আমি মঞ্চ অভিনেতার মতো ঈষৎ বিরতি দিলাম বাক্যস্রোতে। পরের কথাটায় শক্তির স্রোত বইয়ে দেব বলে। ওষুধ ধরে গেল। ঈষৎ ঝুঁকে বসলেন পু-পু। অকয়াৎ শিবনেত্র হয়ে গেল দেবা আর দেবী। মানে, রবি আর কল্পনা।
আমি সারেগামা স্বরে চলে গেলাম, ম্যাডাম, যে কোনও হিরের মধ্যে কসমিক এনার্জি ঠুসে দেওয়ার মতো ক্ষমতা আছে, এমন আশ্চর্য এক সেট পাথরের ডিম বিয়ের যৌতুক পেয়েছিল রবি। প্রতিটা পাথরের ডিমের ফাঁপা গহ্বরে ছিল—এখনও আছে-এক-এক রঙের কুচি হিরে। কল্পনা, হিরের বাজারের মেয়ে কল্পনা চেয়েছিল, সেই সেট থাকুক তার কাছে। এ রকম যাজ্ঞা মেয়েদের পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু, জহুরি দণ্ডপথ, যিনি এই হিরের ডিমের সেট আর মন্ত্র দান করেছিলেন রবিকে, পই পই করে নিষেধ করে গেছিলেন রবিকে—এমন দুর্বলতা যেন কখনও দেখানোনা হয়।
আবার বিরতি দিলাম বাক্যস্রোতে। আড়চোখে দেখে নিলাম কল্পনার মুখাবয়ব। সে মুখ রাঙা হয়ে গেছে। ফর্সা হয়ে গেছে। ফর্সা মেয়ে তো…।
বললাম, কল্পনা তাই স্বামীর অগোচরে আশ্চর্য হিরেদের খানকয়েক আত্মসাৎ করেছিল। পরিণাম, ডিভোর্স। কল্পনার হেথায় আগমন। আমাকে পিছনে লেলিয়ে দেওয়া। সেটা রবি একা করেনি, প্রেমচাঁদও আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিল-অফিসিয়াল চুক্তি—তার কাছে নেটওয়ার্ক খবর এনে দিয়েছিল, কলকাতার শিল্পমেলা থেকে হাওয়া হয়ে যাওয়া হিরের ডিমও যেতে পরে কল্পনার খপ্পরে—একই কারণে হিরে প্রেম, হিরে সঞ্চয়, হিরে দেখে ধ্যান।
স্ট্রেঞ্জ, ঈষৎ নাসিকাধ্বনি সহ বললেন পু—পু।
এক্সট্রিমলি, আমি বললাম অহীন চৌধুরি ঢঙে-কল্পনা অবশ্য হিরের চোরাচালানি আর টেররিস্ট গ্যাংয়ের পার্টনার নয়। কিন্তু পেশোয়ার থেকে অনিক্স পাথরের ডিম কলকাতার শিল্পমেলার মধ্যে দিয়ে পাঠানো হচ্ছিল যাদের কাছে, ক্ষিপ্ত হয়েছিল তারা।
তাদেরই একজন এই নাইজেল? পু-পু বললেন মিহি গলায়।
ইয়েস, ম্যাডাম, ইয়েস। তাই তারা কল্পনাকে আর রবি রে-কে টাইট মেরে হিরে উদ্ধারের জন্যে সোমনাথকে কিডন্যাপ করে–টেলিফোনে মুক্তিপণ চায়… কী?
ডিম।
ওদের এই অ্যাকশন প্ল্যান অজানা ছিল আমার কাছে। কিডন্যাপিংয়ের একটা প্লাবন চলেছে ভারত জুড়ে—সেই প্লাবন যে সিকিমের এই গণ্ড পাহাড়ে আছড়ে পড়বে, এটা আঁচ করলে আমি আরও একটু সতর্ক হতাম। সোমনাথকে একলা ছাড়তাম না। আমার নজর ছিল কল্পনার দিকে। সে যেন টার্গেট না হয়—হিরে তো তার আগের স্বামীর কাছে-তার ছেলের কাছে তো নেই। ভুল করেছিলাম এইখানেই।
মানুষমাত্রই ভুল করে, মৃদুস্বরে সান্ত্বনা দিলেন পু-পু-শয়তানে করে না।
সত্যি কথা বলতে কি, পুলিশ পুঙ্গবীর এ হেন মৃদু বচন বিপুল স্বস্তিবোধ এনে দিল আমার মধ্যে। আমি বলে গেলাম-কিছু হিরে যার কাছে, চোখে চোখে রাখি তাকে, এই ছিল আমার গেমপ্ল্যান। কল্পনা ভেবেছিল উল্টো-বন্ধুর ডিভোর্সি বউয়ের দিকে নিশ্চয় নেকনজর দিয়ে চলেছি।
ঠিক এইখানে নিতান্তই বেরসিকের মতো গলা খাঁকারি দিয়ে বসল বন্ধুবর রবি রে। বললে, আমি কিন্তু তোকে ঠিক সেই রোলটাই প্লে করতে বলেছিলাম।
আমি বললাম, মাই ডিয়ার রবি রে, আগুনে হাত দিয়ে পুড়ে মরব নাকি? তবে হ্যাঁ, সেই আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিংয়ে তোর অ্যাকটিংটা হয়েছিল অনবদ্য-সোমনাথ কিডন্যাপড় হয়ে গেছে শুনে তুই মিসাইলের মতো এমন চার্জ করে বসলি আমাকে, যেন সত্যিই কল্পনাকে ক্যাচ করার জন্যে পথের কাঁটা সোমনাথকে ভ্যানিশ করে। দিয়েছি আমিই।
ঠোঁটের কোণে কোণে নিগৃঢ় হাসির মাকড়সা জাল ছড়িয়ে রবি বললে, হে বন্ধু, তুমি একাই অ্যাকটিং শেখোনি। স্কটিশ তুই ছিলিস হ্যালির ধুমকেতু, আমি ছিলাম–
পু-পু বললেন, কাট শর্ট! কাট শর্ট!
আমি বললাম, চেয়ার পার্সনের অর্ডার হয়েছে শর্টকাট করার। তবে হ্যাঁ, তোর মোস্ট ন্যাচারাল অ্যাকটিং আমাকে খুব বেদনা দিয়েছিল।
আহারে। বললে রবি।
পু-পু ফের মন্তব্য নিক্ষেপ করতে যাচ্ছিলেন, আমি দক্ষিণ হস্ত শূন্যে তুলে বললাম, তিষ্ঠ ম্যাডাম। আমি চাইছি, কেসটাকে ট্র্যাজেডির দিকে না নিয়ে গিয়ে ইউনিয়নের দিকে নিয়ে যেতে।
হোয়াট ড়ু ইউ মিন?
কথায় বলে, অল সেপারেশনস এণ্ড ইন ইউনিয়ন। অ্যাণ্ড নাউ আই ওয়ান্ট দেম টু কাম টু এগ্রিমেন্ট।
টু বি রিইউনাইটেড?
টু অ্যাডজাস্ট ডিফারেন্সেস, হারমোনাইজ, অ্যাণ্ড লিভ টুগেদার-না, না, সেই লিভ টুগেদার নয়—টু লিভ অ্যাজ স্বামী অ্যাণ্ড স্ত্রী।
এটা কি একটা মিলন মন্দির।
ধরুন তাই। সব নাটকই যদি মিলনান্ত হয়, তাহলে জীবনটা কত মধুর হয় বলুন তো? আমরা একটা দৃষ্টান্ত রাখতে চাই, এই ডিভোর্স মহামারীর যুগে, ভুল করে যদি কিছু ভেঙে যায়, ভুল শুধরে নিয়ে তা জুড়ে নেওয়াই ভাল। ভালবাসার মেন্টিং পটে ভাঙা কাচও জুড়ে যায়। বিশেষ করে ওরা যখন এক চৈত্র মাসে একে অপরের চোখে নিজের নিজেদের সর্বনাশ দেখেছিল। প্রকৃত প্রেম তো তাকেই বলে। জ্বালায়, আবার জোড়া লাগায়।
পু-পু পুলিশি চোখে আমাকে জরিপ করতে করতে বললেন, আপনি কি অন্তর্যামী? থট রিডার? এই দুজন-রবি আর কল্পনাকে দেখিয়ে-এই দু’জন যদি এখনও প্রেমাসক্ত থাকেন, তাহলে এই লঙ্কাকাণ্ডটা বাঁধালেন কেন?
আমি টুকুস করে বলে দিলাম—অপরাধ নেবেন না, মেয়েরা একটু দ্রৌপদী-দ্রৌপদী টাইপের হয়—বিশেষ করে এই হাই-টেক যুগে সিলিকন বিউটি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা যখন চরমে উঠে বেশরমে পৌঁছে একটা হিড়িকে পর্যবসিত হয়েছে… ট্রয়য় ধ্বংস হয়ে গেল… লঙ্কাটঙ্কা পুড়ে ছাই হয়ে গেল… কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটা… এই দ্রৌপদীর জন্যেই… হয়েছিল বলেই তো আমরা গীতা পেয়েছিলাম। উল্টে নিন গীতা-কে… ত্যাগী। একটু ত্যাগ করলেই সব পাওয়া যায়। বিশেষ করে ছেলের জন্যে সব বাবা, সব মা ত্যাগ করে এসেছেন যুগ যুগ ধরে। নইলে যে ছেলেরা সোশ্যাল প্রব্লেম হয়ে দাঁড়াবে। আমি সোমনাথকে ক্লোজলি ওয়াচ করেছি, ওর মনের নিঃসঙ্গতা আমাকে কষ্ট দিয়েছে। মন্তেসরি। কি বলেননি, প্রথম দু’বছরই শিশুর মস্ত শিক্ষা সমাপ্ত হয়? ছ’বছরে বলতে গেলে জগত দর্শন করা হয়ে যায় মা আর বাবার মধ্যে দিয়ে। আর সোমনাথ? ঠিক ওই ছ’বছর বয়স থেকেই বাবাকে চোখের আড়ালে এনে ফেলল মায়ের চাপে। রবি, তোর বিবেক, তোর জাজমেন্ট, তোর পাওয়ার অফ অবজারভেশন, তোর ডিসিশন নেওয়ার ক্ষমতাতে আমি ঈর্ষা করি। সোমনাথের মুখ চেয়ে তুই কল্পনাকে কাছে টেনে নে। দেবর-বউদি সম্পর্ক থাকুক আমার সঙ্গে কল্পনার। তোরা এক হয়ে গিয়ে হিরে পাণ্ডাদের মেরে ঠাণ্ডা কর।