‘আগের বাবা’ কথাটা আমার কানের মধ্যে খচ খচ করে লাগে। আগের বাবা’ আবার কী? বাবা তো একজনই হয়। বাবার জন্যেই তো আমি জন্মেছি। আমি কি বাচ্ছা ছেলে? কিছু বুঝি না? বাবা কখনও পাল্টায়? মা ওই সব ধানাইপানাই বলে আমার মনটাকে কাকুর দিকে ঘুরিয়ে দিতে চায়। আমি যেন কাকুকে বাবার মতো দেখতে শিখি। ভালবাসি। আপন করে নিই। তাহলে মায়ের সুবিধে হবে। কী সুবিধে হবে, তা কি আমি জানি না? আমি অত বোকা নই। মা তো বাবাকে ডিভোের্স করেছে। নাকি, বাবা ডিভোের্স করেছে মাকে পরিষ্কার জানি না। তবে, খুব চেঁচামেচি হয়ে গেছিল দু’জনের মধ্যে। হিরে নিয়ে নিশ্চয়। হিরে… হিরে শব্দটা আড়াল থেকে কানে এসেছিল। মা নাকি বাবার হিরে নিয়েছে। কী আশ্চর্য! বাবা তো মাকে অনেক গয়না দিয়েছে। হিরেও নিশ্চয় দিয়েছে। তাতে এত মাথা গরম করবার কী আছে? দোযটা বাবার।
কিন্তু মা যখন গয়নার বাক্স খুলে নাড়াচাড়া করে, হিরে তো আমি দেখিনি। একদিন জিজ্ঞেস কবেছিলাম—মা, হিরেগুলো কোথায়? মা আমাকে ঠাস করে চড় মেরে ছিল। তারপরেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল। কী কান্না! কী কান্না!
সেই থেকে হিরে নিয়ে আর কোনও কথা আমি বলি না। আমার যখন ছ’বছর। বয়স, তখন এইসব ব্যাপার ঘটেছিল। তারপর মা চলে এল এই পাহাড়ে। বাবাকে আর দেখিনি। কষ্ট হয়। কিন্তু মুখে বলি না।
এমন সময়ে এলেন ইন্দ্রনাথকাকু। মস্ত গোয়েন্দা। হিরে খুজতে নাকি? আমার সন্দেহ হয়। নাকি, আমার মাকে বিয়ে করতে? মায়ের রকমসকম দেখে বুঝতে পারি, মা চায় তাই। ইন্দ্রনাথকাকুকে বিয়ে করতে।
আচ্ছা, হিরেগুলো ইন্দ্রনাথকাকুর কাছে নেই তো? গোয়েন্দা তো। হয়তো হারিয়ে যাওয়া হিরে উদ্ধার করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। সেই লোভ দেখিয়ে মাকে বিয়ে করতে চাইছেন। গোয়েন্দারা সব পারে।
কিন্তু আমি তো তক্কে তক্কে থাকি। ইন্দ্রনাথ কাকু আমাদের বাড়িতে থাকেন না কেন? হিরে যাতে মায়ের হাতে না পড়ে, নিশ্চয় সেইজন্যে। এই দশ বছর বয়েসে আমি কচি খোকা নই। নজরে নজরে রাখি ওঁকে আর মাকে। একবারও মায়ের গা ছেন না ইন্দ্রনাথকাকু। সব সময়ে তফাতে থাকেন। রাত হলে অন্য বাড়িতে। এ বাড়িতে শুধু আমি আর মা। অনেক আগে আমরা তো তিনজনে এক সঙ্গেই থাকতাম। আমি, বাবা আর মা।
গোয়েন্দার ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে চেয়েছিলাম একদিন। ইন্দ্রনাথকাকুর জিনিসপত্র হাঁটকে দেখছিলাম যদি হিরে-টিরে পাওয়া যায়। কিন্তু ধরা পড়ে গেছিলাম। বকেননি। উল্টে আমাকে একটা সিলভার স্টার প্রেজেন্ট করেছিলেন। পঞ্চকোণ রজত নক্ষত্র। বেশ ভারি। বলেছিলেন, বীরত্ব দেখিয়ে পুরস্কার পেয়েছিলাম। তোকে দিলাম। বীরপুরুষ হবি—এই স্টারের জোরে।
পকেটে রাখি সেই স্টার। কোণগুলো বড় ধারালো। গায়ে ফুটে যায়। কিন্তু নিজেকে মস্ত গোয়েন্দা মনে হয়। মহাবীর। শক্তিমান। টিভির শক্তিমানের মতো যা খুশি করতে পারি।
গেমস ফ্রিক চালিয়ে রেখে এইসব যখন ভাবছি, আচমকা কে যেন আমার মুখ চেপে ধরল পিছন থেকে। চোখেও হাত চাপা দিল। ঝটকান মেরে তুলে নিল শূন্যে। সাঁ সাঁ করে এত তাড়াতাড়ি বয়ে নিয়ে গেল আমাকে যেন আমি একটা সোলার পুতুল। এমনভাবে খামচে ধরেছিল, একটুও নড়তে পারিনি, চেঁচাতে পারিনি। আমি টিভির শক্তিমান, কিন্তু আমাকে যেন পোকা বানিয়ে ফেলেছিল। প্রথমটা হকচকিয়ে গেছিলাম। তারপর স্পষ্ট মনে হল, নিশ্চয় ইন্দ্রনাথকাকু কিছু একটা মতলব এঁটেছেন আমাকে নিয়ে।
শুন্যপথে আমাকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে, একটুও আওয়াজ করতে না দিয়ে, ঢাল বেয়ে নামিয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল একটা গাড়ির মধ্যে। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেছিল দরজা। আওয়াজ শুনে বুঝেছিলাম, বেশ ভারি দরজা। গাড়িটাও নিশ্চয় তাই। আঠালো ফিতে দেওয়া হয়েছিল আমার মুখের ওপর। তারপর একটা থলি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল মাথা গলিয়ে—যাতে কিছু দেখতে না পাই। ফিতে সেঁটে দেওয়া হয়েছিল হাত আর পায়েও। কিন্তু লড়ে গেছিলাম। ফিতে যাতে লাগাতে না পারে, তাই হাত-পা ছুঁড়েছিলাম। কিন্তু চোখে না দেখলেও বুঝেছিলাম, একজন নয়, অনেকজন আমাকে কাবু করে রেখেছে। আরও বুঝেছিলাম, রযেছি একটা ভ্যান গাড়ির মধ্যে। ডিজেল তেলের গন্ধ পাচ্ছিলাম।
তারপরেই গাড়ি চলতে শুরু করেছিল। ড্রাইভিং আরম্ভ হয়ে গেছিল। যে লোকটা আমাকে খামচে-খুমচে ধরে রেখেছিল, সে বললে, কেউ দেখে ফ্যালেনি তো?
ড্রাইভার যেখানে বসে, জবাবটা এসেছিল সেইদিক থেকে-না।
এই লোকটাই তাহলে আমাকে কাঁক করে ধরে তুলে এনেছে।
যে লোকটা আমাকে পিষে মারছিল, সে বললে, ও ছেলে, নিশ্বাস নিতে পারছ তো? ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বল।
আমি তখন ভয়ে কাঠ। কিছু করিনি।
ড্রাইভ যে করছিল, সে বললে, বুকে হাত দিয়ে দেখলেই তো হয়—হার্ট চালু থাকলেই বেঁচে আছে। এক পাটি জুতো ফেলে এলে পারতাম।
যে আমাকে ধরে রেখেছিল, সে বললে, খেলনাটা তো ফেলে এসেছ, ওতেই হবে। জুতোর চেয়ে বড় প্রমাণ।
গাড়ি নেমে গেল নিচের দিকে। আবার উঠল ওপর দিকে। মিনিট কয়েক পরে দাঁড়িয়ে গেল। কান দিয়ে শুনলাম আর একটা লোক উঠে এল গাড়ির মধ্যে।
তিনজনেই কথা বলছে হিন্দিতে। কিন্তু হিন্দি যাদের মাতৃভাষা, তাদের মতো নয়। স্কুলে আমি হিন্দি শিখেছি। তফাত বুঝতে পারি। এক-একজনের হিন্দি বুকনি এক-এক রকম। নানান অঞ্চলের লোক নিশ্চয়।