লজ্জায় লাল হয়ে আমোদিনী কন্যাটি তখন পালাবার পথ পেত না, আর এক দুঃসাহসিনী মিঠে মিঠে হেসে বলে যেত—বুঝেছি, ওটা পদাঘাতের সংকেতে নয়, একেই বলে ম্যাকো পোজ ফর দ্য রাইট ম্যান। বাট, মাই ডিয়ার ইয়ং লেডি, আই অ্যাম দ্য রং ম্যান।
বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এক্সপার্ট প্রেমচাঁদ এরকম কত কাণ্ডই করেছে কলেজ লাইফে। ওর চোখে কোনও সংকেত এড়িয়ে যায়নি। কোন কন্যার চোখে দ্যুতি ফুটিয়েছে অথবা পা ঠুকে চলেছে। অথবা ডান পাকে বিশেষ কোণে প্রেমাদের দিকে ফিরিয়ে রেখেছে অথবা বুকের ওপর দু’হাত বিশেষ কায়দায় ভাঁজ করে নিরুপম বক্ষপিণ্ডকে উঁচিয়ে রেখে, এসব ভ্যালেনটাইন বডি ল্যাঙ্গুয়েজ সংকেত মাঠে মারা যেত কাঠখোট্টা প্ৰেমৰ্চাদের কাছে।
প্রেমচাঁদ প্রসঙ্গ নিয়ে আচমকা এত কথা লিখলাম কেন? কল্পনার কাণ্ড দেখে সব যে মনে পড়ে গেল। হরেক বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমার ওপর প্রয়োগ করে গেছে কল্পনা। কিন্তু এই ঘি তাতে গলেনি। প্রেমাদের কথা আরও বেশি করে মাথায় খেলে যাচ্ছিল সোমনাথ হাওয়া হয়ে যাওয়ার পর থেকেই।
আমি ডিটেকটিভ হব, কস্মিনকালেও ভাবিনি। আমার সেই যোগ্যতাই নাকি নেই। মুখ ফেঁড় প্রেমচাঁদ তো সোজাসুজি আমাকে বলত, ভেড়ুয়া বাঙালি। আমিও তেড়ে উঠে বলতাম, তেড়িয়া শিখ, শুধু কৃপাণ চালিয়েই যাবি সারাজীবন।
কিন্তু ভাগ্যচক্রে আমি যখন শখের গোয়েন্দা হলাম, রিস্ক কম বলে, স্রেফ হবি তো—প্রেমচাঁদ তখন সিরিয়াস হয়ে গোয়েন্দাগিরিকে পেশা করে নিয়ে একটু একটু করে জাল ছড়িয়ে দিয়ে ঘাঁটি পেতে বসল গোটা পৃথিবী গ্রহটায়। শিখ জাতটা একটা জাত বটে। আজকে ওর গোয়েন্দা সংস্থা টেক্কা দেয় আমেরিকার এফবিআই-কে, ওর কীর্তিকলাপের খবর রাখে ইণ্ডিয়ার ‘র’ অর্থাৎ রিসার্চ অ্যাণ্ড অ্যানালিটিক্যাল উইং। এই সাইবার আর হাইটেক ক্রাইমের যুগে পেছিয়ে নেই শিখ নন্দনের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান।
সেই নির্ভীক শিখ বন্ধুর শরণ নেওয়া মনস্থ করলাম চিৎ হয়ে শুয়ে কড়িকাঠ নিরীক্ষণ করতে করতে।
ঝিমুনি এসেছিল কিছুক্ষণের জন্যে। সমস্ত সত্তা যখন সজাগ থাকে, তখন মগজে তন্দ্রা প্রলেপ লাগিয়ে যায়, মগজ কিন্তু ঘুমোয় না। মানুষের মগজ জন্ম মুহূর্ত থেকে ঘুমোয় না। মগজ অতন্দ্র। মগজ আজও অজানা রহস্য।
তাই ভোর রাতে উঠে পড়েছিলাম আমার বডি অ্যালার্মের সংকেতে। এবার বেরোতে হবে। নিখোঁজ সোমনাথকে খুঁজতে যেতে হবে।
ঠিক সেই সময়ে বেজে উঠেছিল আমার স্যাটেলাইট টেলিফোন। পুলিশ পুঙ্গবীব কাঠ-কাঠ ধারালো কথাগুলো কানের পর্দায় বিঁধে বিঁধে গেছিল—মিস্টার ইন্দ্রনাথ রুদ্র?
স্পিকিং।
কিডন্যাপারের টেলিফোন কল ব্যাক আপ করা হয়েছে। চোরাই মোবাইল থেকে ফোন করা হয়েছিল।
আমিও তাই আন্দাজ করেছিলাম। সব কিডন্যাপার তাই করছে।
ইয়েস, ম্যাডাম।
পাহাড়ের ঢালে তখন বোদ এসে পড়েছে।
পুলিশ পুঙ্গবী বললেন, গেমস ফ্রিক কোথায় পড়েছিল, মিঃ রুদ্র? ঢাল বেয়ে নেমে গেলাম একটু একটু করে। মাটি এখানে আলগা। কাল বিকেলেই এক দফা হেঁটেছি, মাটি তোলপাড় করেছি পায়ের জুতো দিয়ে। হেঁটে গেলাম পাশ কাটিয়ে। সরু পথটা বাঁচিয়ে হাঁটছি। সোমনাথ ওই পথ দিয়েই নেমেছে। ওর পায়ের ছাপ যেন নষ্ট না হয়ে যায়। ওর ফুট প্রিন্ট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—গতকাল যে রকম দেখেছিলাম, সেইভাবেই রয়েছে।
পৌঁছে গেলাম গাছপালার জায়গায়। এখান থেকেই জমি পাথুরে হতে হতে চলেছে। মাটির ভাগ কম। তাতে ঘাবড়ালাম না। পায়ের ছাপ পড়ুক, গতকাল তো দেখে গেছি, কোথায় পড়েছিল গেমস ফ্রিক খেলনা। ঢাল বেয়ে শর্টকাট করলাম। পুলিশ পুঙ্গবী দুবার হড়কে গেলেন।
পৌঁছে গেলাম ঘেসো জমিটায়, যেখানে গতকাল পড়ে থাকতে দেখেছি গেমস ফ্রিক টয়। সোমনাথের পদচিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এদিকে-সেদিকে।
হেঁট হলেন পুলিশ পুঙ্গবী। নরুন চোখে দেখে গেলেন প্রতিটি ফুট প্রিন্ট। মুখ তুললেন, এই ছাপগুলো আপনার জুতোর?
হ্যাঁ। এখন যা পায়ে রয়েছে।
পা তুলে, জুতোর তলদেশ ধরলাম ভদ্রমহিলার চোখের সামনে। কোনও মহিলাকে এভাবে জুতো দেখানো অতিশয় অভদ্রতা। কিন্তু পুলিশি তদন্তে এ সব। তুচ্ছ ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে নেই। পুলিশ পুঙ্গবীও দিলেন না। চারু নয়নে সুচারুভাবে আমার পাদুকার তলদেশ নিরীক্ষণ করলেন। যেন, আয়নায় মুখ দেখাছেন। যৎকিঞ্চিৎ পরিহাসের প্রয়াস সামলে নিলাম। কারণ, এই মুহূর্তে তিনি কাঠার নয়না। এবং স্থিতধী। সূচিপৃক্ষ চাহনি নিবদ্ধ সোমনাথের বিশেষ প্যাটার্নের শু-প্রিন্টের ওপর। কয়েক জায়গায় ঘাড়ে ঘাড়ে পড়েছে জুতোর ছাপ। খেলনা। নিয়ে মেতে ছিল নিশ্চয় ঘেসো জমিতে। তারপর নেমে গেছে ঢাল বেয়ে। আমি। ফলো করলাম সেই ফুট প্রিন্ট-সাধারণ চোখে যা অদৃশ্য।
অদৃশ্য পুলিশ পুঙ্গবীর চোখেও। তাই বললেন, চললেন কোথায়?
পায়ের ছাপের পিছনে।
আপনি কি ব্লাডহাউণ্ড?
গত জন্মে ছিলাম।
ঘাসের মধ্যে বিলীয়মান সোমনাথ-পদচিহ্ন ফুট আষ্টেক এসেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। এইখান থেকে যেন ডানা মেলে উড়ে গেছে ছেলেটা।
তীক্ষ্ণ নয়া পুলিশ পুঙ্গবী তা লক্ষ্য করলেন। বললেন, কেউ যদি তুলেই নিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তো তার পায়ের ছাপ থাকবে। অথবা ধস্তাধস্তির চিহ্ন। কিছুই তো দেখছি না। কারণ তারে আচমকা তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
তাই যদি হয়, পুলিশ পুঙ্গবীর ভুরুযুগল গাণ্ডীব ধনুর মতো বক্র—তাহলে যে তুলে নিয়ে গেছে, তার পায়ের ছাপ তো থাকবে।