থাক আরও বর্ণনা। বিধাতার নির্মম প্রহসনের কিঞ্চিৎ আভাস দেওয়ার জন্যেই নক্কার জনক প্রসঙ্গে কিছুটা ছুঁয়ে গেলাম। এ হেন নরকের কাছেই নির্মিত হতে চলেছে আর এক নরক…
সোমনাথের জীবন্ত কবর!
সোমনাথের ধমনীতে বইছে কিন্তু রবি রে’র রক্ত। বংশগতির মহিমা দেখিয়ে গেছিল কফিনে চিৎ অবস্থায় শুয়ে। হাতের মুঠোয় ইন্দ্রনাথ রদ্রের রৌপ্যপদক-সিলভার স্টার।
ধারালো কোণ দিয়ে ঘসে ঘসে কেটেছে প্লাস্টিক কফিনের ঢাকনা। ঝুর ঝুর করে ধুলো ঝরেছে, একটার পর একটা কোণ ভোতা হয়েছে, পরপর তিনটে কোণের ধার যখন চলে গেছে, চতুর্থ কোণ দিয়ে কাজ আরম্ভ করতেই দেখেছিল, মাথার ওপর ফুটো দিয়ে তারার আলো আর আসছে না।
পরক্ষণেই ভেসে এসেছিল দুশমন কণ্ঠস্বর, বেঁচে আছিস?
জবাব দেয়নি সোমনাথ।
দুই কিডন্যাপার এসেছে খোঁজ নিতে। কেন জবাব দেবে সোমনাথ?
শোনা গেল কণ্ঠস্বর–নিশ্চয় ঘুমোচ্ছে।
অন্য কণ্ঠস্বর—অথবা মটকা মেরে রয়েছে। এই অবস্থায় কেউ ঘুমোয়?
তাহলে থাক।
নৈঃশব্দ্য ফিরে এল মাথার ওপর। একটু সবুর করল সোমনাথ। রুপোর কোণ দিয়ে ঘষে ঘষে প্লাস্টিক কাটা শুরু হল তার পরেই। খুব আস্তে…খুচ খুচ খুচ করে…আওয়াজ যেন ওপরে না যায়।
অনেক পবে পেয়েছিল কঠোর কেরামতির পুরস্কার। ধুস করে কাটা প্লাস্টিক আচ্ছাদন ধসে পড়েছিল গোটা শরীরটার ওপর। ওপরকার তিনফুট ধুলোর ওজন তো কম নয়।
কিন্তু ঘাবড়ায়নি সোমনাথ। টু শব্দও করেনি। গায়ের জোরে প্লাস্টিক ডালা সামেত ধুলোর বোঝা মাথার ওপর তুলে যখন বেরিয়ে আসছে কবরের গর্ত থেকে, ছুটে এসেছিল দুই কিডন্যাপার। একটু দূরে থাকলেও তাদের চোখ ছিল যে এইদিকেই। পঞ্চানন ঘোষালের ‘অপরাধ বিজ্ঞান’ পুস্তকে এমন কথাই তো লেখা আছে : অপরাধী অপরাধের জায়গায় ঘুরে ফিরে আসে…
তাই তারা প্রথমে দেখেছিল কবরের ঝুরো মাটি তোলপাড় হচ্ছে, তারপরেই দেখেছিল সোমনাথকে উঠে আসতে…
কিন্তু পালাতে দেয়নি। দৌড়ে গিয়ে মুখ চেপে ধরে টেনে এনেছিল গ্যারেজের মধ্যে। আর ঠিক তখনই নিঃশব্দে…অতিশয় শব্দহীন এবং বিদ্যুৎসম গতিতে সুফির সেই ভয়াল সারমেয়-বাতাসে ডিজেলের গন্ধ শুকে শুকে এসেছিল এইখানে…
সাদা ভ্যানের ডিজেল ট্যাঙ্কের ছোট্ট চিড় দিয়ে যেটুকু গন্ধ বেরিয়ে বাতাসে ভেসে থেকেছে, প্রশিক্ষণ পাওয়া শিকারি কুকুরের কাছে সেইটুকুই তো মস্ত ক্লু!
মারামারির বর্ণনাটায় আর গেলাম না। ও সব থাকে হিন্দি সিনেমায়। দুই অ্যালোপেসিয়া আতঙ্ক জ্বলন্ত চোখে কীভাবে চেয়ে থেকে কীভাবে তেড়ে গিয়ে কি কাণ্ড করেছিল, যাক সেসব কথা। আমি ঘায়েল করেছিলাম বেটে মর্কটটাকে রামরদ্দা দিয়ে। ঘাড়ের একটা বিশেষ জায়গায় ঠিকমতো চোট মারতে পারলে মহাবীরও চোখে সর্ষেফুল দেখে। আমি দেখিযে ছেড়েছিলাম।
তারপর আমাকেই রিভলভারেব বাঁট চালাতে হয়েছিল ভয়ঙ্কর আকৃতির সেই অ্যালোপেসিয়া আতঙ্কের মাথা টার্গেট করে—যাঁর সারা মুখ ঘিরে চামড়া পুড়িয়ে দাগানো হয়েছে—’যে গলা টিপে ধরেছিল সুফির।
করোটি চুরমার হয়নি। তবে চোটটা ছিল প্রায় মারাত্মক। অমন প্রহর খেলে মহাবীরও জ্ঞান হারায়।
গ্যারেজ থেকে যখন বেরিয়ে এসেছিলাম, দেখেছিলাম একটু তফাতে নিন্দনীয় প্রমোদকাননের জানলায় জানলায় চমকে চমকে উঠছে বহুরঙের ফ্ল্যাশ…
উল্লাস… উল্লাস… উল্লাস!
৩০. ক্লু
ভূমিকা আর উপসংহার যত ছোট হয়, ততই ভাল।
গোল টেবিল বৈঠক বসেছিল পুলিশ ডেরায়। চেয়ারপার্সন সেই পুলিশ পুঙ্গী। সিকিমি কন্যা। প্রশিক্ষণের দৌলতে তবর বড় নীরস। কিন্তু সেদিন সেই মুহূর্তে তার প্রোজ্জ্বল নয়ন তালিকায় যে বিজুলি দেখেছিলাম, তা আমার কর্মজীবনে দেখেছি বহুবার বহু সুন্দরীর চোখে। কিন্তু আমি যে ভীষ্ম, আমি অতিশয় কাঠখোট্টা নারস তরুবর। প্রেম-ট্রেম, বিয়ে-থা, সংসার-টংসার করার ব্যাপারে অতিশয় উদাসীন। আমি খুবই সাধারণ মানুষ। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে পৃথিবীর বহু বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে আমার তুলনা করা চলে। •াম বলে যাব? ক্ষমা করবেন আমার ধৃষ্টতার জন্যে। বিখ্যাত দার্শনিক কান্ট বিয়েই করেননি। বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও। ‘দ্য ডেক্লাইন অ্যাণ্ড ফল অব রোমান এম্পায়ার’ বইটা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন লেখক এভোয়ার্ড গিব্বন কত বড় লেখক। অথচ পাত্রীর পিতা তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেননি লেখককে জামাই করবেন না বলে। ফলে, গিব্বন সাহেব অকৃতদার রয়ে গেছিলেন সারা জীবন। আমার জীবনের প্রথম দিকে প্রায় এই ধরনের একটা দাগা ছিল, তা অনেকেই হয়তো জানেন। কিন্তু হারবার্ট স্পেনসার? চিন্তার সাগরে ড়ুবে। থেকেই গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিলেন, ললনা-ছলনায় একদম ভুললেন না। বৈজ্ঞানিক নিউটন এমনই আত্মভোলা ছিলেন যে ভাবীপাত্রীকে বিয়ের কথা না বলে তার আঙুল দিয়ে তামাক খাওয়ার পাইপ খুঁচিয়ে সাফ করা শুরু করেছিলেন—বিয়ে আর হল।, উনিও সারা জীবনে বিয়ের চৌকাঠ আর মাড়াননি। বিয়ে-টিয়ের মধ্যেই যাবেন, এহেন ধনুর্ভঙ্গ পণ করে সাহিত্যিক ল্যাম্ব, শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, সঙ্গীত গুরু বিঠোফেন, ধর্মগুরু আলেকজাণ্ডার পোপ, লেখক লুই ক্যারল, জোনাথন সুইফট, কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান, হ্যান্স আণ্ডারসন, ভলতেয়ার, ম্যাকলে, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো এবং আরও অনেক জগতবরেণ্য পুরুষ। মালা বদলের কথা আজীবন ভাবেননি।