তাই ছুঁয়ে গেলাম অ্যালোপেসিয়া আতঙ্ক-মানবকে। যাকে দেখে শিউরে উঠেছিল কল্পনা আর রবি রে’র ছেলে সোমনাথ।
নাইজেল রহস্য আর একটু বিশদ করতে হবে? কলমবাজ লেখকরা টেলিপ্যাথিও জানে বইকি। পাঠক-পাঠিকার মনে অন্দর-কন্দরের অভীপ্সা তাদের অজানা থাকে না। জানা না থাকলে লেখাই যায় না।
তাই, ঔৎসুক্য নিবৃত্তির চেষ্টা করা যাক ছোট্ট একটা সংবাদ দিয়ে।
দুর্ধর্ষ ডানপিটে রবি রে’র জীবন কাহিনী সংক্ষেপে শুনিয়ে গেছি আগে। পাঠক এবং পাঠিকা জেনে গেছেন, রবি তার দুর্নিবার কৌতূহল নিয়ে হিরে খনি, হিরে মাজাঘষার কারখানা, হীরে বিক্রির মার্কেট দেখে এসেছে ভূমণ্ডলের বহু জায়গায়। সাউথ আফ্রিকার প্রাকৃতিক হিরক ভাণ্ডারের প্রসঙ্গও তখন এসে গেছি। সেখানকার পাহারাদাররা কতখানি ঈগল চক্ষু হয়, সে কথাও বলা হয়ে গেছে।
নাইজেল, নিঠুর নির্লোম নাইজেল, এই রকমেরই এক হীরক খনিব শাস্ত্রীরূপে মোতায়েন ছিল একদা।
বাকিটা অনুমেয়। তীক্ষ্ণধী পাঠক এবং সহজবুদ্ধির পাঠিকা নিশ্চয় তা ধরে ফেলেছেন।
হ্যাঁ। নাইজেল চেনে রবিকে। রবি চেনে নাইজেলকে।
সুফি’র কথা একটু আগে বলেছি। আমি যার নাম দিয়েছি অ্যালোপেসিয়া হা। নির্লোম দৈত্য। প্রেমচাঁদের বিশ্বব্যাপী অপরাধী অন্বেষণের গুপ্ত কর্মকাণ্ডে সৃষ্টি তার দক্ষিণ হস্ত! কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার পদ্ধতিতে বিশ্বাসী বলেই প্রেমচাঁদ আজ বিশ্বজোড়া গোয়েন্দা সংস্থা। ভাবতেও ভাল লাগে। একসঙ্গে পড়েছি তো স্কটিশ চার্চে।
সুফি যেন হাওয়ায় উড়ে এল আমার পাহাড়ি বাড়িতে। কি করে এল, কোখেকে এল, সে সব প্রসঙ্গ অবান্তর। সুফি এসে গেল। অ্যালোপেসিয়া হাল্ককে দেখে পুলিশ পুঙ্গবীর চক্ষু বিস্ফারিত হয়েছিল।
কিন্তু থমকে গেছিল রবি রে।
হ্যাঁ। রবি রে-ও পবন বেগে চলে এসেছিল পাহাড়ের বাড়িতে। ছেলে নিখোঁজ হলে। কোনও বাবাই স্থির থাকতে পারে না।
সে এসেছিল আমার ওপর রাশি রাশি সন্দেহ নিয়ে। মানুষের মন বড় বিচিত্র। আমি তার প্রিয়তম বন্ধু। তাই তার একদা প্রিয়তমা স্ত্রীর পিছনে চর হিসেবে মোতায়েন করেছিল আমাকে। সে জানত, আমার ওপর কল্পনার দুর্বলতা আছে। আরও জানত, আমি কলিযুগের ভীষ্ম। ছলাকলা দিয়ে কীভাবে ললনা—ছলনা-ব্যহ ভেদ করি, তা তার অজানা নয়। বিশেষ করে মোমের হাত’ কেসটার পর থেকে। তাই নির্ভয়ে আমাকে মোতায়েন করেছিল দুর্লভ হিরেগুলোকে যেন উদ্ধার করে আনি কল্পনার গর্ভ থেকে।
‘গর্ভ’ শব্দটায় যদি কুঞ্চন জাগে পাঠিকার, আমি নিরুপায়। কিন্তু যৎকিঞ্চিৎ চিন্তা করলেই বুঝবেন, ওরকম নিরাপদ আর একান্ত গোপনীয় স্থান ভূমণ্ডলে আর কোথাও নেই। তাই গর্ভ শব্দটাকে উপমা হিসেবে টেনে আনলাম আমার এই দুর্বল লেখনী দিয়ে।
মোদ্দা কথা, আমি ছিলাম রবি রে’র চর। অতীব বিশ্বাসযোগ্য স্পাই। অথচ দেখুন, নারী তাদের অসীম ক্ষমতা প্রয়োগ করে কত অসম্ভব কাণ্ডই না করে। ফেলে।
টেলিফোনে রবিকে আরও কি বলেছিল কল্পনা, আমরা তা জানার কথা নয়। কিন্তু সে আমার সামনে এল এক্কেবারে ভিন্ন রূপে, সেই অভিন্ন বন্ধুত্বের বাষ্পটুকুও চোখের তারায় অথবা বাক্যবর্ষণে না দেখিয়ে। সে এল মন থই থই সন্দেহ নিয়ে। সঙ্গে একজন ডিটেকটিভকে নিয়ে। মারদাঙ্গা টিকটিকি।
বক্তব্য অতীব পরিষ্কার। সোমনাথকে আমিই কিডন্যাপ করিয়েছি। পথের কাঁটা ভেবে। কল্পনাকে নইলে পাব কী করে? সেইসঙ্গে তার হিরে? পুলিশ-পুঙ্গবীর নয়ন-তারকায় দেখলাম সেই একই সান্দেহের ছায়াপাত!
দশরূপা নারী। তাই তো তোমাদের দশ দিক থেকে প্রণাম করে শ্রীহীন এই ইন্দ্রনাথ রুদ্র-কিন্তু কাছে ঘেঁষে না।
কি বিপাকেই না পড়েছিলাম সেদিন। ত্রাতারূপে এল সুফি। ভুবনজোড়া পাতা জাল থেকে নিমেযে গোপন খবর চলে আসত প্রেমচাঁদের স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত কন্ট্রোল কেবিনে।
দুর্ধর্ষ নাইজেল যে হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেছে, সে খবর তার কাছে চলে গেছিল। তাই ক্ষুর বুদ্ধি খাটিয়ে চকিত সিদ্ধান্ত নিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল সুফিকেআর এক নির্লোম মানবকে।
চিত্ত যার গ্র্যানাইট দিয়ে গড়া—শরীরটা সিনেটার হাল্ক-এর মতো।
ও হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। কাহিনি পরম্পরা রক্ষা করা বড় কঠিন ব্যাপার। আমি লেখক নই। আমাকে মাপ করবেন।
সুফি একা আসেনি। সঙ্গে এনেছিল একটা সারমেয়কে। বিশেষ জাতের কুকুর। আফ্রিকায় তার পূর্বপুরুষরা নেকড়ে-টেকড়ের বংশধর ছিল। গন্ধ শুকতে ওস্তাদ। হাওয়ায় গন্ধ থাকলেও তার গন্ধ-যন্ত্র টের পায়। এমনকি, প্রাকৃতিক বিপর্যয় যখন আসন্ন, তার ষষ্ঠ অথবা সপ্তম অথবা নবম ইন্দ্রিয় তা টের পায়। ইন্দোনেশিয়ায় যখন ভীম ভৈরবে সুনামি আছড়ে পড়েছে, তার অনেক আগেই নিকোবর থেকে প্ৰেমৰ্চাদের এক টিকটিকিকে নিয়ে সে চম্পট দিয়েছিল নিরাপদ অঞ্চলে।
টিকটিকি মানে যে ডিটেকটিভ, তা নিশ্চয় ক্ষুর বুদ্ধি পাঠক-পাঠিকাদের নতুন করে বলার দরকার নেই।
আশ্চর্য এই সারমেয় সহ সুফি নেমে গেল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঠিক সেইখানে, যেখান থেকে আর পায়ের ছাপ পাওয়া যায়নি সোমনাথের।
বাতাসের মধ্যে নিশ্চয় একটা গন্ধ ধরে ফেলেছিল সারমেয়। গজায়নি, তর্জায়নি। নিঃশব্দে দৌড়েছিল পাথুরে পথ বেয়ে।
বুঝেছেন কিসের গন্ধ?
ডিজেলের।
২৯. সোমনাথ যখন কফিনে
রবি রে যে ডিটেকটিভ নামক বস্তুটিকে সঙ্গে এনেছিল আমাকে কাত করার জন্যে, তাকে দেখতে অনেকটা সিনেমার ব্যামবোর মতো। গুলি গুলি চোখে বরফ শীতলতা, হাত-পা গর্দানের পেশিগুলো ইস্পাতের তার বললেই চলে। রবি আমাকে চেনে। আমি নবনীত কোমল কবি-কবি দর্শনধারী হতে পারি, কিন্তু প্রয়োজনে শরীরী বিভীয়িকা হয়ে যেতে পারি। যুদ্ধের দামামা যখন বাজে মাথার মধ্যে, তখন বিদ্যুৎ খেলে যায় প্রতিটি পেশির প্রতিটি তন্তুতে। ইন্দ্রনাথ সখন নৃশংস হয় এই কাহিনী যাঁরা পাঠ করেছেন, তারা অন্তত জানেন, আমি কি দিয়ে তৈরি।