রবি রে’র তা অজানা নয়। তাই কোত্থেকে জুটিয়ে এনেছে এই র্যামবো মার্কা মস্তানটাকে।
আমি ছিলাম আমার কোয়ার্টারে। পাহাড়ের খাদের ধরে আমাদের এই বাড়িটা ইংরেজি ‘ইউ প্যাটার্নে তৈরি। দোতলা বাড়ি। অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট। আমি থাকতাম একটা প্রান্তে, সোমনাথের মা আর এক প্রান্তে। রবি এসে উঠেছিল সেই প্রান্তের অ্যাপার্টমেন্টে—সোমনাথের বাবা যে—তার মায়ের কাছেই তো যাবে। ছেলে এমনই জিনিস। সন্তান যখন বিপদে, তখন বাপ-মা কাছে চলে আসে-বন্ধু। হয় পর। আমে দুধে মিশে যায়, আঁটি যায় বাদ।
আমি তাতে আঘাত পাইনি। এসব ব্যাপারে আমার ভেতরটা পাথর হয়ে গেছে অনেক আগে। কবিতা বউদি আমাকে কলির কেষ্ট বালে খেপায় বটে, কিন্তু সমস্ত সত্তা দিয়ে জানে—অশরীরী, হায়না, চিতা আর গরিলা—এই সব কটি পদার্থ দিয়ে গড়া তার প্রাণপ্রিয় ঠাকুরপো। কিন্তু পাথরও মুচড়ে ওঠে। হে পাঠক, হে পাঠিকা—আপনারা অন্তত তা জানেন।
যাক গে, বড় বেশি নিজের কথা লিখছি। কেন লিখছি? ডায়েরিতে সব্বাই প্রাণ খুলেই মনের কথা লিখে যায়, আমার এই কাহিনিও মাঝে মধ্যে ডাইরি
স্টাইল নিচ্ছে। বিশেষ করে যখন মনে বেদনা আসে।
সেদিনও মনে কষ্ট পেয়েছিলাম। মানুষ তো আমি। বন্ধুকৃত্য করতে কলকাতার আরাম ছেড়ে এই পাহাড়ি মুলুকে এসেছি নিখোঁজ হিরের সন্ধানে। যে হিরে আছে পাথরের ডিমের মধ্যে, যে হিরে আর পাওয়া যায়নি।
যাবে কি করে? নাটের গুরু যে কল্পনা। এই কারণেই রবি আমাকে লেলিয়ে দিয়েছিল। তার একদা অর্ধাঙ্গিনীই সাত পাকে বেঁধে বিয়ে করা বরের কানে ফুসমন্ত্র দিয়ে তাকে ঘুরিয়ে দিল আমার দিকে।
আমি নাকি মনের দিক দিয়ে পাথর? কবিতা বউদি উঠতে বসতে মুখনাড়া। দেয় আমাকে এই একটা পয়েন্টে। তবে কেন সেদিন প্রিয় বন্ধুর বাস্পীভূত অনুরাগের প্রত্যাবর্তন দেখে আমি অত কষ্ট পেয়েছিলাম?
বহুদর্শিনী পাঠিকা নিশ্চয় মুচকি হাসছেন। মনে মনে বলছেন, কত রঙ্গ দেখলাম ইন্দ্রনাথ রুদ্রের, দেখছি আর এক রঙ্গ। আগুন কাছে থাকলে ঘি গলবেই। ইন্দ্রনাথ তো ছার!
যে যা ভাবে ভাবুন, আমি বলে যাই আমার কাহিনি। ছোট করে।
রবি রে’র র্যামবো ডিটেকটিভ রক্ত চোখে আমাকে বললে, কোথায় রেখেছেন ছেলেটাকে?
সুফি ওর হাল্কা মার্কা বডিটাকে আমাদের মাঝখানে এনে ফেলে বললে, শাট আপ।
আমি আপার কাট’ ঝাড়ব কিনা যখন ভাবছি, পাহাড়ের মেয়ে সেই পুলিশ পুঙ্গবী পাথুরে গলায় বললেন, ব্যস বস, আর না। কোস্তাকুতি নট অ্যালাউড। পুলিশ টেক আপ করেছে কিডন্যাপিং কেস। আপনারা হেল্প করতে চান, করুন, প্লীজ, ফাইট করবেন না। লকআপে ঢুকিয়ে দেব।
কড়া গলা পর্বত কন্যার। তার পরেই সুর নরম করে বললেন, সোমনাথের কমপিউটার রয়েছে। বাচ্চারা ই-মেল নিয়ে অনেক কাণ্ড করে। সেই খোঁজ করছে। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। সে যদি নিজেই নিজেকে কিডন্যাপ করে থাকে, তা ফাঁস হয়ে যাবে। আমার তো তাই মনে হয়। ডিভোর্সি দম্পতির ছেলেমেয়েরা ইনসিকিওরড ফিল করলে এমনটা করে। আকছার ঘটছে। এখন—সুফির অপার্থিব আকৃতির কুকুরটাকে দেখিয়ে-এর নাকের হেল্প নেওয়া যাক।
তখনই কুকুর নামানো হয়েছিল শেষ পদচিহ্ন যেখানে দেখা গেছিল—সেখানে। সে যে গন্ধটা শুকে চনমনে হয়ে উঠেছিল, সুবুদ্ধি পাঠক এবং পাঠিকা ত অনেক আগেই ধারে ফেলেছেন…
ডিজেলের গন্ধ!
এবার দেখা যাক, কফিনের মধ্যে সোমনাথ কী করছে। পাঠক এবং পাঠিকা, আপনারা তো অনিমা, লঘিমা প্রমুখ অষ্টসিদ্ধি করতলগত করে বসে আছেন। আপনাদের অজানা, আপনাদের অগম্য কিছুই নেই এই ত্রিভুবনে। সুতরাং…
সোমনাথের মাথার ওপর দেখা গেছিল একটা আলোক বিন্দু। বহু দূরের নক্ষত্রের মতো ঝিকিমিকি আলোক কণা, সকালের দিকে। নিশ্চয় বাতাসের ফটো কেটে রাখা হয়েছে কফিনেব ডালায়। সেই ফুটোয় চোখ লাগিয়ে সে দেখেছিল, টিউবের মধ্যে দিয়ে বহুদূরের এক কণা নীল চাকতি।
ফুটোয় মুখ ঠেকিয়ে, মুখের দু’পাশে দু’হাতের চেটো জড়ো করে চেঁচিয়েছিল তারস্বরে—বাঁচান! বাঁচান! আমি এখানে—মাটির তলায়! হেল্প! হেল্প মি: আই অ্যাম ডাউন হিয়ার!
কেউ জবাব দেয়নি।
হেল্প!
সারারাতে অনেক মেহনৎ করেছে সোমনাথ। ফিতের বাঁধন থেকে মুক্ত করেছে দু’হাত আর দু’পা। লাথিয়ে ভাঙবার চেষ্টা করেছে কফিনের প্লাস্টিক দেওয়াল। কিডন্যাপাররা নিশ্চয় চম্পট দিয়েছে এতক্ষণে। কেউ জানে না একটা জ্যান্ত ছেলেকে অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা করে শুইয়ে রাখা হয়েছে মাটির নিচে। পেটের জ্বালায়, তেষ্টার কষ্টে পটকে যাবে যথাসময়ে—কেউ জানতেও পারবে না। অনেক লাথিয়ে, অনেক চেঁচিয়ে শেষকালে বেদম হয়ে ঘুমিয়ে নিয়েছিল। এক চোট। তার পরেই ফের শুরু হয়েছিল হাত-পা ছোঁড়া আর মা-মা চিৎকার।
আর তারপরেই কে যেন কাঁৎ করে একটা লাথি কষিয়েছিল তার পেটে। পরক্ষণেই যেন দশ হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিক শক গোটা শরীরটাকে স্থান করে দিয়েছিল এক চাবুকেই। বৈদ্যুতিক চাবুক।
চোপ। চেঁচাবি না?
বাক্সের কিনারায় উঁকি দিচ্ছে গেমস ফিকের সেই মারকুটে কালিকা রানি। চাহনিতে জিঘাংসা!
চিল চিৎকার করে সোমনাথ বলেছিল, তুই তো সত্যি নস! মিথ্যে!
তাই নাকি? তাহলে খ আর একটা লাথি। লাগবে না। আমি তো মিথ্যে!
ককিয়ে উঠেছিল সোমনাথ।
আর তখনই চোখে পড়েছিল কালিকা রানির আঙুলের লম্বা লম্বা নখের ঝিলিক। ছুঁচোলো নখ, ছুরির ফলার মতো, ঝকঝকে। এই নখ চালিয়ে শত্রুকে ফালাফালা করে দেওয়ার অদ্ভুত কমব্যাট কৌশল গেমস ফিক খেলনায় দেখিয়েছে কালিকা রানি।