এখন দেখাবে নাকি সোেমনাথকে? শিউরে উঠে সিটিয়ে গেছিল দশ বছরের ডানপিটে।
দশ আঙুল-নখের দশখানা ছুরি সোমনাথের চোখের সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেছিল কালিকা রানি–গাধা কোথাকার। ধার দেখেছিস ডগায়? দশখানা তুরপুন। ফুটিয়ে দিলে–
আমি বাড়ি যাব।
দেব তোর পেট চিরে—ফের যদি চেঁচাবি।
মা…মা…
তবে রে! কালিকা রানি লাফিয়ে আসতেই… তিড়বিড়িয়ে ছিটকে যেতে গেছিল সোমনাথ। আর ঠিকতখাই, প্যান্টের পকেটে থাকা জিনিসটা প্যাট করে ফুটে গেছিল উরুর চামড়ায়। রুপোর সেই তারকা। যা সে পেয়েছিল… ইন্দ্রনাথ রুদ্রের কাছে প্রেজেন্টেশন হিসেবে-সময় মতো কাজে লাগিয়ে মস্ত বীর হওয়ার জন্যে…
এসেছে সেই সময়!
দুঃস্বপ্ন তিরোহিত হয়েছিল তৎক্ষণাৎ। স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে কালিকা রানি ধরিয়ে দিয়ে গেছে কফিন কেটে বেরোনোর হদিশ।
পঞ্চকোণ রজত তারকা দিয়ে সেই মুহূর্তে প্লাস্টিক কফিনের ডালা কাটতে শুরু করেছিল সোমনাথ। ছুরির মতো ধারালো প্রতিটা ডগা। আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে দেখছিল কাটা হল কতখানি। চোখে পড়েছিল এক লাইনের ক্ষীণ আকাশ।
বিপুল উদ্যমে মরিয়া ছেলেটা পঞ্চকোণের পঞ্চ ছুরি চালিয়ে চালিয়ে কেটে কেটে গেছিল কফিনের ঢাকনা। ঝুরঝুর করে প্লাস্টিকের গুঁড়ো ছড়িয়ে গেছিল সারা গায়ে…
ঠিক সেই সময়ে দুই কিডন্যাপারের মধ্যে কথা চলছে এইভাবে :
অ্যালোপেসিয়া আতঙ্ক—ছেলেটাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।
মর্কটপ্রতিম সাগরেদ (যে চালিয়েছে সাদা ভ্যান) : কিসের চিন্তা? ছোঁড়া রয়েছে তিন ফুট ধুলোর নিচে।
বেঁচে আছে কিনা একবার দেখা দরকার। তারপর ফোনে জানিয়ে দিতে হবে পার্টিকে—হিরে চাই, নইলে পাবে লাশ।
মর্কট কিডন্যাপার রিভলভারটা ট্রাউজার্সের পকেটে ঢুকিয়ে পা বাড়িয়েছিল গ্যারেজের দিকে।
অ্যালোপেসিয়া ততঙ্ক বলেছিল পেছন থেকে—হিরে না পেলে করবি কি ছোঁড়াটাকে নিয়ে?
পদক্ষেপে বিরতি না দিয়ে বলেছিল মর্কটাকৃতি ড্রাইভার—বাক্সের ফুটো বন্ধ করে দেব।
এই যে এত ঘটনা ঘটে চলেছে সিকিমের পাহাড়ি অঞ্চলে, যেখানে ঘটছে, সেই জায়গাটা নিয়ে একটা শব্দও লেখা হয়নি এতক্ষণ। কাহিনির মূল টানে ভেসে গেছিলাম যে। তাছাড়া সাহিত্যের রস বিতরণেও আমি অপারগ! মৃগাঙ্ক লিখতে বসনে। শুধু প্রাকৃতিক বর্ণনায় কাহিনি ভরিয়ে দিত।
কিন্তু আমি নেহাতই অকবি—চেহারায় যদিও অন্যরকম। তাই ছোট্ট করে ছুঁয়ে যাচ্ছি রোমাঞ্চকর এই প্রাণ নিয়ে টানাটানির লীলাক্ষেত্র সম্পর্কে দু’চার কথা।
সিকিমে খেচিপেড়ি নামে একটা লেক আছে। এই লেক লেপচাদের কাছে বড় পবিত্র হ্রদ! উচ্চতায় এক হাজার আটশো কুড়ি মিটার। এই সরোবরের চারদিকে সারি সারি পতাকা ওড়ে সারবন্দী খুঁটির ডগায়। কৌতূহলোদ্দীপক একটা কিংবদন্তী আছে এই সরোবর সম্পর্কে। এত তো গাছ সরোবর ঘিরে। কিন্তু গাছের পাতা পড়ে না সরোবরের জলে। পড়লেই ছোঁ মেরে সেই পাতা তুলে নিয়ে যায় একটা na একটা পাখি। বিশুদ্ধ জলকে অশুদ্ধ হতে না দেওয়ার মহান দায়িত্ব যেন এখানকার বিহঙ্গকুলের। তাই সরোবর সব সময়ে টলটলে স্বচ্ছ-দর্পণপ্রতিম।
এ সরোবরের নাম ইচ্ছাপূরণের সরোবর। যারা বৌদ্ধ, যারা লেপচা, তারা বিশ্বাস করে-কল্পতরু সরোবর কারও মনের বাসনা অপূর্ণ রাখে না। দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে যা চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায়।
কুলিশ কঠোর এই কাহিনির মাঝে আচমকা ইচ্ছাপূরণের লেকের কথা নিয়ে এলাম কেন, তা জানতেই অবশ্যই আগ্রহী হয়েছেন নিবিষ্ট পাঠক এবং পাঠিকা।
কারণ আছে…কারণ আছে…ব্যাপারটা যদিও গভীর গোপন—কিন্তু দৈবাৎ আমি জেনে ফেলেছিলাম।
এই সরোবরের পাড়ে একদা হানিমুন করতে এসেছিল কল্পনা আর রবি। তখন দুজনেরই চোখে অনেক…অনেক স্বপ্নের রামধনু…যে রামধনু কিছু দূরের কাঞ্চনজংঘা। ফলস থেকে বিচ্ছুরিত সুর্যের সাতটা রঙের রামধনুকেও হার মানিয়ে দিয়েছিল। ইচ্ছাপূরণ সরোবরের পাড়ে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে দু’জনে নিবেদন করেছিল
একটাই ইচ্ছা : ছেলে হোক আমাদের।
এসেছিল সেই ছেলে–সোমনাথ।
আর সেই ছেলেই জ্যান্ত কবরস্থ হতে চলেছে এই অঞ্চলেরই গভীর গোপন। একটা সদ্য গড়ে ওঠা রিসর্টে। সোজা বাংলায় যা বদমাইসি করার আখড়া। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘেরা এমন নিরালা জায়গাতেই তো শরীরী প্রেম জমে-বিয়ে না করেই—জমে পরকীয়া লীলা যা লাম্পট্যের অপর এক নাম। এখানকার ঘরে ঘরে চলে পর্নো সিডি…তোলাও হয় পর্নো ভিসিডি…যে বস্তুটার রমরমা ব্যবসা শুধু ভারতের মেট্রো সিটিগুলোতেই আটকে নেই—চালান যাচ্ছে বিদেশে…ভারতীয় লাস্যময়ীদের নগ্ন কেচ্ছার বাজার যে সেখানে অনেক বেশি। অশালীন ছবির বাজার যুগ যুগ ধরে রমরমা থেকেছে তামাম দুনিয়ায়। কিন্তু সেই শিল্পে এখন ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে এমন ফলের রস যার মধ্যে থাকে শরীর তাতানো আর নাচানোর মাদক দ্রব্য, বেশরম হওয়ার মতো দ্রব্য, হেসে কুটিপাটি হওয়ার জন্যে ঘরময় ছড়িয়ে দেওয়া হয় লাফিং গ্যাস, জুগিয়ে যায় মনের আনন্দ আর প্রাণের আরাম, খোদ ডেভিলকে বন্দনা করে ডেয়ারিং অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের এমন জায়গা তো পাহাড়ী অঞ্চলেই নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়া যায়…।
সোমনাথ জীবন্ত কবরস্থ হতে চলেছে রমরমা এই রিসর্টের সন্নিকটে।
ঠিকানা? দুঃখিত। জানতে চাইবেন না। সবইনফরমেশন সবাইকে দেওয়া যায় না।
রিসর্টটার নাম?
তন্ত্রমন্ত্র।
উদ্দামতার আজ্ঞা তন্ত্রমন্ত্র। নিরিবিলিতে নষ্টামি করার রিসর্ট তন্ত্রমন্ত্র। ইণ্ডিয়ান পুলিশের নাগালের বাইরে—অথচ কোটিপতি ইণ্ডিয়ানদের লাম্পট্য চলে এইখানেই। ইন্ধন জুগিয়ে যায় বিবিধ নারকোটিক; যেমন, এক্সট্যাসি, জিএইচবি অথবা লিকুইড এক্সট্যাসি, মিথ্যামফিটামাইন বা স্পীড, ফেটামাইন বা কে অথবা ক্যাট ভেলিয়াম, রোহিপনল অথবা ফিজ বা ফরগেট মি বড়ি, নাইট্রাস অক্সাইড বা লাফিং গ্যাস, এলএসডি—যা অ্যাসিড। এর সঙ্গে চলে মাতাল করার মিউজিক আর স্ট্যাকাটো ড্যান্স। শরীর তখন শরীরে লেগে যায়…এক শরীরের টান আর এক শরীর রুখতে পারে না…রুখতে চায় না…