অবশেষে লক্ষ্য করলাম, পুলিশ পুঙ্গবীর পিঙ্গল চক্ষু তারকায় নৃত্যের আভাস।
কৌতুক নৃত্য!
বললেন, মিস্টার ইন্দ্রনাথ রুদ্র, আপনার সঙ্গে লড়বার ক্যাপাসিটি আমার নেই। কথার মারপ্যাচ বানাতে চাইছি না। সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখছিলাম। অপরাধ যদি হয় মার্জনা করবেন।
অপরাধী তো আমি, বলে গেলাম, সুতরাং, এখন খবর দেওয়া হোক ছেলের বাবা রবি রে-কে। তাহলেই, পুলিশ পুঙ্গবীর চোখে চোখ রেখে বললাম, আর একটা বিষয় নিয়ে ভাবা যাবে।
আর একটা বিষয়। আস্তে আস্তে বললেন পুলিশ পুঙ্গবী, থিওরি নাম্বার থ্রী?
ইয়েস, ম্যঘাম। থিওরি নাম্বার ওয়ান, আমি কিডন্যাপার; থিওরি নাম্বার টু, রবি রে কিডন্যাপার; থিওরি নাম্বার থ্রী, ছেলেটা নিজেই নিজেকে কিডন্যাপ করেছে।
বুদ্ধিমতী পুলিশ পুঙ্গবী চকমকি চোখে বললেন, এমন ঘটনা আজকাল আকছার ঘটছে। ফিলিং অফ ইনসিকিউরিটি থেকে ছোটরা সে-কিডন্যাপিং কেস সাজাচ্ছে। ইয়েস, ইয়েস, এটা একটা সলিড সম্ভাবনা।
চার নম্বর থিওরিটা নিয়েও ভাবতে পারেন, আমার চোখ এবার পর্যায়ক্রমে ঘুরছে ঘরের দুই হিমালয় নন্দিনীর মুখের ওপর। একটুও যতি না দিয়ে কথা টেনে নিয়ে শেষ করে দিলাম চতুর্থ সম্ভাবনাটা, মা নিজেই ছেলেকে ভ্যানিশ করেছে লোক লাগিয়ে বাপকে ব্ল্যাকমেইল করবে বলে।
শ্বেতবদনা কল্পনা এখনই প্রকৃতই পাথরপ্রতিম। ধাক্কাটা একটু জোরালো হয়ে গেছে বুঝলাম। কিন্তু আমি নিরুপায়। তাই কথার জের টেনে নিয়ে বললাম পুলিশ পুঙ্গবীকে—এটা একটা ডিসেপশম ট্যাকটিক্স। আসল ব্যাপারটাকে গোপনে রাখার জন্যে অন্য ঘটনার বাতাবরণ সৃষ্টি করা। ম্যাডাম, দিস ইজ মাই অ্যানালিসিস। ভেবে দেখুন, খবর দিন, ছেলের বাবাকে।
ছেলের বাবা এসেছিল যথাসময়ে। এসেই যে সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দিয়েছিল এক কথায়, তা পরের কথা হলেও এখন একটু ছুঁয়ে রাখি।
বলেছিল, হা হা, এটা ডিসেপশন ট্যাকটিক্সই বটে। পথের কাঁটা সরিয়েছে ইন্দ্রনাথ রুদ্র। প্রমাণ? বন্ধুর ডিভোর্সি বউয়ের কাছে এসে রয়েছে কেন? ক্যারেক্টারলেস!
ইন্দ্রনাথ রুদ্রই তাহলে কিডন্যাপার!
২৬. কিডন্যাপারের পদসংকেত
আমি চলে এলাম আমার ডেরায়। কল্পনা চিটনিসের পাশের বাড়িতে। এক বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নিশ্চয় পূর্বাভাসের পথনির্দেশে। এখন বুঝলাম, সেই সিদ্ধান্ত কতটা নিরাপদে রেখেছে আমাকে। নইলে ফেঁসে যেতাম আগেই। আগুন আর ঘি পাশাপাশি রাখলে আগুন ঘি-কে গলাবেই। কল্পনার মতো শরীরী আগুন রেহাই দিত না আমাকে। ওর মতলব ছিল সেইটাই। কিন্তু আমার মতলব ছিল আরও গভীরে। সেই মতলব নিশ্চয় এতক্ষণে বিজ্ঞ পাঠক এবং সুচতুরা পাঠিকার অগোচরে থাকেনি।
ভিন্ন আবাসে থাকলেও বুদ্ধিমতী পুলিশ পুঙ্গবী কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। জানলা থেকেই লক্ষ্য করেছিলাম, প্লেন ড্রেসে পুলিশ চর মোতায়েন করা হয়েছে বাড়ির সামনে। যাতে আমি চম্পট দিতে না পারি—রাতের আঁধারে।
শয্যাগ্রহণ করে, দু’হাতের দশ আঙুল পরস্পর সংলগ্ন করে মাথার তলায় দিয়ে, চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম রবি রে-তনয়ের কথা। ছেলেটা পয়লা নম্বরের বিচ্ছু নিঃসন্দেহে। বাপের উদ্দামতা আর মায়ের সর্পিল চিন্তাধারার রেশ নিশ্চয়। জিন-দৌলতে এসেছে তার মধ্যেও। আমার খুব ন্যাওটা হয়ে গেছিল ঠিকই। যখন তখন আমার ডেরায় এসে দুরন্তপনা করত। এটা-সেটা দেখতে চাইত। আমার ডেঞ্জারাস কীর্তিকলাপের কাহিনি শুনতে চাইত। কিন্তু, কী আশ্চর্য, বাপের প্রসঙ্গ ভুলেও তুলত না। শিশু মনোবিদরা এই সহজ সতর্কতার কি ব্যাখ্যা করবেন, তা জানি না। আমি কিন্তু আমার সহজ যুক্তি দিয়ে বুঝেছিলাম, পিতৃ প্রসঙ্গ সযত্নে। এড়িয়ে যাওয়ার পিছনে রয়েছে সযত্ন পিতৃ-স্মৃতি। স্মৃতির সেই মণিকোঠা কারুর কাছে উন্মােচন করতে চায় না। ওটা ওর ঠাকুর ঘর। কাউকে সেখানে ঢুকতে দিতে চায় না। সেখানকার কোনও কথা বাইরে আনতে চায় না। অথচ সব স্মৃতিই রয়েছে চেতন মনে অবচেতনে যায়নি। দশ বছর বয়স যে ছেলের, সে যদি মনের জোরে মনের মধ্যে একটা প্রকোষ্ঠ সম্পূর্ণ নিজস্ব করে রাখে, তাহলে তা ভাবনার ব্যাপার বইকি। মনের রোগ এই থেকেই দেখা যায়। ফিলিংস অব ইনসিকিউরিটি। নিরাপত্তাহীনতা বোধ। সেল্ফকিডন্যাপিং কেস ইদানিং, আকছার ঘটতে দেখা যাচ্ছে এই কারণেই। এই ডিভোর্স-কণ্টকিত সমাজে।
সোমনাথ হয়তো সেই পথের পথিক।
আমার অতীত কার্যকলাপ জানবার আগ্রহ ওর মধ্যে দেখেছিলাম একটু বেশি মাত্রায়। একদিন আমার ট্রফির বাক্স খুলে ঘাঁটতে বসেছিল, আমাকে না জানিয়ে। কতজনের কত উপকার করেছি, কত জনে কত পুরস্কার প্রদান করেছে, সে সব। ঠেসে রেখে দিতাম একটা চেন-টানা ব্যাগে। সেই ব্যাগে ছিল একটা পঞ্চকোণ রূপোর তারকা। বেশ ভারি। প্রতিটি কোণ ছুঁচের মতো সরু। ওপরে লেখা আমার নাম।
হাতের চেটোর মতো বড় মেডেলটা নিয়ে ও যখন উল্টেপাল্টে দেখছে, আমি দেখে ফেলেছিলাম আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখা ব্যাগ নিয়ে ওর কৌতূহল। আমার মোটেই ভাল লাগেনি। ব্যাগটা হাত থেকে নিয়ে, চেন টেনে দিয়ে, মাচায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম।
রূপোর তারকাটা সসামনাথকে প্রেজেন্ট করেছিলাম। বলেছিলাম, হিরো হওয়ার এই প্রাইজ দিলাম তোকে। হিরো হবি জীবনে, এই আমার আশীর্বাদ।
গোয়েন্দাগিরি বড় বেপরোয়া পেশা। এ পেশা গ্রহণ করব, এমন সাধ বা শখ। কলেজ জীবনে আমার ছিল না। ছিল আমার আর মৃগাঙ্ক রায়ের প্রাণের বন্ধু। প্রেমচাঁদ মালহোত্রার। পাঞ্জাব তনয়, ধর্মে শিখ। একে নম্বরের ডানপিটে আর হুল্লোড়বাজ। স্কটিশ চার্চ কলেজে আমাদের এই ত্রয়ীকে সমীহ করে চলত ললনারা। কারণ আমাদেব বাক্যবাণ ছিল বড় তীক্ষ্ণ। চোখাচোখা। বিশেষ করে প্রেমচাঁদের। যেহেতু ওর নামের আগে প্রেম আছে, সুতরাং হৃদয়ে প্রেম থই থই করছে, এই জাতীয় রসাল মন্তব্য টুকুস টুকুস কার সহপাঠিনীরা ছুঁড়ে দিলেই ও টকাস টকাস জবাব দিয়ে যেত। কিছু কিছু টিপ্পনি আজও মনে আছে। যেমন, হে প্রিয়ংবদা, তোমার ওই সূক্ষ্ম চাহনির ছুঁচ আমার এই মোটা চামড়ায় লাগলে ভোতা হয়ে যাবে। অথ, সখী, হঠাৎ ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছ কেন আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে? তোমার ওই লিপস্টিক কমিউনিকেশন ব্যর্থ যাবে এই চঁড়ালের কাছে। ঠোঁট যে সবচেয়ে স্পর্শকাতর অঙ্গবিশেষ বিশেষ বিশেষ প্রক্রিয়া সাধনের জন্যে, তা কি আমার অজানা নয়? অথবা, সিলিকন বুক নাকি? অত দেখান হচ্ছে কেন?