার সূর্য ঝিকমিকিয়ে উঠেছিল আমার হাতের ছোট্ট তেলোয়।
অপলকে চেয়েছিলাম চৌকোণা ধোঁয়াটে সাদা পাথরটার দিকে। বলেছিলাম, অস্ফুট স্বরে, হিরে! এইরকম!
ঠোঁটের কোণে কোণে ওর সেই বিচিত্র কুহেলি হাসি ভাসিয়ে রবি বলেছিল, আরও আছে। দেখবে? বলে, আমার জবাবের প্রতীক্ষা না করে ঘাসের ওপর রুমাল পেতে, ছোট্ট একটা ডিবে বের করেছিল পকেট থেকে। নিতান্ত অবহেলায়। ডিবে উপুড় করে দিয়েছিল রুমালের ওপর।
স্তম্ভিত নয়নে দেখেছিলাম রাশিকৃত খুদে হিরে। বিষম তাচ্ছিল্যে খুদে বজ্ৰমণিদের সাজিয়ে একটা পিরামিড তৈরি করেছিল আমাকে বোবা বানিয়ে রেখে।
‘বজ্ৰমণি’ শব্দটা ওর কাছেই শিখেছিলাম। ওষুধের কারবারে নেমে হিরে নিয়ে ওর এই মাতামাতি প্রথম প্রথম আমার ভাল লাগেনি। বেপরোয়া ও চিরকাল, ওর মুখেই শুনেছি, যা ভাল মনে করেছে। তাই করেছে। কারও কথায় কান দেয়নি। কিন্তু হিরের জগতে এইভাবে যে ঢুকে গেছে, তা তো জানতাম না।
আমার ছোট ছোট চোখের বিস্ময়-বিস্ফোরণ দেখতে দেখতে রবি বলে গেছিল—কল্পনা, কুচি কুচি এই হিরেদের প্রত্যেকের একটা করে ইতিহাস আছে।
আমি বিহুল গলায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, পেলে কোত্থেকে?
কঙ্গোর অ্যাংগোলান হিরের খনি থেকে।
কঙ্গোর হিরে! কলকাতার ময়দানে!
ও আমার কথা যেন শুনতেই পেল না। বলে গেল আপন মনে-অকট্যাহেড্রাল পাথর। প্রত্যেকটায় আছে আটটা দিক—প্রতিটা দিক সমান মাপের। অষ্টহস্ত পাথর—হিরে…আমার হিরে!
যেন আবিষ্ট গলায় কথা বলে যাচ্ছিল রবি রে…সেইদিন…সেই পড়ন্ত রোদের রোশনাইতে দুই চোখের হিরে ঝিকমিকিয়ে পকেট থেকে বের করেছিল একটা ছোট্ট ডিজিট্যাল স্কেল-দাঁড়িপাল্লা আর একটা পরিষ্কার সাদা কাচ। হিরের পিরামিডের পাশে রেখেছিল এক-তা সাদা কাগজ। খুদে চিমটে দিয়ে একটা হিরে তুলে নিয়ে কাচের প্লেটে রেখে, কাচটা রেখেছিল সাদা কাগজের ওপর।
বলেছিল, কল্পনা, এইভাবেই দেখতে হয় হিরের মধ্যে কলঙ্ক আছে কি না।
ফস করে আমি বলে ফেলেছিলাম, যেমনভাবে দেখেছ আমার ভেতরটা?
তুমি? নিষ্কলঙ্ক হিরে…আপন মনে, যেন ঘোরের মাথায় বলে গেছিল হিরে-পাগল রবি রে। প্রেমে পড়লে পুরুষমাত্রই অন্ধ হয়ে যায়। আমার মতো কাচকে তাই হিরে ভেবে নিয়েছিল। মেয়েরা চিরকাল এইরকমই হয়। এই আমার মতো। মুনিঋষিরও মতিভ্রম ঘটে।
মরুক গে। হিরের কথায় আসা যাক।
খুদে চিমটে দিয়ে আর একটা হিরে তুলে নিয়ে আমার পলকহীন খুদে চোখের সামনে নাড়তে নাড়তে আবিষ্ট স্বরে বলে গেছিল হিরে ধুবন্ধর রবি রে—এটার নাম মাকবর।
আকবরের হিরে নাকি?
ন্যাকার মতো কথা বলো না। আকবর হিরে-সমঝদার ছিলেন বলেই তার স্মৃতি রাখবার জন্যে এর নাম মাকবর।
দাম?
কথাটা তুলেও তুলল না রবি। বলে গেল আপন মনে-বড় কঠিন…বড় কঠিন এই হিরেরা—এদের গায়ে আঁচড় কাটতে হলে চাই আর একটা হিরে…হির ছাড়া হিরের গায়ে দাগ কাটতে কেউ পারে না।
কেউ পারে না বললে কেন? চোখের চকমকিতে ঝিলিক ছিটিয়ে আমি বলেছিলাম। আমি তো পেরেছি।
চোখে চোখে চেয়ে রবি রে বলেছিল, কারণ তুমি নিজেই যে বজ্ৰমণি।
আমি কিন্তু সেদিন, সেই ময়দানে, সূর্যদেবের পাটে বসার আলোয়, রবির চোখে দেখেছিলাম খুদে খুদে বজ্ৰমণি।
বজ্ৰমণি চোখেই আমার দিকে অনিমেষে চেয়ে থেকে ও বলে গেছিল, হিরে মহাশয়দের আর একটা গুণ আছে, কল্পনা।
কি গুণ, হে মোর বজ্ৰমণি?
বড় ঠাণ্ডা—বড় ঠাণ্ডা। ছুঁলেই হাত থেকে তাপ টেনে নেয়।
যে হেয়, তাকেও পাথর বানিয়ে দেয়?
হ্যাঁ।
আজ, এতদিন পরে সন্দেহ হয়, রবি রে কি নসত্রাদামুস বিদ্যে জানে? ভবিষ্যৎ দেখতে পায়? আমি, এই কবোষ্ণ কল্পনা, একদিন যে কঠিন প্রস্তর হয়ে যাব–কি ও দিব্য নয়নে দেখতে পেয়েছিল? নাকি, আলগোছে বলে ফেলেছিল আমাদের নিয়তি! কে জানে!
০৫. পেশোয়ারের পাথর
আমার এই ভাঙা কলম উসখুস করছে আমার কথা জবানিতেই লেখার জন্যে। মৃগাঙ্ক বলে বটে, কলম নাকি নিপ্রাণ থাকে না কাগজে চরণ ছোঁয়ালেই। আরবি অশ্বের মতে তখন কলম ছোটে, সূক্ষ্মজগত থেকে অযুত শক্তি এসে কলমে ভর করে। কলমকে প্রাণময় করে দিয়ে তারা লিখিয়ে নেয় অনেক…অনেক মহাসত্য—যা সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। লেখনীমনস্ক মানুষরা তাই প্রপঞ্চময় দুনিয়া সৃষ্টি করে যায় অনায়াসে–নিজেদের অজান্তে।
ও একটু বাড়িয়ে বলে, একটু কেন, বেশ বাড়িয়ে বলে। যে যার নিজের কোলে ঝোল টানে। তবে হ্যাঁ, মৃগাঙ্ক যখন লেখে, তখন দেখেছি, ও যেন অন্য মানুষ হয়ে যায়। আমাকে চিনতে পারে না, নিজের অমন দশরূপা বউকে চিনতে পারে না-আমি তো ছার।
যে দশা এই মুহূর্তে আমার হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আমি তো কলমবাজ কস্মিনকালেও ছিলাম না। বকমবাজ আর বন্দুকবাজ বলে বিস্তর দুর্নাম আছে বটে, বউদি কবিতা আমাকে যখন তখন আর একটা বিষয়ে বিষমবাজ বলে—সে শব্দটা ‘মা’ অথবা ‘মা’ দিয়ে শুরু। শরৎ সাহিত্যে এই শব্দটা যখন তখন এসে গেছে। কিন্তু আধুনিক সাহিত্যে তা অচল। অশ্লীল। দরকার কি? বিশেষ করে, বিশেষণটা যখন সর্বৈব মিথ্যে! বউদিরা স্নেহের দেওরদের অমন বচন বিশেষণে যখন তখন। ভূষণ পরায়।